featuredHistory

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: অপরাধের শত বছর

isr-plstn-thumb
127views

আবারও সংঘাতে জড়ালো ফিলিস্তিন-ইসরাইল। আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। বরাবরের মতো সামনে চলে এসেছে নিজভূমি হারানো ফিলিস্তিনিদের ট্র্যাজিডি। কীভাবে ইসরাইল সৃষ্টি হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সেখানে কী প্রভাব পড়ল, ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপ কীভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দিল—সব কিছু মিলিয়ে গোটা পরিস্থিতিকে পর্যালোচনামূলক ইতিহাস আকারে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আসজাদুল কিবরিয়ার লেখাতে।

 

মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ণ করতে পারে।

আজ থেকে শতবর্ষ আগে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর এই ছোট্ট পত্রটি লিখেছিলেন জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে। এটি কালক্রমে বালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি জায়নবাদ নামক উগ্র ইহুদিবাদ বা ইহুদি জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেন, যা এক মহা বিপর্যয়ের দ্বার খুলে দেয়। বালফোর অবশ্য জেনে- বুঝেই কাজটি করেছিলেন। আর বছরটি ছিল ১৮৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করা বিশ্ব জায়নবাদী সংস্থার (ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন) ২০তম বছর। জায়নবাদীরা বাইবেলকে আশ্রয় করে সুনিপুণভাবে এক কল্পকাহিনি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দীর্ঘমেয়াদি এক প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছিল। বালফোরও জানতেন, যুগের পর যুগ ধরে নিজ ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের বিতাড়িত করে ধর্মগ্রন্থভিত্তিক কল্প-কাহিনি আশ্রিত এক মিথ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা অপরাধ। বালফোর অপরাধটি করেছিলেন। এ জন্য তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের কোনো পরিতাপ ছিল না।

বালফোর ঘোষণার তাৎপর্য বেড়ে যায় এ জন্য যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ ম্যানডেটরি প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে, যা চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। এটি ছিল জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের ভূখণ্ডে, যেখানে আজকের ইসরাইল অবস্থিত।

ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই সেখানকার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি আরব অধিবাসীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দমননীতি শুরু করে। দীর্ঘ মেয়াদে ইহুদিদের জন্য ঈশ্বর ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (প্রমিজড ল্যান্ড) তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ইহুদি সেটেলারদের বিভিন্নভাবে অগ্রাধিকার সুবিধা দিতে থাকে। দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদেই অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালেই গঠন করা হয় হাগানাহ নামের আধা সামরিক বাহিনী। এরপর আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং গড়ে ওঠে পরে। ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসবাদী বলে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ওপর ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিচ্ছে, অথচ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং একীভূত হয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।

বালফোর ঘোষণার ২০ বছর পর বা ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগকৃত পিল কমিশন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ছোট ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করে সেখানকার আরবদের পূর্বে ট্রান্স জর্ডান ও পশ্চিমে মিসরসংলগ্ন বৃহত্তর অংশে স্থানান্তরের এবং জেরুজালেম ও বেথলেহেমকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ছিটমহল হিসেবে রাখার প্রস্তাব দেয়। আরবেরা এটি প্রত্যাখ্যান করলেও জায়নবাদী নেতারা এতে সমর্থন দেন। কেননা পিল কমিশন অন্যায়ভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। ১৯৩৯-৪৫ কালপর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল আর জার্মানিতে হিটলারের চরম ইহুদিবিদ্বেষ জায়নবাদীদের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদিকে নিধন করা হয়, যা ইতিহাসে হলোকাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। যুদ্ধ শেষে এই হলোকাস্টই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি স্থাপনের সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব বেমালুম এটা ভুলে যায় যে ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, অথচ ক্ষতিপূরণের জন্য মূল্য গুনতে হচ্ছে আরবদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে কফিনের শেষ পেরেকটি বুঝি পুঁতে দেওয়া হয়।

এদিকে জায়নবাদীরা নিজ ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কেটে ফেলে। প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বেন গুরিয়ান ১৯০৬ সালে অটোমান ফিলিস্তিনে অভিবাসী হয়ে আসেন এবং কট্টর জায়নবাদী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশদের শাসনাধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, যাতে নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত আরবেরা সুরক্ষা না পায়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যানডেট বা শাসন শেষ হলে বেন গুরিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে একে স্বীকৃতি দেন। আর আল নাকবা বা মহাবিপর্যয় নেমে আসে ফিলিস্তিনিদের ওপর। নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় রাতারাতি লাখ লাখ ফিলিস্তিনি প্রাণ রক্ষায় ছুটে পালাতে থাকে। তাই ১৫ মে আল নাকবা (বিপর্যয়) দিবস বিবেচিত হয়।

যদিও নাকবা আসলে আগে থেকেই শুরু হয়। মূলত মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত সাত লাখ ফিলিস্তিনি আশপাশের আরব দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুসারে তাদের নিজ ভূমে ফেরার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, যদিও এর মধ্যে কয়েক প্রজন্ম চলে গেছে। বরং যারা রয়ে গিয়েছিল, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইসরায়েলি দখলদারি ও সন্ত্রাসের মধ্যে জীবনযাপন করছে। আরব দেশগুলো অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। তবে ইউরোপ থেকে পাওয়া আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলি বাহিনীকে তারা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি। জর্ডানের সেনাবাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও বেন গুরিয়ানের সঙ্গে বাদশাহ আবদুল্লাহর গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে তারা এক প্রকার নিষ্ক্রিয় ছিল। সিরীয়, মিসরীয় ও লেবাননের বাহিনীগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল না। একমাত্র ইরাকি বাহিনী কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিল। আর এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলি দখলদারি আরও পোক্ত হয় গোলান উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে। আর তা সম্ভব হয় সে বছর আরবদের আরেক দফা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। জায়নবাদী ভাষ্যে অবশ্য এই অধিগ্রহণ হল ‘জুদিয়া, সামারিয়া ও গোলান উপত্যকার মুক্তি। ‘ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জায়নবাদীরা যে পাপের সূচনা ঘটিয়েছে, তা একাধারে অপরাধ ও দখলদারির মধ্য দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিস্তৃত হয়ে আসছে। এ জন্য ৭৫ বছর ধরে জায়নবাদীরা প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি শুধু ঘটায়নি, বরং বাছাই করা সত্য ও সযত্নে তৈরি মিথ্যার সুদক্ষ মিশেলে নিজেদের অপকর্মের বৈধতার জন্য বিভ্রান্তিকর ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

আশার কথা হলো, খোদ ইসরায়েলের ভেতর থেকেই এর প্রতিবাদ ও পাল্টা ভাষ্য উঠে আসছে, প্রকৃত ইতিহাস

ও তার নির্মোহ বিশ্লেষণ করছেন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরাই। এই দলে আছেন বেনি মরিস, শলমো স্যান্ড, ইলান পেপে, অভি শ্লিম, ইয়ায়েল লোটান, ইউরি আভনেরিসহ

অনেকেই। জায়নবাদীদের তীব্র সমালোচনা ও অশালীন আক্রমণ তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারেনি, ইসরাইল রাষ্ট্রের

দমননীতি তাঁদের টলাতে পারেনি। বরং তাঁরা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন নিয়ে বৈশ্বিক নিয়মনীতি অবজ্ঞা করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে উদ্বাস্তু বানিয়ে এবং নিজ ভূমে তাদের অবরুদ্ধ করে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা পূরণ না করেও (সুনির্দিষ্ট ভূ-সীমা) ইসরাইল প্রচণ্ড প্রতাপের সঙ্গে টিকে আছে। প্রযুক্তি

ও বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষ ইসরায়েলের বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়া জোরদার করেছে। সামরিক শক্তিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ এই দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রসহ বিশাল অত্যাধুনিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তুলেছে। তবে এত কিছুর পরও জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল শান্তিতে নেই।

নিঃশর্তে নিজ ভূমে ফিলিস্তিনিদের ফিরতে না দিলে, দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের জমি-পানি-সম্পদ ফিরিয়ে না দিলে এবং জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের জন্য ক্ষমা না চাইলে আর যা-ই হোক, শান্তি আসবে না। অবসান হবে না ফিলিস্তিনি নাকবার।

আসজাদুল কিবরিয়ালেখক ও সাংবাদিক

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে যুবপ্রত্যাশা ২০২৩ নভেম্বর সংখ্যায়

Leave a Response