দেশ ও দায়িত্ব
স্বাধীনতার পরে ৭৩ বৎসর অতিক্রান্ত৷ ১৫ আগস্ট দিনটি নিয়মমতো ক্যালেন্ডারে প্রতি বৎসরই আসে। স্বাধীনতার শুভেচ্ছাবার্তায় ভরিয়া ওঠে মোবাইলের ইনবক্স।তেরঙ্গায় রঞ্জিত হয় প্রোফাইল পিকচার। সূচনা হয় আরও একটি ছুটির সকালের৷ আর অবধারিতভাবে আরম্ভ হইয়া যায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পাটিগণিত কষা।আঠারো হইতে আশি উদাত্ত কণ্ঠে বলিয়া ওঠে, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। সবাই যে এ কথা বলে তেমন নহে৷ একদল উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উড়ায়৷ একদল দাবি করে, প্রকৃত স্বাধীনতা আসে নাই৷ আরেকদলের মত, দেশ উন্নয়নের পথে চলিতেছে৷ স্বাধীনতার পরে এই বাক-বিতণ্ডাই আমাদিগের প্রাপ্তি৷ আমরা কি অনায়াসেই ভুলিয়া বসিয়া রহিয়াছি সংগ্রামীদের আদর্শ এবং আমাদিগের দায়িত্ব৷ রেড ফোর্ট আর তেরঙ্গা পতাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি দিনটিকে।তবে এবারের দিনটি একটু। করোনাকাল ও লকডাউন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিচ্ছে দেশকে। এই সময় আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়া যায়।
স্বাধীনতার সত্তর বছরের অধিক বয়স পার হইয়া গেল। দেশের আশি শতাংশ লোক এখনও দরিদ্র,ফুটপাতে ঘুমায় বহু মানুষ, জাতপাতের সমস্যা উঁকিঝুঁকি মারে অন্তরাল হইতে৷ হরেক রকমের অভিযোগ স্বাধীনতার রং ফিকে করিয়া তোলে।কিন্তু দেশের দিকে আঙুল তুলিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হইয়া যায়? দেশ কী? কাহাদের লইয়া দেশ? আমি,আমরা,তুমি,তোমরা,সে,তাহারা বাদ দিইয়া কি দেশ হয়?আমরা অভিযোগ করি, স্বাধীন দেশ আমাদের চাকরি দিল না।রুটি,কাপড় দিল না।অপ্রাপ্তির ভাঁড়ার পরিপূর্ণ। অথচ একবারও কি আমরা নিজেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি,তরতাজা কিশোর ক্ষুদিরাম কেন হাসিতে হাসিতে ফাঁসির মঞ্চে উঠিয়া গেল? ভগৎ সিং,মাস্টারদা সূর্য সেন,সুভাষ বোসরা কেন এত ত্যাগ স্বীকার করিলেন ?আমরা শুধু চাহিয়াই যাই। কখনো ভাবি না, দেশকে কিছু দেওয়া প্রয়োজন। এই মাতৃভূমির প্রতিও আমাদিগের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রহিয়াছে৷ দেশের প্রতি ভালোবাসার অর্থ দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা।সেটা কোথায়?সেটা তো শুধু জাগিয়া ওঠে ১৫ আগস্ট আর ২৬ জানুয়ারির ভোরে। এই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আমাদের কাছে পরিণত হইয়াছে একটি নিছক ছুটির দিনে।
আমরা কি গর্বিত কণ্ঠে বলিয়া উঠি,ভারত আমার অহংকার? আমাদের দেশপ্রেম উথলাইয়া ওঠে ভারত- পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময়।অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হয় চক দে ইন্ডিয়া দেখিয়া। রাস্তায় কলার খোসা ,প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলিয়া দিই অনায়াসে। যেখানে লেখা রহিয়াছে, এইখানে থুতু ফেলিবেন না,এইখানে প্রস্রাব করিবেন না, সেইখানেই আমরা থুতু ফেলি ,প্রস্রাব করি।আমরা কেমন ভারতীয়? ১৫ আগস্ট আসিলেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে শুরু হইয়া যায় মূর্তি পরিস্কারের কাজ।মালা পরানোর তোড়জোড়, মাইকে দেশাত্মবোধক ।শুধু মালা দিয়াই কি সব কর্তব্য শেষ? নেতাজি,গান্ধীজি, আজাদের আদর্শ আজ আমরা মানিয়া চলিতেছি? ধর্মনিরপেক্ষ, ন্যায়, সততা,বাকস্বাধীনতার আদর্শ হইতে আজ আমাদের দেশ বহু দূরে এবং ইহার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা দেশের উন্নয়নের জন্য গলা ফাটাই।অথচ কৃষকের কথা ভাবি না।সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় রাজধানীর রাজনীতি হেডলাইন হয়।গ্রামের খবর থাকে ভেতরের পাতার এক কলামে।দেশপ্রেমের নামে বিদ্বেষ ছড়াইতে দ্বিধা বোধ করি না।
এই সময় আমরা আরও একটি ভুল করিয়া বসি।দেশ ও রাষ্ট্রকে গুলাইয়া ফেলি।দেশ আর রাষ্ট্র কি একই? রাষ্ট্রের ভুল-ত্রুটি দেশাত্মবোধ আর জাতীয়তাবাদের আড়ালে ঢাকা পড়িয়া যায়৷ সংবিধানের ধারা উল্লেখ করিয়া আমরা আমাদের অধিকার আদায়ে আগাইয়া আসি। ৫১ (ক) ধারার মৌলিক কর্তব্যগুলোর দিকে একবারও তাকাই না। অথচ নিজেদের দেশদরদি বলিয়া দাবি করি। দেশ মানে শুধু জাতীয় সংগীত আর পতাকা নহে।দেশের ভেতর লুকাইয়া রহিয়াছে আরেকটি দেশ।সেই দেশ বেকার,ক্ষুধাতুর, দরিদ্র।স্বাধীনতার এই বিশেষ দিনে সেই দেশ নতুন করিয়া গড়িয়া তুলিবার শপথ নেওয়ার দিন।এই দিন নতুন করিয়া ভাবিবার দিন।কী পাইয়াছি তাহা নহে ,কী দান করিতে পারিব সেই ভাবনার দিন আজ।