ArticalPost Editorial

অনলাইন গেমের প্রকোপে নিঃসঙ্গ খেলার মাঠ, হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব-কৈশর-তারুণ্য

309views

হোক ধূলি, এ ধূলির কোথায় তুলনা!
থেকো না অকালবৃদ্ধ বসিয়া একেলা–
কেমনে মানুষ হবে না করিলে খেলা!- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্বকবির এইসব কথা এখন যেন অতীত।
মাঠে গিয়ে ধুলো-কাদা মেখে, ঘেমে নেয়ে, রোজ বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি ফেরার দৃশ্য আজকাল যেন খুবই দুর্লভ। পাড়ার খেলার মাঠ দিন দিন নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। আর কেউ খেলতে আসেনা তার কাছে, ছোটাছুটি বন্ধ। এইতো কয়েক বছর আগেই খেলার মাঠগুলোর ব্যস্ততার সীমা থাকতো না। স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাট-বল, ফুটবল নিয়ে ছুটে যেত সবাই। কেউ যেত ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে। এখন আর ঘুড়ি নিয়ে মাতামাতি করতে দেখা যায় না। আজকের শিশু,কিশোর ও যুবকেরা আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া উত্তরণ। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় ‘মুঠোফোন’ এখন নাকি খেলার মাঠ। বর্তমান প্রজন্ম মাঠে গিয়ে দাপাদাপির থেকে কয়েক ইঞ্চি স্মার্টফোনের স্ক্রিনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। স্মার্টফোনে ডাউনলোড রয়েছে পাবজি, এইটপুল, ফ্রি ফায়ার, ক্লাশ অফ ক্ল্যানসের মত হিংস্র সব ভিডিও গেমস। ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি সারারাত ঘরের এক কোনায় বসে অনলাইন গেমে বুঁদ হয়ে আছে ছোট্ট শিশু থেকে যুবকরা। ক্রিকেট, ফুটবলের মত মাঠে ময়দানে গিয়ে খেলার পরমানন্দ খুঁজে বেড়ার না তারা। সেই সঙ্গে পুরানো দিনের গ্রাম্য সব খেলাধূলা- লাটিম, মার্বেল, কানামাছি, গোল্লাছুট ইত্যাদির নামও হয়ত শোনেনি অনেকে।

স্মার্টফোনের অনলাইন গেম ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ও দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। বিশ্বজুড়ে আজ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন গেম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা দেখা গেছে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে অনলাইন গেম খেলে থাকে। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্প বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। এদের বদৌলতে গ্লোবাল অনলাইন গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৮.৯০ মিলিয়ন ডলার! আর ‘অনলাইন গেমিং’ রমরমিয়ে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেম প্রতি বছর ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে অনলাইন গেম একটি নিরীহ অভ্যাস হলেও এর পরিণাম কি ভয়াবহ হতে পারে তা গেমগুলোর ধ্বংসাত্মক সব বৈশিষ্ট থেকে সহজেই বোঝা যায়।। এই গেমগুলোতে প্রচন্ড গতিসম্পন্ন গাড়ি নিয়ে রাস্তা, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ছুটে চলতে হয়। এবং বিপজ্জনক হল, এই ছুটে চলার পথে অন্য প্রতিযোগীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া, গাড়ির নীচে মানুষ পিষে ফেলা, পথচারীর কাছ থেকে মোটর সাইকেল বা গাড়ি কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ফুটপাতে উঠে পড়া, রাস্তা ও বাড়িঘর ভাঙচুর করা, পুলিশ ধাওয়া করলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা- এইসব কিছুই অনলাইন গেমের সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয়! এই অনৈতিক ও ধ্বংসাত্মক কাজ করে যে বেশী পয়েন্ট অর্জন করতে পারে সে’ই বিজয়ী হয়! অন্য এক ধরনের গেম আছে, যার পুরোটা জুড়েই থাকে হিংস্রতা, মারামারি, যুদ্ধ, দখল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যত বেশি সহিংসতা তত বেশি পয়েন্ট! হিংসার উদ্দাম আনন্দ নিয়ে দুর্গম গিরিপর্বত, নদীনালা, জঙ্গল ও সমুদ্রের উপর দিয়ে শত্রু খুঁজে বেড়াতে হয়। বাংকার খনন করে ওঁত পেতে থাকা। প্রতি মুহূর্তে শত্রুর আক্রমণের টেনশন। আরো দ্রুত চলতে হবে। যত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সম্ভব প্রতিপক্ষকে শেষ করতেই হবে। আজকের শিশু, কিশোর এবং তরুণেরা হয়ত জানেও না, কেন তারা এই মারণখেলার নেশায় মত্ত! একের পর এক মানুষ খতম করে চলেছে। কখনো হাতুড়িপেটা করে প্রতিপক্ষের মাথা থেঁতলে দিচ্ছে। মুহূর্তে রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। কখনো আবার গ্রেনেড ছুঁড়ে প্রতিপক্ষের পা জখম করছে। এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে পলায়নপর মানুষটির উপর মারছে দ্বিতীয় গ্রেনেড। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার হাত,পা,মাথা। অবশেষে এই রক্তমাখা দেহটা লুটিয়ে পড়ছে খেলোয়াড়ের পায়ের উপর!

বর্তমান প্রজন্মের সম্ভাবনাময় ফুটন্ত ফুলগুলোর চোখের সামনে ভাসছে জীবন্ত যুদ্ধক্ষেত্র। কানে আসছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহারের বাস্তব আওয়াজ। এমনকি আহত শত্রুসেনার রক্তমুখের গর্গর শব্দটাও শুনতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো খেলায় রাস্তায় পড়ে থাকা লাশের পকেট এবং ব্যাগ থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করতে পারলে পাওয়া যাচ্ছে বাড়তি পয়েন্ট! এমনকি রাস্তায় ড্রাগ বিক্রেতার কাছ থেকে ড্রাগও কেনা যাচ্ছে। এত বীভৎসতা সত্ত্বেও কিন্তু তাদের আনন্দ, উৎসাহ এবং উত্তেজনা কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) অনলাইন গেমের এই আসক্তিকে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ নামক অসুখ বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রাকৃতিক পরিবর্তন, পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনের অদ্ভুত সব অভ্যাসের ফলে নতুন নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে পৃথিবীতে। ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ তেমনই এক নতুন ‘অসুস্থতা’।

সবুজ মাঠ ছেড়ে অনলাইন গেমের নেশায় এক কঠিন এবং বিপজ্জনক দুনিয়ায় ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। এই নিষ্ঠুর এবং ধ্বংসাত্মক জগৎ প্রতি মুহূর্তে তাদের থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে শৈশব, কৈশর এবং যৌবনের সম্ভবনাময় মুহূর্তগুলো। এমনকি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে তারা। গা শিউরে ওঠার মত কয়কেটা ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ‘ক্যারি আউট দ্য ব্লাস্ট!’ বলতে বলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল ১৬ বছরের ফুরকান কুরেশি। মধ্যপ্রদেশের নিমুচ শহরের কিশোর ফুরকান দুপুরে খেয়ে উঠেই মোবাইলে ‘পাবজি’ (প্লেয়ার আননোন’স ব্যাটল গ্রাউন্ড) খেলতে বসে। টানা ৬ ঘণ্টা একটানা খেলা চলার পরে হেরে যায় এবং তারপরেই উত্তেজিত হয়ে বাকি খেলোয়াড়দের উপর চিৎকার করতে থাকে ফুরকান। তীব্র উত্তেজনায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত্যু বলে ঘোষণা করে। পুণেতে পাবজির নেশায় মত্ত ২৫ বছরের এক যুবক মারা যান। ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন যে, অতিরিক্ত গেম খেলার জন্যই ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল তাঁর। হার্শাল মেমানে নামের ওই ব্যক্তি পাবজি খেলার সময়ে প্রায়শই নিজের হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারতেন না। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে জানা যায়, ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। মধ্যপ্রদেশের ছিন্দ‌ওয়াড়া জেলার এক যুবক পাবজিতে এতটাই ডুবে ছিল যে, সে জলের পরিবর্তে অ্যাসিড পান করে ফেলে। মুম্বাইয়ের এক ১৮ বছরের যুবক পরিবারের কাছে পাবজি গেম খেলার জন্য স্মার্টফোন চায়। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে ফোন কিনে দিতে অস্বীকার করায় সে আত্মহত্যা করে। পাবজি খেলতে বাধা দেওয়ায় মাথা, হাত, পা কেটে বাবাকে খুন করে কর্ণাটকের যুবক রঘুবীর। এছাড়াও পাবজির নেশায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। পাঞ্জাবের এক যুবক পাবজির নেশায় বাবা-মায়ের ১৬ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিয়েছে। অ্যাপ কেনা, টুর্নামেন্টের উত্তীর্ণ হওয়া ও পাবজির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে গিয়ে এই টাকা খরচ করেছে সে। এ রাজ্যেও বহু যুবক ব্লু-হোয়েল নামক গেমের প্রকোপে পড়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে।

অনলাইন গেমের এই নৃশংস পরিণতির স্বীকার আজকের শিশু থেকে তরুন সকলেই। স্মার্টফোন যেমন আমাদের সামনে অবিশ্বাস্য এক দুনিয়া হাজির করেছে, ঠিক তেমনই প্রকৃতির কোল থেকে দূরে সরিয়ে একটি রোবোটিক বা যান্ত্রিক দুনিয়ার প্রবেশ করাচ্ছে। শৈশব- কৈশর-তারুণ্যের প্রণোচ্ছল চঞ্চলতা এখন যেন বন্দী একটি মুঠোফোনে। সবুজের ছোঁয়া নেয়, ধুলোমাখা পা নেয়, হারিয়ে যেতে চলেছে খেলার মাঠের দুরন্তপনা। ইন্টারনেট আর অনলাইন গেমের সহজ স্বীকারে পরিণত হয়েছে বর্তমান প্রজন্ম। অনলাইন গেমের নেশায় খেলার মাঠ ভুলে চার দেওয়ালের অবদ্ধে থেকে স্মার্টফোনে মগ্ন হয়ে যাওয়া কিশোর ও তরুণদেরকে নৈতিক অবক্ষয়, শারীরিক ক্ষতি এবং মানসিক অবসাদ থেকে মুক্ত করে উন্মুক্ত এক দুনিয়া উপহার দেওয়া সময়ের দাবি। এই নেশায় মত্ত আশেপাশের সকলকে মুক্ত করতে দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। অনলাইন গেমের গ্রাসে আর যেন কেউ নিজের যৌবন ও জীবন নষ্ট না করে তা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন কউন্সিলিং। এই গেমের ক্ষতিকারক দিক স্পষ্ট তুলে ধরতে হবে সমাজে। এই প্রজন্মকে ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ খেলার মাঠ। স্মার্টফোনে অনলাইন গেমের মত ‘বোকাবাক্সে’র পরিবর্তে প্রকৃতির সবুজ মাঠ প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে।

1 Comment

  1. বাস্তব এক জ্বলন্ত সমস্যা। একটা যুগের সমগ্র জেনারেশন এভাবে ধ্বংস হওয়াটা ইতিহাসে বিরল।

Leave a Response