
একটা পূর্ণ মানবিক এবং শান্তিময় সমাজ গঠনের জন্যই সমাজের পুনর্গঠন বা পরিবর্তন প্রয়োজন। একটা সমাজ যেখানে মানুষের মর্যাদা সমানভাবে সুরক্ষিত থাকবে, সে যে ব্যাকগ্রাউন্ডেরই হোক না কেন। একটা সমাজ যেখানে সুবিচার পূর্ণমাত্রায় বহাল থাকবে, প্রত্যেকটি মানুষ সুবিচার পাবে সমানভাবে। অন্নের অভাবে কোনো মানুষ দিনের পর দিন কষ্ট পাবে না। সমাজে বসবাসরত মানুষেরা তাদের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার বদলে অন্য কারো কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। কিন্তু এই বিপরীত চিত্র যখন সমাজের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে, তখনই প্রয়োজন হয় স্বর্গীয় দিকনির্দেশনা এবং একজন মহামানবের।
এই মহামানব আরবের মক্কা শহরের হাশেমী গোত্রে ৫৭০ (মতান্তরে ৫৭১) খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের আগেই পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। যখন ছয় বছর বয়স, তখন মা আমিনা মারা যান।এভাবেই একজন মহামানবের বেড়ে ওঠা, ভবিষ্যতে যে হবে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। আল্লাহ্ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে কালে কালে যে বাণী মানবজাতির জন্য এসেছিল সেই বাণীর সিলমোহর যার উপর লাগবে, তিনিই সেই মুহাম্মদ (সা.)৷
মুহাম্মদ-পূর্ব সেই আরবীয় সমাজের দিকে একটু দেখুন এবার। কোন অমানবিক এবং অসামাজিক কাজটি ছিল না সেখানে? এক আল্লাহ্র সাথে হাজারও শরীক, মানবীয় মর্যাদার লঙ্ঘন, নারীর প্রতি অবিচার থেকে নিয়ে শ্রদ্ধা-সম্মান-স্নেহের কোনো সুন্দর রূপরেখার নূন্যতম আলোকচ্ছটাও ছিল না অন্ধাকারের সেই যুগে। ইতিহাসের এমন এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক পাঠালেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে। নবুয়াত পাওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি ধ্যানমগ্ন ছিলেন যে কিভাবে এই অসামাজিক এবং অমানবিক একটি সমাজকে আলোর দিশা দেখানো যায়। মানুষের এবং পৃথিবীর কল্যাণের কথা তিনি ছোটোবেলা থেকেই ভাবতেন এবং এর জন্য চিন্তামগ্ন ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বরং হিল-ফুল-ফুজুল নামে একটি কল্যাণমুলক এবং সামাজিক সংগঠন তৈরির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সমাজ পুনর্গঠনের ইতিহাসে ছোটোবেলা থেকে এভাবেই দেখা যায় তাঁর মহৎ ও পবিত্র উপস্থিতি। তিনি একটি শ্রেষ্ঠ সমাজ উপহার দিয়েছিলেন পৃথিবীবাসীকে। এমন একটি সমাজ গঠন করেছিলেন যা ইতিহাসের সবচেয়ে অসভ্য এবং বর্বর মানুষদের তৈরি করেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজন্মতে। যারা ছিল রক্তপিপাসু, তারা হয়ে গেল রক্তের সংরক্ষক। অবৈধভাবে এক ফোঁটা রক্ত ঝরাও তাদের কাছে হয়ে গেল গোটা দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার সমান। যারা নারী দেহের প্রতি পশুত্বের রূপ ধারণ করতো, তারা তাদের প্রতি কূদৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকল। জীবন্ত অবস্থায় যারা নিজেদের কন্যাসন্তানদের পুঁতে দিত মাটির গর্তে, তারা কন্যাসন্তানদের আগমনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। এক কথায় একটি ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকারময় সমাজকে তিনি দ্বিপ্রহরের আলোর মতো অবস্থায় পরিবর্তন করেছিলেন।
সমাজ পরিবর্তনের যে ধারণা তা অনেক পুরোনো। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানে যেমন একটা মানবিকতার ধারণা রয়েছে তেমনি সেখানে রয়েছে হাজারও কুসংস্কার ও অমানবিক, অসুন্দর প্রথাসমূহ। সমাজ তার সামাজিক স্থান থেকে অনেকটা নীচে নেমে গেছে এবং নেমে যাচ্ছে দিনের পর দিন। তবে সব জায়গায় একই অবস্থা বা চিত্র দেখা যায় না। সামাজিকতার ধারণা এবং এর প্রভাব যে সমাজে বেশী সাধারণত সেখানে সমাজ অনেকটা সুন্দর অবস্থায় প্রতিভাত হয়। একইভাবে যেখানে সুশিক্ষিত লোকের প্রচন্ড অভাব রয়েছে সেখানে সামাজিকতার অবস্থা একেবারেই দুর্বল।
মুহাম্মদ (সাঃ) ঐশী বাণী আল-কুরআনের আলোকে সমাজ পুনর্গঠনের যে সুসংগঠিত আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই সময় তৎকালীন আরবের একটি সমাজ ব্যবস্থাপনা ছিল৷ যা ছিল মূলত ভুল এবং অমানবিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে। মুহাম্মদ-পূর্ব সময়ের ইতিহাস (ঐতিহাসিকরা যেটাকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ বলে অভিহিত করেছেন) আমরা জানি যে তা কত অসুন্দর এবং অমানবিক ছিল। এইরকম একটা দুর্বল সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আল্লাহ্ রব্বুল আলামিন পাঠালেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংস্কারক মুহাম্মদ (সাঃ)-কে। মানব জাতির ইতিহাসে তুলনাহীন একটা সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করে গেলেন। সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস যদি তার সঠিক মানে অবস্থান করে তবে এর প্রতিচ্ছায়া হিসাবে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক দিক হবে সুন্দর। মূলত সাংস্কৃতিক দিকই একটা জাতির অবস্থা স্পষ্ট রূপে জানান দেয়। একটা জাতিকে ভালো করে বোঝার জন্য সেই জাতির কৃষ্টি-কালচারই যথেষ্ট। তাদের বিশ্বাস কোন মানের তা সেই জাতির সাংস্কৃতিক রূপ দেখেই বোঝা যায়। তারা কখন ঘুম থেকে ওঠে, আচার-আচারণ, চাল-চলন ইত্যাদি সব সাংস্কৃতিক জীবনেরই অংশ। আর যদি বিশ্বাসের ভিত্তি হয় দুর্বল, অস্বচ্ছ তবে তা হবে একটি সমাজের জন্য বিধ্বংসী। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বিশ্বাসের এই ভিত দিয়েই সমাজ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন।
তাই সামাজিক আন্দোলনের (ঐশী পথনির্দেশের আলোকে) সাথে সংযুক্ত এমন সবাইকে বিশ্বাস ও দর্শনের প্রশ্নে স্বচ্ছ হতে হবে। ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক নবীজি মুহাম্মদ (সাঃ) মানুষের এই বিশ্বাসের দুনিয়ায় এনেছিলেন এক অটল পরিবর্তন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত ছিল সেই বিশ্বাসের ভিত্তি। যারা জীবনের ব্যাপারে রাখতো টালমাটাল ধারণা, তাদের কাছে জীবনের ধারণা ও এর পথ হয়ে গেল এতটাই স্বচ্ছ যে, তা তাদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজন্মে পরিণত করলো। তারা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে এতটাই মজবুত করেছিলেন যে, তা ধারণ করার জন্য জীবন দিয়ে দিতে তাদের কুন্ঠা বোধ ছিল না, কিন্তু অসামাজিকতাকে শুভেচ্ছা জানানোর বিন্দু মাত্র কোনো অভিপ্রায় ছিল না তাদের মাঝে। তাঁর (সাঃ) প্রশিক্ষণে এতটাই মানবিক ও সত্য-সুন্দরের নির্যাস ছিল৷ দায়িত্ববোধ ছিল নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত অন্যতম একটি উপাদান সমাজ পুনর্গঠনের এই মিশনে। অন্যকথায় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাথীদের মাঝে দায়িত্বানুভূতির এক দীপ্ত মশাল জ্বেলে দিয়েছিলেন, যার ফলে তারা হয়ে উঠেছিল আপন দায়িত্বপালনে পূর্ণ সজাগ। এমনকি ওয়াদা পালনে তারা জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ করতো না। সমাজ পুনর্গঠনে এই দায়িত্ববোধ খুবই প্রয়োজনীয় একটি গুণ যা মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাথীদের মাঝে গেঁথে দিয়েছিলেন একটি সুন্দর মানবীয় সমাজ গড়ার জন্য। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ইসলামি চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আসাদ তার ইসলাম অ্যাট দ্য ক্রসরোডস বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন নবীজির প্রশিক্ষণ পদ্ধতির তিনটি দিকের কথা। তার মতে নবীজির (সাঃ) দেওয়া প্রশিক্ষণে স্থায়ী সচেতনতা, ভিতরের সজাগ মন ও দায়িত্ববোধ—এই তিনটি গুণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যজনক যোগ্যতা ও চমকপ্রদ ঐতিহাসিক সাফল্যের মূল। এই গুণগুলিই মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাথীদের মাঝে সৃষ্টি করেছিলেন, আর দেখিয়েছিলেন একটি শ্রেষ্ঠ সমাজ কীভাবে গড়ে তুলতে হয়৷
লেখক: মুহাম্মাদ মুরসালিম