মইনুল হাসান
তারপর
গান্ধী জিন্নার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন একজন ‘ব্যক্তি’ হিসাবে। কংগ্রেসের বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে নয়। কিন্তু তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিল সারা দেশের মানুষ, ব্রিটিশ এবং কংগ্রেসের নেতারা। কিন্তু জিন্না জানতেন গান্ধীজীর অনেক কথা বা পরামর্শ কংগ্রেস দল এবং তার নেতারা মানছেন না। গান্ধী বললেন –
I have stated publicly that I have approached you as an individual. My life mission has been Hindu-Muslim unity which I want for its own sake but which is not to be achieved without the foreign ruling power being ousted.
কংগ্রেস গান্ধীজীর কথা মানবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজী বলেন –
I am pledged to use all the influence I may have with the congress to ratify my agreement with you.
জিন্নার মধ্যে একটা সাদস্থার ভাব লক্ষ্য করা যায়, যার মাধ্যমে মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবের পরেও হিন্দু-মুসলিম সংঘাত এড়াতে গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাতে বসতে তাঁর মধ্যে কোন দ্বিধা ছিল না। গান্ধীজীর প্রসঙ্গেও প্রায় একইরকম কথা বলা যায়। গান্ধী নিজে ছিলেন পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধী। তবুও গান্ধী একবার শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছেন জিন্নার সঙ্গে আলোচনা বসে। যাতে হিন্দু মুসলমান সংঘাত এড়ানো যায় এবং দেশভাগ এড়ানো যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই মহান ব্যক্তিত্বের এমনতর উদ্যোগ, আলোচনা, পত্রালাপ পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত আছে।
গান্ধীজী তাঁর লেখা জিন্নার প্রতি চিঠিগুলিতে তাঁকে প্রিয় কায়েদ-ই-আজম’ বলে সম্মোধন করেছেন। অর্থ ‘দেশনেতা’। চিঠির শেষে লিখতেন কোন সময় ‘আপনার একান্ত’, কোন সময় ‘আপনার বিশ্বস্ত’। জিন্না সবসময় শেষে লিখতেন ‘আপনার একান্ত’। পরবর্তীকালে উভয়েরই সহকর্মীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, দু’জনে দু’জনের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। আর দু’জনের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। চিঠির প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি ১৯৪৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর চিঠিগুলি গান্ধীজীর অনুমতি নিয়ে জিন্না লাহোরে সাংবাধিক সম্মেলন ডেকে প্রকাশ করেন। তারপর প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য যুক্ত হয়ে তা গান্ধীর Protagonists of Pakistan বইতে প্রকাশ পায়। ২৬শে জানুযারী ১৯৪৭ করাচি থেকে প্রকাশিত হয়। মুখ্য পরিবেশক ছিল রূপা এ্যাণ্ড কোম্পানী (কলকাতা ও এলাহাবাদ)। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। সেখান থেকেই চিঠিগুলোর অনুবাদ হয়েছে।
যাইহোক, আলোচনা বা চিঠিপত্র কোন মাধ্যমেই কোন মীমাংসা সূত্র পাওয়া যায়নি। শেষ চিঠি ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪। একই দিনে। দু’জনের। গান্ধী অসম্ভব আশাবাদী ছিলেন। আলোচনায় মীমাংসা সূত্র না পাওয়ার সাথে সাথে বললেন – Failure should only serve as a spur to further effort.’ কেউ কাউকে মতান্তরিত করতে পারেননি। গান্ধী বললেন – He was convinced that even out of that breakdown good result would come.” এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে গান্ধীর যুক্তি –
He had tried his level best to go as far as he could to meet the Qaid-e-Azam`s view point. He has taken incalculable pains to understands him and to make himself understood. But he had failed.
আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর জিন্নাও অধৈর্য্য হয়ে পড়েননি। কোন বিরূপ মন্তব্য বা দোষারোপ করেননি। গান্ধীর মতো তিনিও নিজের মতামত ব্যক্ত করেন –
I have placed before him everything and every aspect of the muslim point of view in the course of prolonged talks and correspondence and discussed all the pros and cons generally and I regret to say that I have failed in my task of converting Mr. Gandhi … Neverthless. We hope that the public will not feel embittered and we trust that this is not the final end of our effort.
আর একবার পাঠককে শেষ বাক্যের অংশটির দিকে নজর দিতে বলবে – We trust that this is not the final end of our effort. মহান ব্যক্তিরা সবসময়ই আশাবাদী হন। তাই ছিলেন দু’জনে।
শেষ ভাগ হয়েছে। আটকানো যায়নি। দুই মহান ব্যক্তির জীবনও শেষ দুঃখবহ ঘটনায়। নাথুরাম গডসের গুলিতে প্রান হারালেন গান্ধীজী – ১৯৪৮ সালে’র ৩০ জানুয়ারি। অন্যদিকে জিন্নার মরদেহ যখন কোয়েটা থেকে করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছালেন, তখন সেটা নেবার জন্য কেউ ছিল না। পিঁপড়েরা চলে বেড়াচ্ছে। বেশ পরে মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ আমলারা এসেছিলেন। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক বাঙালি বিমানকর্মী। আমরা যে প্রকৃত অর্থে এই মহান ব্যক্তিদের কাছ থেকে কোন শিক্ষা নিইনি সেটাই প্রমাণ হয়েছে। আজও।
চলবে…