Islam

মসজিদে নারীদের প্রবেশঃ কিছু ভাবনা (পর্ব -১)

192views

◆ইসলামের সােনালী যুগে মসজিদে নারীদের অবাধ

যাতায়াতের সুযােগ ছিল। মহানবীর (সা.) ইমামতিতে
মসজিদে নববীতে নারীপুরুষ মিলে একই ফ্লোরে নামাজ আদায় করতেন। অথচ, উপমহাদেশে হাতেগােনা ব্যতিক্রম বাদে মসজিদগুলােতে নারীদের কোনও আনাগােনা নেই। যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হল মসজিদ। মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার, অবস্থান ও কার্যক্রম ইত্যাদি নিয়ে ড.জাসের আওদা ‘Reclaiming the Mosque: The Role of
Women in Islam’s House of Worship’ শিরােনামে একটি বই লিখেছেন।◆

[মূল: জাসের আওদা, অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ]

মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গে কুরআনের বক্তব্য কী?
আল কুরআনে মসজিদ সম্পর্কিত কয়েক ডজন আয়াত আছে। সব আয়াতেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে ঈমানদারদেরকে নিয়মিত মসজিদে যাওয়ার আহ্বান জানানাে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কিছু আয়াত তুলে ধরা হল “হে মুহাম্মদ! আপনি বলে দিন, ‘আমার প্রতিপালক ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। তােমরা প্রতিটি মসজিদে নিবিষ্ট মনে ইবাদত করবে এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁকে ডাকবে।” (সূরা আরাফ-২৯)। “হে বনী আদম! তােমরা প্রত্যেক (নামাযের সময়) মসজিদে যাওয়ার আগে সাজসজ্জা করে নাও।”(সূরা আরাফ-৩১)। “আল্লাহর ঘর মসজিদ তাে তারাই আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান আনে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, আর আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, এরা হেদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা তওবা-১৮)।
“মসজিদসমূহ আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য। অতএব, তােমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।” (সূরা জ্বিন-১৮)।

এছাড়াও মক্কায় অবস্থিত মসজিদে হারামের কথা আল্লাহতায়ালা কুরআনের অনেক আয়াতে বলেছেন। একে ‘আল্লাহর ঘর’ ও ‘পবিত্র ঘর
হিসেবে উল্লেখ করে তিনি নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকে তাঁর ঘরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। জেরুসালেমে অবস্থিত বাইতুল আকসাকেও আল্লাহ
তায়ালা পবিত্র মসজিদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নিচে এ সম্পর্কিত কিছু আয়াত তুলে ধরা হল।  “স্মরণ করাে, যখন আমি ইব্রাহীমকে পবিত্র ঘরের স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম। এবং বলেছিলাম, আমার সাথে কাউকে শরীক করাে না; তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাজেদণ্ডায়মানদের জন্যে এবংরুকু-সেজদাকারীদের জন্যে আমার গৃহকে পবিত্র রাখাে।” (সূরা হজ-২৬)। “তিনি পরম পবিত্র সত্তা, যিনি তাঁর স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন।” (সূরা বনী ইসরাইল-১)। “পবিত্র ঘর কাবাকে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্যে আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন।”(সূরা মায়েদা- ৯৭)। “মক্কায় অবস্থিত ঘরটিই ইবাদতের উদ্দেশ্যে মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিল। এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য বরকতময় ও সত্যের দিশারী।” (সুরা
আলে ইমরান-৯৬)।

এখানে একটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, অধিকাংশ ইংরেজি অনুবাদক উপরে উল্লেখিত শেষ দুটি আয়াত ভুলভাবে অনুবাদ করেছেন। মসজিদের অধিবাসী বা দর্শনার্থী বুঝতে আরবিতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার ইংরেজি করা হয়েছে men (পুরুষ) বা mankind (পুরুষজাতি)। উদাহরণ হিসেবে উপরে উল্লেখিত সূরা আলে ইমরানের ৯৬নং আয়াতটি দেখুন। আয়াতটিতে মসজিদে আগমনকারীদের বুঝতে নাস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কথ্য ও প্রমিত উভয় ধরনের আরবিতেই নাস’ শব্দটি দ্বারা মানুষ বুঝানাে হয়। অথচ মােহাম্মদ আসাদ, সহীহ ইন্টারন্যাশনাল, পিকথল, ইউসুফ আলী, শারি, মােহাম্মদ সারওয়ার, মহসিন খানসহ প্রায় সকল অনুবাদকই নাস’শব্দের অর্থ
করেছেন ‘পুরুষ’ বা ‘পুরুষজাতি। আমার জানা মতে, শুধু আরবেরি হলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি এই আয়াতে নাস’শব্দের অর্থ করেছেন মানুষ। মজার ব্যাপার হল, সূরা মায়েদার ৯৭ নং আয়াত অনুবাদতে গিয়ে তিনিও ‘নাস’ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘পুরুষ। এ থেকে বুঝা যায়, মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার ইস্যুতেকুরআনের অনুবাদকও মুফাসসিরগণ নিজেদের পূর্বানুমান
ও পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত।

অন্যদিকে, কুরআনের দুটি আয়াতে ঈমানদারদেরকে মসজিদে আসার আহ্বান জানিয়ে ‘রিজাল’শব্দটি দ্বারা সম্বােধন করা হয়েছে- “আল্লাহ যেসব মসজিদকে সমুন্নত করতে এবং সেগুলােতে তাঁর নাম স্মরন করার আদেশ দিয়েছেন, সেসব ঘরে সকালসন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘােষণা করে এমন ব্যক্তিরা (রিজাল), যাদেরকে আল্লাহর স্মরণ, নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় করা থেকে ব্যবসাবাণিজ্য বা ক্রয়বিক্রয়ের কর্মযজ্ঞ বিরত
রাখতে পারে না।”(সূরা নূর- ৩৬-৩৭)। যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই তাকওয়ার উপর স্থাপিত, (নামাজের জন্য) সেখানে দাঁড়ানােই তােমার জন্য অধিক উপযােগী। সেখানে এমনসব ব্যক্তি (রিজাল)রয়েছে, যারা পবিত্র থাকতে ভালােবাসে। আর যারা পবিত্র থাকে, আল্লাহ তাদেরকে ভালােবাসেন।”(সূরা তওবা-১০৮)। কোনাে কোনাে অনুবাদক বা মুফাসসির আরবি ‘রিজাল’ শব্দটির ব্যাপারে ভুল বুঝেছেন। তারা এর অর্থ করেছেন ‘পুরুষ’ (men)। ফলে নারীরা এখানে বাদ পড়েছে। আমি এর অর্থ করেছি ব্যক্তি’(person)। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ইংরেজি ভাষায় আমি কুরআনের যতগুলাে অনুবাদ দেখেছি, সবগুলােতে
‘রিজাল’ শব্দের অর্থ পুরুষ’ ধরে নেয়া হয়েছে। শুধু মােহাম্মদ সরওয়ারের অনুবাদটা ব্যতিক্রম। তিনি রিজাল’ শব্দের অর্থ করেছেন ব্যক্তি। রিজাল’ শব্দটির এই প্রচলিত, অথচ ভুল অনুবাদ বা ব্যাখ্যার কারণে মুসলমানদের চিন্তায় সামগ্রিকভাবে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে
মুসলমানরা এখন মনে করে, মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার কুরআন দ্বারা সমর্থিত নয়। উপরে উল্লেখিত সূরা নূরের আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘রিজাল’ শব্দটির ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ মুফাসসির ইবনে কাসীর (মৃত্যু ৭৭৪ হি. ১৩৭৩ খ্রি.) বলেছেন, বাড়িতে নামাজ আদায়করাই নারীদের জন্য উত্তম। তবে পুরুষদের নামাজের জামায়াতে নারীদেরও অংশগ্রহণের অনুমােদন রয়েছে। এক্ষেত্রে শর্ত হল,
সাজসজ্জার প্রদর্শন ও পারফিউম ব্যবহারের মাধ্যমে নারীরা কোনাে পুরুষের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।

এটি ঠিক, কথ্য আরবিতে ‘রিজাল’ শব্দটি দ্বারা নারী নয়, বরং পুরুষকে বুঝানাে হয়। কিন্তু কুরআনের মতাে উচ্চমার্গীয় আরবিতে ‘রিজাল’শব্দটি দ্বারা
নারীপুরুষ উভয়কে বােঝানাে হয়েছে। এর প্রমাণ কুরআনেরই অনেক আয়াতে রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আরাফবাসীরা যেসব জাহান্নামী ব্যক্তিকে (রিজাল) তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনতে
পারবে তাদেরকে ডেকে বলবে, তােমাদের দলবল ও গর্বঅহংকার তােমাদের কোনাে কাজে আসলাে না।” (সূরা আরাফ ৪৮)। “মুমিনদের মধ্যে কিছুব্যক্তি (রিজাল) আল্লাহর সাথে করা ওয়াদা পূর্ণকরেছে।”
(সূরা আহযাব ২৩)। এই দুটি আয়াতসহ কুরআনের অন্যান্য আয়াতে ‘রিজাল’শব্দটি দ্বারা স্পষ্টত
নারীপুরুষ উভয়কেই বুঝানাে হয়েছে। এ বিষয়ে কোনাে স্কলারই কখনাে ভিন্নমত পােষণ করেননি।
এছাড়া ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে কথা হল, কুরআনের যে আয়াতে ‘রিজাল’ শব্দটি দ্বারা শুধু পুরুষদেরকে বুঝানাে হয়, সেই একই আয়াতে ‘নিসা (নারী) শব্দটিও ব্যবহার করা হয়। একমাত্র এ ধরনের বাক্যেই ‘রিজাল’ দ্বারা শুধু পুরুষ। এবং ‘নিসা’ দ্বারা নারীকে বুঝানাে হয়। যেমন, আল্লাহ বলেছেন “যদি (মক্কায়) কিছুসংখ্যক ঈমানদার পুরুষ
(রিজাল) ও ঈমানদার নারী (নিসা) না থাকত,
যাদের ব্যাপারে তােমরা জানাে না।”(সুরা ফাতাহ)।

 

আরবি ভাষায় খুব ভালাে দক্ষতা না থাকলে
সঠিকভাবে কুরআন বুঝা অসম্ভব। আর কুরআন
নিজেই হল আরবি ভাষার জন্যে সবচেয়ে ভালাে
রেফারেন্স।তাই আরবি পরিভাষাগুলাের প্রচলিত
অর্থকে কুরআনের অর্থ অনুযায়ী পরিবর্তন করে
নেওয়া উচিত। কুরআনের দলীলপ্রমাণের বাইরে আরবি অভিধানগুলােও ‘রিজাল’ শব্দ দ্বারা নারীকে
বােঝানাে সমর্থন করে। উদাহরণ হিসেবে ক্লাসিক
আরবি অভিধান ‘মুখতার আসসিহাহ’ গ্রন্থের কথা বলা যায়। এই অভিধানে (এটি রিজাল পরিভাষার শব্দমূল) এন্ট্রিতে বলা হয়েছে, ‘নিসওয়াতুন রিজাল’ (এখানে রিজাল শব্দটি নারীদের বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে) এবং একজন নারীকে ‘রাজুলাহ’ (এটি রিজাল শব্দের একবচন ও নারীবাচক শব্দ) বলা যেতে পারে। এছাড়া আয়েশা (রা) তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘রাজুলাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে বর্ণিত আছে। আরেকটি ক্লাসিক আরবিআরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ এই বিষয়ে উল্লেখা হয়েছে, আবু জায়েদ আল কিলাবী ও তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে, দুইজন ‘রিজাল’ তর্ক করছে। এখানে ‘রিজাল’দ্বারা তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে বুঝানাে হয়েছে।

সর্বশেষ কথা হল, কাউকে মসজিদে আসতে
বাধা দেওয়ার ব্যাপারে কুরআন সুস্পষ্টভাবে
নিষেধ করে দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, তারচেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে। ব্যক্তি আল্লাহর (ঘর) মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং ধ্বংসকার চেষ্টা করে? এ ধরনের লােকদের তাে তাতে প্রবেশ করাই সমীচীন নয়, তবে একান্ত ভীত সন্ত্রস্তভাবে (ঢুকলে তা ভিন্ন কথা)। তাদের জন্য পৃথিবীতে যেমন রয়েছে লাঞ্ছনা, তেমনি পরকালে রয়েছে কঠিনতম শাস্তি।” (সূরা বাকারা ১১৪)।

ক্রমশ চলবে….

Leave a Response