
প্রায় ৬ বছর আগে, ২০১৮ সালে রবীন্দ্র সদন চত্বরের শিশির মঞ্চে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। ভরা সভায় (ভুল হল, ভিড় উপচে পড়ছিল আর কি!) তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় বলেছিলেন, ছোটবেলায় এক সময় আমরা তর্ক করতাম ঈশ্বর আছেন কি নেই। এখন আমরা ভাবি সিপিএম আছে না নেই! পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের রাজনীতিতে বামেদের বেহাল দশা এবং ক্রমশ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যাওয়া নিয়েই তিনি এই সরস মন্তব্যটি করেছিলেন। ২০২৪ সালের প্রথম মাসটিতে দাঁড়িয়ে শিশির মঞ্চের সেই সন্ধ্যাটির কথাই মনে পড়ছে। অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের সংশয়ে প্রশ্ন জাগছে মনে, বিশ্বে গণতন্ত্র আছে, নাকি নেই? যদিও ‘বিশ্ব’ বললাম, তবে ভাবনার প্রেক্ষিতটা অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়া। সদ্য নির্বাচন শেষ হয়েছে সাউথ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশে। দেশটিতে যেভাবে বিরোধীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন হল, পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা, তাতে এমন ভাবনা আসা অস্বাভাবিক নয় মোটেই।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির গালভরা নাম ভারতীয় উপমহাদেশ। ব্রিটিশরা তাদের কলোনি ছেড়ে চলে যাবার পর ‘স্বাধীন’ দেশগুলি এখন আর ‘ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ বলতে অতটা আগ্রহী নয়। তাই সাউথ এশিয়া বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের মতো দেশগুলিকে। এই দেশগুলিতে গণতন্ত্রের নামে কোথাও চলছে স্বৈরাচারী শাসন, কোথাও মিলিটারির ভারী বুটের আওয়াজ, আবার কোথাও এক দলের আধিপাত্যবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসন ব্যবস্থা। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে, তার জবাব কিন্তু কেউ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। নির্বাচনের আগে আমেরিকা যেভাবে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা হুমকি দিয়ে আসছিল বাংলাদেশকে, নির্বাচনের পর কিন্তু তারা ততটা উচ্চবাচ্য করছে না। যদিও আমেরিকা ও রাষ্ট্রসংঘ বলেছে, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। সেখানে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছে। তবে আমেরিকা এটাও জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে যাবে। প্রয়োজনে সাহায্য, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শেখ হাসিনার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করে সেই বার্তাকে জোরদার করেছেন। গণতন্ত্রের ‘সুস্বাস্থ্যের’ জন্য অনেকেই পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা নিজেদের গণতন্ত্রের মুরুব্বি বলতেও ভালোবাসে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে তাদের চিন্তা কতখানি, আর চিনকে নিয়ে চিনচিনে ব্যথা ও অস্বস্তি কতখানি, সে নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। তাদের কাছে হয়তো গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও উন্নয়নের চেয়ে চিনের সঙ্গে পাঙ্গা দেওয়ার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় ‘মিত্র’ জরুরি।
উত্তর-ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াকেই বেশি ‘স্থিতিশীল’ বলে আপাত ধারণা করা হয়ে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোও সেটাই ভাবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির স্বাধীনতা পাওয়া কত বছর হল এ নিয়ে আমরা একটি বিশ্লেষণ করতে পারি। এরই সঙ্গে তুলনা চলতে পারে আফ্রিকার দেশগুলির স্বাধীনতা লাভের সময়। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি স্বাধীন হচ্ছে বিশ শতকের চার, পাঁচ, ছয় বা সাতের দশকে। অর্থাৎ, তারা ধীরে ধীরে সাবালক থেকে পৌঢ়ত্ব ও বৃদ্ধ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো এবং তাতে জনগণের অংশগ্রহণ, অর্থাৎ পুরো সিস্টেম কি ‘বালখিল্যতা’ অতিক্রম করতে পেরেছে! দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এখানে জনতুষ্টিবাদী বা পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে গত দশ বছরে। উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের যে ডেমোক্রেসি মডেল, তা কোথায়! ধর্মীয় ইস্যু দিয়েই নির্বাচন বৈতরণী পার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন পপুলিস্ট নেতাই যেন একাই একশো। তিনিই রাজা, তিনিই জনগণমন অধিনায়ক! উদাহরণস্বরূপ, ভারতে যদি নরেন্দ্র মোদির নাম উঠে আসে, সেক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কায় মাহিন্দা ও গোটাবায়ে রাজাপাক্ষের নাম বলা যেতে পারে যারা গত বছরের অভ্যূত্থান বাদ দিলে ১৫ বছর ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে শাসন করে আসছে পালা করে। বাংলাদেশে সেই একই ভূমিকায় শেখ হাসিনা। বিরোধী শক্তিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে দেশটিতে, এ কথা যদি আমরা স্বীকার না করি তা হলে সেটা বিপদের সময় উটপাখির বালিতে মাথা গুঁজে নিশ্চিন্ত হওয়ার মতোই ঘটনা! আশঙ্কার ব্যাপার এই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে মুজিবুর রহমান যেভাবে একদলীয় ‘বাকশাল’ কায়েম করেছিলেন, সেভাবে ফের বাংলাদেশ একদলীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কি না।
‘রিপাবলিক’ পাকিস্তানের কথা আলাদা করে বলা দরকার। যদিও সেখানে পাবলিকের মতামতের মূল্য কতখানি তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। ভারতের সঙ্গেই দেশটি স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ভারত যতটুকু এগিয়েছে, পাকিস্তান যেন ঠিক ততটুকুই পিছনের দিকে গিয়েছে। মিলিটারির শক্ত হাত সেখানে কখনোই ‘ইসলামিক রিপাবলিক’কে শক্তিশালী হতে দেয়নি। ইমরান খানকে যেভাবে নির্বাচনের আগে জেলে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে, সেনাবাহিনীর সমর্থনে যেভাবে ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা মসৃণ করছেন নওয়াজ শরিফ, সেখানে জনতার ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ক্রমাগত। মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানের গণতন্ত্রের বয়স কম। তারা নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র থেকে নিজেদের ‘খুঁজে’ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক মডেল বা কাঠামোয় পড়ে এই দেশগুলির আকাশও কালো মেঘে ছেয়ে আছে। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তারা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ধার ধারে না। নিজেদের ইসলাম অনুসারী হিসেবে দাবি করে। কিন্তু তাদের কাজেকর্মে তার প্রতিফলন কতটা ঘটছে সেটা একটু সময় দিলেই বোঝা যাবে। তবে সেখানে পপুলিজমের উত্থান এখনও ঘটেনি, এটা বলা যায়।
গণতন্ত্রের নামে পপুলিজমের উত্থানের পাশাপাশি আরও একটা বিষয় উদ্বেগের। সেটা হল লুণ্ঠনজীবী নব্য পুঁজিবাদীদের উত্থান। তারা এক কেন্দ্রীভূত ও তথাকথিত স্থিতিশীল সরকার চায় যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য রমরমিয়ে চলে। কোনও সমস্যা না ঘটে। সেজন্য তারা এ ধরনের সরকার তৈরিতেও তাদের ক্যাপিটাল ইনভেস্ট করছে এবং নির্বাচনের পর বিপুল পরিমাণে জনতার সম্পদ লুঠ করছে সরকারের সহায়তায়। সরকারের আর কিচ্ছু করার থাকে না। সে তো তখনপুঁজিপতির হাতের পুতুল!
এভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার শাসন কাঠামো ও রাজনীতি এক ঘোর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন নতুন চিন্তাভাবনার সময়। এই পড়ে-পাওয়া গণতান্ত্রিক মডেল নিয়ে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। গণতন্ত্রের নামে পপুলিস্ট নেতা, পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের শাসন কিন্তু ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। দক্ষিণ এশিয়াকে এখন একটি দৃঢ়, দূরদর্শী ও উন্নয়নমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা শুধু আমেরিকা, রাশিয়া, চিনের দ্বন্দ্বে দাবার ঘুঁটি হয়ে থাকবে, নাকি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজেদের দেশের প্রকৃত গণতন্ত্রকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে। (আর্কাইভ পোস্ট)
লেখক: গোলাম রাশিদ