[contact-form][contact-field label=”Name” type=”name” required=”true” /][contact-field label=”Email” type=”email” required=”true” /][contact-field label=”Website” type=”url” /][contact-field label=”Message” type=”textarea” /][/contact-form]
বহুদিন থেকে বছরের প্রথম দিনে প্রতিজ্ঞা করি বইপড়াটা আর একটু বাড়াবাে। স্থির করি ৬০ থেকে ৭৫টা বই পড়তেই হবে। ছােট বড়াে, ইংরেজি বা বাংলা মিলিয়ে। কোনােবারই শেষ সংখ্যাটা অতিক্রম করতে পারিনি। বছরের শেষ দিন এই নিয়ে কিছুটা বিমর্ষও থাকি। কিন্তু পরের দিনই উদ্দীপনার, আশার নতুন বছর। সুতরাং বিমর্ষ থাকার সময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আবার প্রতিজ্ঞা করি বইপড়ার। বিগত ২০ বছরের কথা স্মরণ করতে পারি এমনই চলছে। যারা তিন মাসে এক হাজার বই পড়তে পারেন তাদের ‘খুরে’ দূর থেকে নমস্কার করা ছাড়া আমার আর অন্য কোনাে উপায় নেই।
কোনাে বইয়ের দোকানে গেলে, বইমেলাতে আমার নিজেকে নিয়ে খুব ভয় হয়। সব বই, যা আমার ঘরে নেই তা কিনে নিতে ইচ্ছা করে। বহুবার ফিরে আসার বাস ট্রাম ভাড়া পর্যন্ত ছিল না, এমন ঘটনা ঘটেছে। বই কেনার জন্য অর্থ একটা সমস্যা। তাে বটেই, আমার মনে হয় তার চাইতে বড়ো সমস্যা বই ঠিক মতাে রাখা এবং তার যত্ন নেওয়া। আমার অবস্থা খুব খারাপ। বই রাখার আর জায়গা নেই। বই মেঝেতে রাখা ছাড়া উপায় নেই। তাতে অসুবিধে চলাচলের। যত সহজে বই কেনা যায়,তত সহজে আলমারি তৈরি করা যায় না। আমার অবশ্য অনেকের মতাে অন্যের বই না বলে নিয়ে আসার অভ্যাস নেই। আমার বইও আমি ১/২ জন বাদে কাউকে দিই না।
ক্রমে ক্রমে বই বেড়ে হয়েছে হাজার হাজার।
এখনও সব পড়া হয়নি। মনে মনে ভাবি কোনাে যাদু
বলে যদি সব পড়ে ফেলতে পারতাম তাহলে
মজা হতাে! মাও সে তুঙ বলেছিলেন, বই পড়া
খুব সহজ কাজ। লাইব্রেরির আলমারিতে আছে, হাত দিয়ে পেড়ে, টেবিলে রেখে পড়তে লাগলেই হল। কোনাে প্রতিবাদ করবে না। এটা গরু বা শুয়াের কাটার চাইতে সহজ। এগুলাে কাটতে গেলে গুঁতিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সত্যি কি বই পড়া এত সহজ? মােটেই না। বই ও বিষয় পছন্দের হতে হবে। তবেই তাে তর তর করে এগােবে। কিন্তু পড়াকে বলে কেজো পড়া। মানে কাজের জন্য পড়া। পছন্দ না হলেও, খটমট লাগলেও পড়তে হয়। কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে। পাতার পর পাতা ফাইল পড়ার মতাে।
যে বই পড়েছি তা নিয়ে ২/৪ কথা বলা খুব সহজ। মনে থাকলেই হল। কিন্তু আমি বসেছি যে বই পড়িনি তা নিয়ে লিখতে। এ এক কড়া ব্যাপার। কিন্তু আমার প্রত্যাশা এই বই গুলাে পড়বাে। আমাকে পড়তে হবে। অশিক্ষিত হয়ে মৃত্যু হলে, সে দুর্নাম আমার সইবে না। বহুদিন ধরে নাম শুনেছি উইল ডুরান্টের। সঙ্গে তার স্থায়ী এরিয়েল ডুরান্ট। তাদের লেখা The Story of Civilization, ১১ খন্ড। প্রায় ৪০ বছর ধরে বইগুলাে লিখেছেন। সভ্যতার দর্শনচিন্তা এই আকরগ্রন্থের মধ্যে আছে। আছে বহুকাল ব্যাপী দার্শনিকরা পৃথিবীকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা। পৃথিবীর দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও কর্মকান্ডের বিবরণ। সেই সাথে সভ্যতার এগিয়ে যাবার কথাগুলাে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইংরেজি লিখেছেন। গদ্য লেখা কিন্তু মনে হবে যেন কবিতা। একজন লেখক দায়বদ্ধতা না থাকলে এত পরিশ্রম করতে পারেন না। একটানা লিখে গেছেন তা নয়। মাঝে বিখ্যাত বই লিখেছেন, The History of Philosophy প্লেটো থেকে হেগেল পর্যন্ত দার্শনিকদের চিন্তার বিবরণ। সবই ইউরােপের চিন্তাবিদ। হেগেল পর্যন্ত এসে থেমে গেছেন। বইটি আমার লাইব্রেরিতে ছিল না। লক্ষাধিক টাকা দাম। সংগ্রহ করার সামর্থ্য ছিল না। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। সেটা চোখে দেখেই আমার চিন্তা আরও প্রকট হয়েছে। কি করে পড়বাে? ভারতের সংসদের গ্রন্থাগারে আছে। ব্যস্ততার কারণে সেখানে পড়া হয়নি। হঠাৎ ই আমার এক বন্ধু অস্ট্রেলিয়া থেকে একজনের ব্যবহৃত কপি (যা খুবই সুন্দর অবস্থায় আছে) কিনে এনে আমাকে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আজও পড়তে পারিনি আমি জানি এই বই পড়তে শুরু করলে কম করে একবছর আর
কিছু পড়া যাবে না। এই বই পড়া একটা সাধনার ব্যাপার। আমাকে খারাপ লাগে, আত্মদহনে বিদ্ধ হই, আমি পড়িনি। সময় তাে হয়ে এলাে। আর তাে অপেক্ষা করা উচিৎ নয়। এবার শুরু করা উচিৎ।
‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ (Towards Freedom) আমার প্রিয় বইগুলাের মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশের আধুনিক ইতিহাসের প্রথিতযশা ইতিহাসবেত্তাদের গবেষণার আকরগ্রন্থ। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ
হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাদপ্তরের অধীন স্বয়ংশাসিত একটি সংস্থা। এক সময় দেশের শিক্ষাদপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক নুরুল হাসান। তারই মস্তিষ্ক প্রসূত এই গর্বের সংস্থা। দেশের নামকরা ইতিহাসবিদরা এখানে গবেষণার কাজে যুক্ত। ইরফান হাবিব, আর.এস. শর্মা, সব্যসাচী ভট্টাচার্যর মতাে ব্যক্তিরা এর সভাপতির পদে থেকেছেন। অধ্যাপক সব্যসাচী যখন এই সংস্থার সভাপতি হন, তখনই আমার সাথে এর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ক্রমেই তা গাঢ় হয়েছে। এই সংস্থারই একটা প্রকল্প হলাে ‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ নামে, খন্ডে খন্ডে একটা পর্ব ধরে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা। মুশিরুল হাসান, কে, এম, পানিক্কর, অর্জুন দেব, পার্থপ্রতীম গুপ্ত, নারায়নী গুপ্ত, সুমিত সরকার সহ শত শত ইতিহাসবিদ এইকাজে যুক্ত করেছেন। ভারত কিভাবে স্বাধীন হয়েছে তার বিজ্ঞানসম্মত, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বিবরণ এখানে লেখা আছে। আমার লাইব্রেরিতে আছে ১০ খন্ড। ১৯৩৯ সাল থেকে এই অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিহাস এখন রাজনৈতিক চিন্তাধারার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। সেটাও রাজনৈতিক কারণ। যারা সরকারে ছিলেন তারা ইতিহাস লিখন চাইছিলেন না। কিন্ত অবস্থার পরিবর্তনের পরেই আবার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। দেশ এক অমূল্য সম্পদ প্রাপ্ত হয়। অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের উৎসাহে আমি পুস্তকগুলাে সংগ্রহ করি। কিন্তু আজও পড়া হয়নি। তাতে আমার মর্মবেদনার সীমা নেই। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস জানার ভান্ডার আমার আজও পূর্ণ হয়নি। এই আক্ষেপ বহুকাল বয়ে বেড়াচ্ছি।
মহম্মদ আলি জিন্নাহর জীবনী লিখেছেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি উইলপার্ট। ৩০ বছর সময় নিয়েছেন। তার মুখবন্ধে লিখেছেন তিনি। করাচীর জিন্নাহ, মহাফেজখানায় জিন্নাহর লেখা, ভাষণ ইত্যাদির এবং জিন্নাহর সম্পর্কিত খবরের সর্বমােট ৮০ হাজার পৃষ্ঠা কাগজ পড়েছেন। খবরটা শুনে চমকে উঠি। তবে অধ্যাপিকা আয়েশা জালাল সংবাদটি তার একটি লেখায় সমর্থন করেছেন। জিন্নাহ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমারও বহুদিনের। সংবাদ পেলাম জিন্নাহ পেপারর্স’ প্রকাশিত হয়েছে। তারপর আর কোনাে সংবাদ পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দিল্লির একটা বইঘরে ১৮ খন্ডের এক সেট ‘জিন্নাহ পেপারস’ দেখলাম। তখনই কিনতে চাইলাম। তারা
অপারগ হলেন। কারণ একজনের অর্ডার মাফিক এনেছেন। প্রকাশন অক্সফোর্ড, করাচী। আমাকে অর্ডার দিতে বললেন। যদি জোগাড় করতে
পারেন তাহলে জানিয়ে দেবেন। সময় লাগবে। ১ বছর পর খবর পেলাম। বই এসে গেছে। নিয়ে এলাম। এমন রত্নখনি দেখেও শান্তি। বহু গবেষকের
কাজে লেগেছে তা এখন পর্যন্ত। এখনও নিয়মিত অনুরােধ আসে, চিঠি আসে ব্যবহারের জন্য। চেষ্টা করি সেটা তাদের দিতে। আমিও নেড়েচেড়ে
দেখেছি। একবার একটি প্রবন্ধের কারণে প্রয়ােজন হয়েছিল। রেফারেন্সটা নিখুঁত পাওয়া গিয়েছিল। ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু এখনও অপড়া অধরা
রয়ে গেছে। জিন্নাহ সাহেবের জীবনী লেখার কাজেও হাত দিতে পারিনি। তবে আজ আমাদের দেশের যা অবস্থা তাতে জিন্নাহ পাঠ আরও প্রাসঙ্গিকতা পেয়ে গেছে। তাই যে কোনােদিন এই কাজটা ধরে ফেলবাে বলে মনে হচ্ছে। তখন ‘জিন্নাহ পেপারস’ পড়া যাবে। তাছাড়া আর কোনাে রাস্তা নেই দেখতে পাচ্ছি।
সব বই এর খবরও তাে জানি না। তবে এখনই মনে পড়ছে ‘The Transfer of Power 1942-47’ বইটি ৪০ খন্ডে সমাপ্ত। আমার কাছে মাত্র কয়েক খন্ড
আছে। স্বাধীনতা লাভের আগের বছর গুলােতে যে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন নেতার ভূমিকা এখানে মহাফেজখানা থেকে তুলে আনা। পড়া হয়নি। পড়াবাে অবশ্যই। যারা পড়ে ফেলেছেন তাদের আমি হিংসে করি। এমন কাজটা তারা করে ফেললেন কি করে জানতে বড়াে ইচ্ছে করে। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছিল দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ দি মডার্ন ইসলামিক ওয়ার্ল্ড। বেশ কয়েকবছর আগে এই অমূল্যরতনটি সংগ্রহকরি। অক্সফোর্ড সংস্থা রবি ব্যানার্জি মশাই আমাকে বাতিল বইয়ের বিশাল গােডাউন থেকে এই ৪খন্ড বই জোগাড় করে দেন। তবে একটা বাক্সের
মধ্যে নতুন হয়ে ছিল। এখন আর সহজলভ্য নয়। এটা আসলে ইসলাম সম্পর্কে একটি জ্ঞানভাণ্ডার। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলামর মতাে বিশাল বইটি পড়লেও উল্লেখিত বইটি পড়িনি। সারা পৃথিবীতে ইসলাম সম্পর্কে বই ছাপা হয় প্রচুর। বিক্রিও হয় প্রচুর। মুম্বাই বিমানবন্দরে এক বই বিক্রেতার কাছে ইসলাম সম্পর্কে জানতে
চাইলে তিনি বলেন, তিন কপি ছিল। এ গতকালই বিক্রি হয়ে গেছে। আচ্ছা কি হয়েছে বলুন তাে? বহু মানুষ এই বিষয়ে বই চাইছেন। তার বক্তব্যের উত্তর দেওয়া বাজল। দিইনি। তবে এ কথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, একমাত্র ইসলাম ধর্মই সংখ্যায় বাড়ছে। অন্যরা নয়। তবে এটাও ঠিক পশ্চিম দেশে ত শত লেখক ইসলাম ও হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অসত্য প্রচার করে। সেই সময় এনসাইক্লোপিডিয়া অফ দি মডার্ন ইসলামিক ওয়ার্ল্ড একটি চ্যালেঞ্জ জানাবার মতাে বই। পড়া হয়নি। এ দুঃখ রাখার জায়গা আমার নেই। তবে আমি আশাবাদী। হবে। একদিন হবে।
রবীন্দ্রনাথ নিয়েই বড়াে হয়েছি। এখনও রবীন্দ্রনাথ চলার পথে ধ্রুবতারা। তাঁর জীবনবােধ বহুজনের মতাে আমাকেও অনুপ্রাণিত করে। রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য চিরদিন আমার কাছে জাগরুক থাকবে। কিছু কিছু কবিতা কালজয়ী। তবে উপন্যাসটি একেবারেই নিতে পারিনি। গােরা ছাড়া আর কোনাে উপন্যাস পড়িনি। ইচ্ছা হয়নি। কয়েকটা তাে উপন্যাসের কাছাকাছি যায়নি। তবে প্রায় সমস্ত প্রবন্ধ কালজয়ী। ছােট গল্প অর্ধকের বেশি পড়িনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাকি একবার বিশ্বভারতীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখার একটি সংকলন করতে চান যেগুলাে ভবিষ্যতে মানুষ পড়বে। সুনীল বাবুও মনে করতেন সব পড়া যায়না। তাই এমন প্রস্তাব। শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাননি বলাই বাহুল্য।
অন্নদাশঙ্কর রায়কে একজন প্রশাসক হিসাবে আমরা ভুলেই গেছি। বাংলা সাহিত্যকে তাঁর লেখনী দ্বারা বহুভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। এটুকু বললেই যথেষ্ট হয়না। তিনি বাঙালির বিবেক। সম্প্রীতি রক্ষায় তাঁর
মতামত আমাদের সবসময় পথের নিশানা দিয়েছে। আমার তাঁর সম্পর্কে একটু বাড়তি আবেগ আছে এই কারণে যে, স্বাধীনতার সামান্য আগে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা সমাহর্তা তথা জেলা শাসক ছিলেন। সেই সন্ধিক্ষণে এ জেলার মানুষের জন্য তাঁর ভালােবাসা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। আর এখানেই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন আর
নয়! ঢের হয়েছে। আর সরকারি চাকরি নয়। সাহিত্যের সেবক হয়ে বাকি জীবন কাটাবেন। তাইই করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ‘বিনুর বই পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু ‘ক্রান্তদশী’ আজও পড়িনি। ঋষিপ্রতীম মানুষটা যদি এটা কোনােমতে জানতেন তাহলে বােধ হয় অত্যন্ত কষ্ট পেতেন।
পড়িনি প্রেমার আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’, ‘শীপ্রসাদ বসুর’ ‘সমকালীন বিবেকানন্দ’ পড়া হয়নি। লীলা মজুমদারের ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’ ‘ইমু পাখির পালক পড়ে আমাদের দিন কেটেছে। কিন্তু পাকদন্ডী পড়িনি। লাইব্রেরিতেই আছে। ২/১বার খুলে বসেছি। আবার বন্ধ করেছি। বইটির সম্পর্কে এতাে কথা বলেছেন যে, বইটা খুলে পড়ার সময়ই মনে হয়েছে পড়লেই তাে ফুরিয়ে যাবে। মলাট বন্ধ করে দিয়েছি। জানি না মনােভাবটা ঠিক কি না। তবে পড়া হয়নি, বা পড়তে পারিনি।
কমল কুমার মজুমদারের কথা আমাদের ছাত্রজীবনে খুব আলােচনা করা হতাে। তখনই তাঁর লেখা দুপ্রাপ্য ছিল। তবে ‘আলাে ক্রমে আসিতেছে’ সেই সময় প্রবাদ বাক্যের মতাে ছিল। তাঁর গদ্য একবার পড়ে মর্মন্ধার করা সহজ কাজ ছিল না। তাঁর কৌতুকবােধ, রহস্যময়তা, ঘন ঘন বাড়ি পালটানােতে তাঁকে জীবদ্দশাতেই প্রবাদে পরিণত
করেছিল। বাংলার বেশির ভাগ লেখক শিল্পী
তাঁর কাছে না ঘেষলেও সত্যজিৎ রায়, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ ও শ্রদ্ধা নিয়ে থেকেছেন। চমৎকার কথা বলতেন। কফি হাউসে একবার সবাই আলােচনা করেন যে, মার্কসবাদী দলগুলাে চাষী মজুরের কথা আলােচনা করছে। এ ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে
উত্তর দেন ব্যাঙের একটা ল্যাটিন নাম আছে, ব্যাঙেরা কি সেটা জানে? পরিবারের সবাই স্বনামধন্য। নীরুদ মজুমদার বড় দাদা। শানু লাহিড়ী বােন। তারই বিখ্যাত বই ‘নিম অন্নপূর্ণা’ পড়িনি। যদিও আনন্দ থেকে প্রকাশিত গল্প সংগ্রহ এবং উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর লেখা সহজলভ্য।
প্রেমচন্ত্রের কথা কে না জানে। ‘কফন’ গল্পটা পড়ার পর হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বহুক্ষণ কারাে সাথে কথা বলতে পারিনি। বলা যায়না। পৃথিবী বিখ্যাতিং বই ‘গােদান’। বহুভাষায় অনুদিত। একটা অদ্ভুত ভালােলাগার ঘটনা ঘটে ছিল মনে আছে। কোলকাতা-দিল্লি বিমানে। উচ্চশ্রেণীতে বসে দিল্লি যাচ্ছি। প্রথম সারির জানালার দিকে বসে আছি। পাশে স্যুটটাই পরা মধ্যবয়সী সুবেশ এক ভদ্রলােক। পাশের বন্ধুর সাথে মাঝেমধ্যে কথা বলছেন। বুঝলাম দুজনেই শিল্পপতি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ভদ্রলােক হাতের ছােট ব্যাগ থেকে একটা বই পড়াতে মনােনিবেশ করলেন। উপন্যাস বলেই মনে হলাে। আশ্চর্য হলাম। কোনাে শিল্পপতিকে কোনাে দিন বিমান যাত্রায় উপন্যাস পড়তে দেখিনি। একটু পরে তিনিই পাশের বন্ধুকে বইটিকে দেখিয়ে বলেন, দেশ আজও পাল্টায়নি। দেখলাম বইটি প্রেমচন্দের ‘গােদান’। আশ্চর্য হলাম। মনে মনে এই মহান স্রষ্টাকে প্রণাম জানালাম। তাঁরই আর একটা বিখ্যাত বই ‘রঙ্গভূমি’ পড়িনি।
কবিতা পড়ি অনেক। ছােটবেলায় ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ দিয়ে আমারও শুরু করেছি। জয় গােস্বামীর ‘পাগলী তােমার সঙ্গে’ পড়িনি। পড়িনি ‘বজ্রবিদ্যুত ভর্তি খাতা’। রুদ্র মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ দারুণ কবি। প্রচুর লিখেছেন। তাঁর কোনাে লেখা পড়িনি। তবে কয়েকটি কবিতা গান হয়েছে। ভালােই মনে হয়েছে। রুদ্রর রচনা কিনতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। কেনা হয়নি। পড়বাে। অতিশীঘ্র পড়বাে বলে আশা করছি।
অরুন কুমার সরকারের লেখা আমার ভালাে লাগে। কিন্তু উৎপল কুমার বসুর কবিতা পড়িনি। এই সময়ে অরিন্দম চক্রবর্তীর নাম বহুজন জানেন। বিদেশে বেশির ভাগ থাকলেও এখানে মাঝে মাঝে আসেন। বড় দার্শনিক। অত্যন্ত গুনীজন। কষ্ট করে তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ পড়েই তা বুঝেছি। তবে ভাষাটাকে আমার একেবারেই অচেনা মনে হয়। সেই কারণে আমার আশে পাশের অনেকে মুগ্ধ হলেও ‘মননের মধু’ এখনাে পড়ে উঠতে পারিনি। সুনন্দা শিকদার দিদিকে আমার দারুণ লাগে। তার দয়াময়ীর সংসার’প্রায় একনিঃশ্বসে পড়ে ফেলেছিলাম। আসলে দু’বাংলার ভাগাভাগিটাকে সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখতে চাই। সে জন্য মলয় ধর বাবুর ‘ট্রেন টু ইন্ডিয়া’ পড়ে মুগ্ধ হই। কিন্তু মিহির সেনগুপ্তের ‘বিপদবৃক্ষ’ পড়া হয়নি। শক্তি সাধন মুখােপাধ্যায় এই সময়ে সােশ্যাল মিডিয়ায় প্রচন্ড তৎপর। দীর্ঘদিন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। ডিরােজিও নিয়ে তার গবেষণা অতুলনীয়। তবে মুক্ত কণ্ঠে বলি বাংলার রেনেসাঁ ও ডিরােজিও সম্পর্কিত বইগুলাে পড়িনি। তবে বুঝতে পারছি তাড়াতাড়ি তা পড়ে ফেলতে হবে। লােকে জানলে, আর কিছু নয় অশিক্ষিত বলবে।
সব বই কি পড়া সম্ভব? মােটেই নয়। তবু আমার মনে হয় পড়ি। সেই জন্য প্রতিজ্ঞা করি সারাবছরে ক’টা বই পড়বাে। বহুদিন পড়িনি শঙ্খ বাবুর ‘ছেড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’। এবার বছর শেষে যখন পড়ে ফেললাম তখন নিজেকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আর কোনাে রাস্তা থাকলাে না। আমি এতাে আহাম্মক। এতােদিন কেন পড়িনি! এমন বহুবার বহুক্ষেত্রে হয়েছে। সুতরাং বই পড়ার চাইতে বই না পড়ার খেদ অনেক বেশি। কেবলই মনে হয় কতক হীরক খন্ড ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায় আমি এক দুরাত্মা তার সন্ধান পেলাম না। অথচ সবকিছু অনুকূলে ছিল। বই পড়বাে, লিখবাে, লাইব্রেরি করবাে এসব ভেবেই যায়নি কোনাে বাঁধাধরা কাজে। আমার শর্তে আমি বাঁচবাে এটাই চিরদিনের ইচ্ছা। তাহলে এতাে ফাঁক কেন?
বাংলায় যারা নমস্য লেখক। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র আমাদের রক্তে মিশে আছেন। হিসাব করে দেখছি শরৎচন্দ্রের অবস্থা ভালাে। প্রায় সব গুলােই পড়েছি। অন্যান্যদের বিশাল সৃষ্টি তার একচতুর্থাংশও পড়া হয়নি।
তালিকা করা মানে নিজেকে আরও ছােট করা। সবাই বুঝে ফেলবে আমি প্রায় একটা ‘আনপড়’ মানুষ। নিজে যেচে আর কে এই দুর্নাম নিতে চায়। সুতরাং লেখাটার ইতি টানছি। প্রতিজ্ঞা করছি আরও বই পড়বাে। যা মানুষের একমাত্র অবলম্বন। যে কাজটি করা খুব সহজ।
—– সমাপ্ত—-