
মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন
আধুনিক যুগ থেকে উত্তর আধুনিক যুগে ্প্রবেশ করছে দুনিযা। চোখ ধাঁধানো উন্নযন আর অবাক করা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানবজাতিকে অগ্রগতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিযেে। আমরা ভাবছি আমরা অসভ্যতা থেকে সভ্যতার দিকে, পশ্চাদ্পদতা থেকে অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের জীবনযাত্রায এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মানবসমাজ আগে ছিল যৌথ পরিবারভুক্ত। পপিতামাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন সবাইকে নিযে ছিল একান্নবর্তী পরিবার। এরপর আধুনিকতার ছোঁযা পারিবারিক জীবনকে ভেঙে তছনচ করে দিল। বিবাহ হযে গেল কুসংস্কার। বিবাহিত জীবন ছেড়ে লিভ টুগেদারের কালচার দখল করে নিল আমাদের পারিবারিক জীবনকে। সন্তান-সন্ততির দাযিত্ব পালন করাটা হযে গেল বোঝা। আমরা হয তাদেরকে ভ্রূণ অবস্থায হত্যা করলাম, না হয হোমে পাঠিযে দিযে দাযিত্ব সারলাম। বৃদ্ধ পিতামাতা ছেলেমেযেের কাছে দুর্বহ বোঝায পরিণত হল। আধুনিক সমাজ তাদের জন্য গড়ে তুলল বৃদ্ধাশ্রম। অনেকে ততটুকু দাযিত্ব পালন করাটাও বাড়তি বোঝা ভেবে নিল। তারা তীর্থ যাত্রার নামে বৃদ্ধ পিতামাতাকে ভীড়ের মধ্যে ছেড়ে দিযে আসা অথবা রেলস্টেশনে বা রাস্তায ফেলে দিযে আসাকে বেশি সহজ ভাবতে লাগল। কেউ কেউ আবার অত ল্যাঠা পোযাতে না চেযে নিজেদের হাতেই জন্মদাতা মাতাপিতাকে খুন করে পথ পরিষ্কার করতে লাগল।
আধুনিকতার স্লোগানে নারী স্বাধীনতার নামে বল্গাহীন জীবনযাপনের দাবি উঠল। বিবাহিত হোক না হোক, একজন নারী শুধুমাত্র একজন পুরুষে তুষ্ট থাকবে? তা হতে পারে না। বহুগামীতার অপর নাম হল আধুনিকতা। কোনও পুরুষ বা নারী যখন যার সঙ্গে থাকতে চাইবে তখন তার সঙ্গে থাকতে পারাটাই হল আধুনিকতা। বল্গাহীন উদ্দাম জীবনযাত্রা পশুদের সামাজিক শৃঙ্খলাকেও হার মানাল।
আধুনিক সমাজের আযনায নারী দেহে পোশাক পরিচ্ছদ থাকাটা ব্যাকডেটেড ্প্রমাণিত হল। সুতরাং, পোশাক ছাঁটতে ছাঁটতে আজকের আধুনিক নারীদের শরীরে পোশাক লেশমাত্র নেই। যে পোশাক তারা পরিধান করছে তার উদ্দেশ্য শরীরকে আবৃত করা নয। বরং কত নব নব কৌশলে শরীরের গোপনীয অংশকে ফুটিযে তোলা যায তারই ্প্রতিযোগিতা চলছে। দেহ ব্যবসা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রে সর্বত্র নগ্ন নারীর দেহ নিযে ছিনিমিনি খেলাটাই হল আধুনিকতা। নৈতিক চরিত্র, সততা, মূল্যবোধ এসব শব্দগুলি আধুনিকতার কাছে বেমানান। আধুনিক জীবনের লক্ষ্যই হযে দাঁড়াল শোষণ-দুর্নীতি- অরাজকতা। যে যত রকম কৌশলে মানুষকে ঠকিযে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে আধুনিক সমাজের দৃষ্টিতে সেই তত সফল বলে বিবেচিত হয।
আধুনিক রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে। উত্তর আধুনিকতায গণতান্ত্রিকতার অর্থ পাল্টে যায। ছলে বলে কৌশলে, জোর-জুলুম করে যদি দখল করাটাই আধুনিক রাজনীতি। মিথ্যা-্প্রচার, ্প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, জনগণকে বিভ্রান্ত করে ঠকানোটাই হচ্ছে আধুনিক সরকারের ক্যারিশমা। আধুনিক রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায ঝাঁ চকচকে ্প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে ওঠে, সরকারি হাসপাতালের ঔষধপত্র থেকে সরঞ্জাম সবই পার হয বেসরকারী নার্সিং হোমে। এখানে অক্সিজেনের অভাবে শিশু মরে। নিজের পকেটের পযসায অক্সিজেন এনে রোগী বাঁচাতে চাইলে কর্তব্যরত ডাক্তারকে জেল খাটতে হয। এখানে ছোট বড় মাঝারি সব নেতাদের পিছনে ছোটে ডজন ডজন গাড়ি, আর দানা মাঝিরা একটা গাড়ি না পেযে মৃত স্ত্রীকে কাঁধে নিযে পাড়ি দেয 30 কিমি পথ। আধুনিক আইনে বাল্যবিবাহ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ হলেও আসিফাদের মত হাজার হাজার শিশু ধর্ষিতা হয ্প্রতিনিযত। আধুনিক পুলিশ সাত খুন করে পার পেযে যায, আর দলিত আদিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হলেও তার কোনও বিচার হয না।
আধুনির রাষ্ট্র দরিদ্র জনগণের উপর ট্যাক্সের পর ট্যাক্স চাপিযে দেশাত্মবোধের পরীক্ষা নেয আর সেই অর্থে তৈরি হয মানুষ মারার সরঞ্জাম। এই আধুনিকতায ধর্মের নামে রাম-রহীম বাবা আর আশারাম বাপুদের দাপাদাপি। এখানে ইসলামের কথা বললে, তা হযে যায ব্যাকডেটেড আলোচনা। আর কেতাদুরস্ত বাৱুরা গলায টাই পরে হাতে ডজন ডজন পাথরের আংটি পরে মাজার, আস্তানা আর বাবাদের ডেরায ধরনা দেয। এখানে হাতে মোটা লাল কার পরে আর কপালে তিলক একে কুসংস্কার বিরোধী সেমিনার ঝেড়ে বত্তৃ্তা করা যায।
্প্রশ্ন হল, কেন এমন হল? আধুনিকতার নামে নীতি বর্জিত, আদর্শ-বর্জিত, মূল্যবোধ বর্জিত কোন অতল গহ্বরে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। এই লাগামহীন বেলেল্লাপনা আর সীমাহীন দুর্নীতি থেকে সমাজ, রাষ্ট্র তথা দুনিযাকে বাঁচানোর পথ কি?
আধুনিকতা ও ্প্রগতির নামে পাশ্চাত্য সমাজ দুনিযা থেকে ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপ করতে চায। ইউরোপ রেনেসাঁ বা নবজাগরণের নামে বস্তুবাদ ও ভোগবাদকে একমাত্র সত্যরূপে মানুষের সামনে তুলে ধরে। ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, নীতি নৈতিকতা; দাযিত্ব, কর্তব্য সবকিছুর ব্যাখ্যা হতে থাকে পার্থিব দৃষ্টিতে। ঈশ্বর বা আল্লাহর কোনও অস্তিত্ব নেই। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে কোনও জীবনাদর্শ আসতেই পারে না। ধর্ম যুগের ্প্রাককালে মানুষ তৈরি করেছে। এখানে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই। ঈশ্বর মানুষ বা বিশ্ব কিছুই তৈরি করেননি। বরং মানুষই তাদের কল্পনাতে ঈশ্বর-আল্লাহ-গড-এর ধারণা জন্ম দিযেে।
দুর্ঘটনার ফলে জগত্ তৈরি হযেে আর ঘটনাক্রমে এই পার্থিব জগতে ্প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই ্প্রাণ বিভিন্ন বিবর্তনের পর্যায অতিক্রম করে পশু-পক্ষী এবং মানুষে রূপান্তরিত হযেে। বস্তুবাদের এই ধারণা এত ব্যাপকভাবে এবং এমন গভীরভাবে মানুষের মনে ্প্রোথিত করা হযেে যে চরম আস্তিক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্ম পণ্ডিতরাও অবচেতন মনে ওইসব কথাকে সত্য বলে মান্যতা দিযে থাকে। আজকের রাম-রহীম বাবারা বা খাজা বাবার আস্তানে বসা পীরেরা কি আল্লাহ বা পরকালকে বিশ্বাস করে? তাদের কাছে কি ধর্ম শুধু অর্থ কামানো আর বিলাসিতায গা ভাসানো ছাড়া অন্য কিছু?
ধর্ম সম্পর্কে রেনেসাঁওযালাদের এই ব্যাখ্যা বিশ্ব সভ্যতাকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ্প্রতিক্রিযার ভযে ধর্মকে নিছক ব্যক্তিগত বিষয বলে মেনে নেওযা হযেে। অর্থাত্ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা সমস্ত জাযগা থেকে বিদায দেওযা হয ধর্মকে। তাই, ব্যক্তিগত সংস্কার হিসাবে অন্যান্য ধর্ম টিকে থাকলেও ইসলামের অত্যন্ত ভারসাম্য পূর্ণ জীবনাদর্শ থেকে বঞ্চিত হয বিশ্ব মানব সমাজ।
্প্রচলিত অর্থে ইসলাম কোন ধর্ম নয। ইসলাম মানুষের উপযোগী শ্বাস্বত, চিরন্তন জীবনবিধান। শুধু পারলৌকিক কল্যাণ নয, পার্থিব জীবনের যাবতীয ্প্রযোজন পূরণের ব্যবস্থা রযেে ইসলামে। খুব স্বাভাবিক ভাবে মনে হতে পারে ইসলাম থেকে বঞ্চিত হওযার কারণে অমুসলিম সমাজে, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, বেহাযাপনা ইত্যাদি থাকতে পারে। কিন্তু মুসলিম দেশ বা মুসলিম সমাজও তো সমানভাবে এই রোগে আক্রান্ত। এর কারণ কি? আসলে মুসলিম সমাজ বা মুসলিম দেশগুলিতেও ইসলাম জীবনাদর্শ হিসাবে উপস্থিত নেই। মুসলিম সমাজের অতি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া বাকি সবাই এটাকে আনুষ্ঠানিকতা ও ্প্রচলিত ধর্মের মতই গ্রহণ করেছে। পবিত্র কুরআন তাদের কাছে দোআ তাবিজের কিতাব। বড়জোর এই কিতাব পড়ে মৃত মানুষের আত্মায শান্তি পৌঁছানো যাবে বলে তারা ধরে নিযেে। কুরআন জীবন্ত মানুষের উপর এবং জীবন্ত মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অবতীর্ণ হযেে একথা মুসলিম সমাজ তত্বগতভাবে মানলেও আদর্শগত ভাবে তা গ্রহণ করেনি। যার ফলে অন্য সমাজের সঙ্গে মুসলিম সমাজের কোনও পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে না।
হযরত মুহাম্মাদ (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) ও তার সাহাবী (রা)গণ কুরআনকে জীবনবিধান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে সেই কুরআনের আলোয গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জীর্ণ বর্বর আরব বেদুইনরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জাতিতে পরিণত হযেিল। সেই শিক্ষার রেশ যতদিন মুসলিম সমাজে ছিল ততদিন মুসলিমরাই বিশ্বকে পথ দেখিযেে, আলোকিত করেছে। কিন্তু যখন তারা নিজেরাই ইসলাম ছেড়ে, কুরআন ছেড়ে অন্যদের অনুসরণ করতে শুরু করছে তখন থেকেই তাদের পতন শুরু হযেে।
লেখক – বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক