Backlink hizmetleri hakkında bilgi al
Hacklink satın almak için buraya tıklayın
Hacklink satışı için buraya göz atın
Hacklink paneline erişim sağla
Edu-Gov Hacklink ile SEO'nuzu geliştirin

Backlink
Backlink hizmeti al

Hacklink
Hacklink hizmetleri hakkında bilgi al

Hacklink Al
SEO dostu hacklink satın al

Hacklink Satışı
Hacklink satışı ve hizmetleri

Hacklink Satın Al
SEO için hacklink satın al

Hacklink Panel
SEO hacklink paneli

Edu-Gov Hacklink
Etkili EDU-GOV hacklink satın al

For more information and tools on web security, visit DeepShells.com.tr.

To get detailed information about shell tools, visit DeepShells.com.tr.

To learn more about Php Shell security measures, check out this article.

For the best Php Shell usage guide, click on our guide.

If you want to learn about Aspx Shell usage to secure web applications, click here.

What is Aspx Shell and how to use it? Check out our Aspx Shell guide: Detailed information about Aspx Shell.

For detailed information about Asp Shell security tools in web applications, you can check out this article.

Discover the best Asp Shell usage guide for developers: Asp Shell usage.

History

মওদূদি ও মাদানিঃ উপমহাদেশের দুই মনীষী, দেশভাগ ও স্বাধীনতা – তুহিন খান

400views

‘বর্তমানে পাকিস্তান আন্দোলন খুবই রমরমা। ‘পাকিস্তান’র অর্থ যদি হয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলায় ইসলামের বিধান ও রসুলের তরিকা মোতাবেক–হুদুদ, কিসাস এবং অন্যান্য ইসলামি আইনের ভিত্তিতে–একটা ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন, তাহলে এইটা খুবই মহান কাজ, এর ব্যাপারে মুসলমানদের কোন অভিযোগ থাকা উচিত না। কিন্তু সত্য এই যে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে, এইরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা চিন্তাও করা যায় না।’ –মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি [১]

১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের ‘লাহোর প্রস্তাব’ ঘোষণার বরাবর দুই বছর আগে, ১৯৩৮ সালে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি (১৮৭৯-১৯৫৭) ও আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮)-্এ মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং ডিবেটের ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। এই ডিবেটের সূত্রেই মাওলানা মাদানি ১৯৩৮ সালে তার সম্ভবত শেষ বই, ‘মুত্তাহিদা কওমিয়া আওর ইসলাম’ (জাতীয় ঐক্য ও ইসলাম) রচনা করেন। এই বইয়ে মাওলানা মাদানি তার পাকিস্তান-বিরোধিতার মূলসূত্র ‘কওমিয়াত’ বা ‘জাতীয় ঐক্য’র বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাজির করেন।

১৯৩৮-এর ৮ জানুয়ারি, দিল্লির সদর বাজারের এক ইসলামি জলসায় মাওলানা মাদানি বক্তব্য দেন। পরদিন দিল্লিভিত্তিক ‘দৈনিক তেজ’ ও ‘আনসারি’-তে তার অংশবিশেষ ছাপা হয়। ‘দৈনিক আল আমান’ পত্রিকার এক রিপোর্টারও সেই মজলিসে হাজির ছিলেন। ‘দৈনিক আল আমান’-এর সম্পাদক, দেওবন্দের সাবেক ছাত্র মাওলানা মাজহারুদ্দিন শেরকুটি মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন। ‘আল আমান’-এও মাওলানা মাদানির বক্তব্য পরদিন ছাপা হয়, ‘আল আমান’র সূত্রে লাহোরভিত্তিক ‘ইনকিলাব’ ও ‘জামিনদার’ পত্রিকায়ও এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এই নিউজগুলোতে বলা হইল, মাদানি বলেছেন, ‘মিল্লাত’ মানে হইল ‘জাতিরাষ্ট্র’। তাই মুসলমানদেরও এই পথই ধরা উচিত। [২] যদিও মাওলানা মাদানি এই কথা বলেন নাই।

আল্লামা ইকবাল লাহোর বইসা এইসব পড়ে মাওলানা মাদানির উপর ব্যাপক গোস্বা হন। একদা ‘সারে জাহাঁ ছে আচ্ছা’ লেখা ইকবাল ততদিনে ঘোষণা দিয়া দিছেন– ‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দোস্তাঁ হামারা, মুসলিম হি হাম ওয়াতান হ্যায়, সারা জাহাঁ হামারা!’ মাদানির চিন্তাধারায় ক্ষুব্ধ ইকবাল মাওলানারে ব্যঙ্গ করে তিনটা কাপলেট লেখলেন ফার্সিতে। সেই ফার্সি বয়েতে ইকবাল বললেন,

‘অনারবিরা এখনো দ্বীনের ভেদই বোঝে নাই! নতুবা কী আশ্চর্য যে, দেওবন্দের হুসাইন আহমদ মেম্বরে বসে বলে
জাতির গঠন হয় ভৌগলিক সীমানার মাধ্যমে!
মুহাম্মদে আরাবির অবস্থান সম্পর্কে কী অজ্ঞ এই লোক।
নিজেরে তাঁর পর্যন্ত পৌঁছাও। এইটাই দ্বীন। এছাড়া সব আবু লাহাবি।’

ইকবালের এই কবিতা ‘দৈনিক এহসান’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সাথেসাথেই হৈচৈ শুরু হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মীরা মাওলানা মাদানির বিরুদ্ধে সরব হন, মাওলানা মাদানির ভক্তরাও কম যান না। আজমগড়ের কবি ইকবাল ছুহাইল আল্লামা ইকবালের কাপলেটেরই ছন্দ ও মাত্রায় আরেকটা দীর্ঘ কবিতা লেইখা ইকবালরে বেশ নেস্তনাবুদ করার চেষ্টা করেন। [৩]

এই হৈচৈ-এর মধ্যেই হয়ত তর্কটা শেষ হইতো। কিন্তু মাওলানা তালুত (আসল নাম আব্দুর রশিদ নাসিম) নামধারী জনৈক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় এই তর্ক একটা মিউচুয়াল দশায় উপনীত হয়। মাওলানা তালুত মাওলানা মাদানির কাছে পত্র লিখে সকল ঘটনা সবিস্তারে জানান, এবং মাওলানা মাদানি তার চিঠির জবাব দেন। সেই জবাবের কিছু অংশ মাওলানা তালুত আল্লামা ইকবালের কাছে পাঠান। আল্লামা ইকবাল সেই চিঠির অংশবিশেষ দেখার পরে মওলানার ব্যাপারে তার ব্যঙ্গ-কাপলেট উইথড্র করেন। [৪] এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটেই, ১৯৩৮ সালে ‘জাতীয় ঐক্য ও ইসলাম’ বইটা লেখা হয়, যা এখনও জাতিপ্রশ্নে, ধর্ম ও জাতির পার্থক্য ও মীমাংসাপ্রশ্নে মাওলানা মাদানির মূল টেক্সট হিশাবে অমর হইয়া আছে।

অমরত্ব অবশ্য ইকবালের কাপলেটগুলিও পাইছে। যদিও আল্লামা ইকবাল মাদানির ব্যাপারে তার ব্যঙ্গ-কাপলেট উইথড্র করছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে চিন্তার কোন সাযুজ্য কি আদৌ তৈরি হইছিলো? মাওলানা মাদানি আজন্ম অখণ্ড ভারতের কথা বলেছেন। আল্লামা ইকবালও ‘পাকিস্তান’ দাবি থেকে সরেন নাই। সম্ভবত এই ঘটনার ন্যাচারাল আয়রনি হিশাবেই, ইকবালের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত বই ‘আরমুগানে হেজায’-এ এই কবিতাটি সম্পাদক রাইখা দিছেন, যা অদ্যবধি বিদ্যমান। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এই বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাওলানা মাদানির মত দেওবন্দপড়ুয়া, মদিনায় ১৫ বছর হাদিসের শিক্ষা দেওয়া আলেম কেন মুসলিম লীগের বিরোধিতা করছিলেন? এমন না যে, মাওলানা মাদানি গ্লোবাল সিটিজেন ছিলেন না, ‘মুসলিম উম্মাহ’ ধারণার সাথে তার পরিচয় ছিল না। বরং আরব বিশ্বের সাথে মাদানির সম্পর্ক, যোগাযোগ ও হৃদ্যতা ছিলো খুবই গাঢ়। তাইলে কেন আল্লামা ইকবালের সাথে মাওলানা মাদানির ‘কওম’ ও ‘মিল্লাত’র বোঝাপড়ায় ফারাক তৈরি হলো? কেন মাওলানা মাদানি পাকিস্তান চাইলেন না?

অবশ্য ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণা লালন এবং পাকিস্তান-বিরোধিতার যাবতীয় দায় কেবল মাওলানা মাদানিরে দিলে ইতিহাস কিছুটা গোস্বা করে। মাওলানা মাদানিই একমাত্র ব্যক্তি না, বা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দই একমাত্র মুসলিম দল না, যারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিলেন। বরং, ইতিহাসের দিকে তাকাইলে দেখা যায় যে, ১৯৪৬-৪৭’র নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের আগ পর্যন্ত, মুসলিম লীগরে কেউই ভারতীয় মুসলমানের একমাত্র রিপ্রেজেন্টেটিভ ভাবতে পারেন নাই। পারার কথাও না। ১৯২৯ সালে সিন্ধের চিফ মিনিস্টার আল্লাহ বখশ সুমরুর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান-প্রস্তাববিরোধী ‘আযাদ মুসলিম কনফারেন্স’-এ জমিয়ত ওলামায়ে হিন্দ ছাড়াও, শাহ আতাউল্লাহ বুখারির মজলিসে আহরার, অল ইণ্ডিয়া মোমিন কনফারেন্স, অল ইণ্ডিয়া শিয়া পলিটিকাল কনফারেন্স, খুদায়ে খেদমতগার, অল ইণ্ডিয়া মুসলিম মজলিস, জমিয়তে আহলে হাদিস, এমনকি শেরে বাংলার কৃষক-প্রজা পার্টিও ছিল।[৫] ১৯৪০-এর মার্চে, লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার পরেপরেই, দিল্লীতে ‘আযাদ মুসলিম কনফারেন্স’-এর এক বিশাল সমাবেশ হয়, যেখানে শেরে বাংলার ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’-র প্রতিনিধিও অংশগ্রহণ করে, যদিও মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন কইরা তখন শেরে বাংলার কৃষক-প্রজা পার্টি বাঙলার মসনদে আসীন।[৬] এছাড়াও, জামাতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদিও, আযাদ মুসলিম কনফারেন্সের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জায়গায় দাঁড়ায়ে, ‘মুসলিম উম্মাহ’ ধারণার সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের বিরোধিতা করেন।[৭] এদের পাশ কাটায়ে ভারতে মুসলিম লীগ বা জিন্নাহ কীভাবে মুসলমানদের ‘একমাত্র কণ্ঠস্বর’ হইয়া উঠলেন? এইটা বোঝার জন্য প্রথমে বুঝতে হবে, ভারতে ‘ন্যাশনালিজম’ কীভাবে ‘কম্যুনাল’ হইলো।

২.

‘(ইণ্ডিয়ায় মুসলমানরা) একই সাইজের দুইটা আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত। একটা হইলো ইণ্ডিয়া, আরেকটা হইল মুসলিম বিশ্ব।
–মুহাম্মদ আলি জাওহার [৮]

আধুনিক পশ্চিমে ‘ন্যাশন’, ‘স্টেট’, ‘ন্যাশন স্টেট’ ধারণাগুলির উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপ ও বৃটেনের কলোনিগুলারে প্রভাবিত করছিলো। পুরা আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের পয়লা কয়েক দশকেও এই শব্দ ও এর মর্ম নিয়া খোদ ইওরোপের মধ্যেই নানারকম ডিবেট চালু ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এই ডিবেট চালু ছিল পুরা কলোনিয়াল পিরিয়ডেই, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিতর দিয়া এই ডিবেটের ফলাফল চূড়ান্ত হয়। বৃটিশ ইণ্ডিয়ায় মুসলমান কি একটা কম্যুনিটি, না একটা প্যারালাল ন্যাশন ছিলো? ন্যাশন’র ধারণা কি মাতৃভূমির লগে যুক্ত, নাকি ধর্মের লগে? উনবিংশ শতকের শেষদিকেই, বৃটিশ ইণ্ডিয়ায় এই ডিবেট তীব্র হইয়া ওঠে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, পশ্চিমে আধুনিকতার উত্থানের আগে ভারতসহ গোটা বিশ্বে মুসলিম শাসকদের আণ্ডারে বেশ বড়সড় সভ্যতা ও কালচার গইড়া উঠছিলো। জাতিপ্রশ্ন বা ‘উম্মাহ’র ধারণা ইসলামি কালচারে বেশ আগে থেকেই হাজির ছিলো। এমনকি, ভারতে বৃটিশ শাসন চলাকালীন সময়েও, ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব ছিল তুর্কিদের হাতে। ফলে, ইসলামি জনপদে পশ্চিমের নয়া ‘ন্যাশন’ ও ‘স্টেট’-প্রশ্ন মূলত আগে থেকে হাজির থাকা রিলিজিয়াস ট্রাডিশানের মাপকাঠিতেই ব্যাখ্যা হইতে থাকলো। [৯]

ইসলামি ট্রাডিশানে ‘ন্যাশন’র ধারণা নিয়া নানা ধরণের বিতর্ক ছিলো। কোরানে ‘কওম’, ‘মিল্লাত’, ‘উম্মাহ’ ইত্যাদি বিচিত্র ধরণের শব্দ ব্যবহৃত হইছে, এবং এদের কোনটার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, কোনটার সাথে ধর্মের সম্পর্ক আর কোনটার সাথে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুশের সম্পর্ক–এসব ইসলামের প্রায় শুরু জামানার বিতর্ক। তুর্কিদের শাসনে ‘মিল্লাত’ শব্দটা জনপ্রিয় হয়, যা একই ধর্মাবলম্বী লোকজনের এলায়েন্সরে বুঝাইতো। অন্যদিকে, বিংশ শতকের শুরুভাগে কলোনিয়াল আরবে বৃটেনের ওকালতিতে শুরু হওয়া ‘প্যান-আরব’ মুভমেন্টের প্রেক্ষিতে ‘কওম’ বা ‘কওমিয়াত’ বেশ জনপ্রিয় শব্দ হইয়া ওঠে, এবং ‘ন্যাশন’র প্রতিশব্দ হিশাবে ব্যবহৃত হইতে থাকে। ‘প্যান-আরব’দের তুর্কি সরকার দমনের চেষ্টা করে, কিন্তু বিশ শতকের শুরুতেই তুর্কি সাম্রাজ্য ভাইঙা পড়ে। ফলে আরবের নতুন রাষ্ট্র গঠনে ‘কওমিয়াত’ বা ‘ন্যাশনালিজম’ বেশ গুরুতর ভূমিকা রাখে। বিশ শতকের শুরুতে, ‘দেশ’ বা ‘রাষ্ট্র’র চাইতে, ‘ন্যাশন’র ধারণা বেশ গুরুতর হইয়া ওঠে। ফলে, রাষ্ট্র গঠনের জন্য বা রাষ্ট্র গঠনের পরেও, ‘ন্যাশন’র ধারণাই আরবের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডরে প্রভাবিত করে।

ইণ্ডিয়ান ন্যাশনালিজমর প্রাথমিক সমস্যা ছিল এর আঞ্চলিকতা ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা। উনিশ শতকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজমের গুরুরা ম্যাক্সিমামই ছিলেন মহারাষ্ট্র বা বাঙলার, তায় আবার মূলত হিন্দু। ধরা যাক, বাঙলায় যিনি বাঙালি জাতির ইতিহাস লেখার ডাক দেন সর্বপ্রথম, তিনি আর কেউ নন, প্রাতঃস্মরণীয় বাবু বঙ্কিমচন্দ্র। কলোনিয়াল ভারতে ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’ আর্টিকুলেট করা ছিলো বেশ শক্ত কাজ। কারণ, ‘ইণ্ডিয়া’ বা ‘ভারত’ কী জিনিশ, তা নিয়া কোন একরৈখিক ধারণা ছিলো না। মুসলমানদের প্রাথমিক পর্যায়ের বৃটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল ‘জেহাদ’ বা ‘খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’, অন্যদিকে হিন্দুরা তখন ছিলেন রাজ কর্মচারী। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিকে যে নয়া রেনেসাঁর জন্ম হয় ভারতে, তা বহুলাংশেই ছিল কম্যুনাল, ধরা যাক, বাঙলা প্রদেশের বঙ্কিমচন্দ্রের কথাই। ফলে, ভারতবর্ষে জাতিবাদের উত্থানের লগে কম্যুনাল চিন্তাধারার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল বিদ্যমান বাস্তবতা। উনিশ শতকের শেষভাগে যে লিবারাল ন্যাশনালিজমের উত্থান ঘটে ভারতবর্ষে, গোপালচন্দ্র গোখলে, এম জি রণদে বা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিদের হাতে, সেইখানেও কম্যুনাল চিন্তার প্রভাব ছিলো। এম জি রণদের ‘প্রার্থনা সমাজ’ ওয়েস্টার্ন সেক্যুলার চিন্তা লালন করলেও, তাদের বৃটিশবিরোধী ‘জাতিবাদ’ গঠনের গোড়া ছিল ভারতের পুরানা কালচারের ভিতরেই গাঁথা, আর সেই কালচার বহুলাংশেই ছিলো হিন্দু কালচার।[১০] পরবর্তীতে এই দর্শনের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস, যা আবার ভারতের সকল প্রদেশে সমান সেক্যুলার ছিলো না। ধরা যাক, বাঙলা অঞ্চলে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার চিন্তাধারায় বিশেষ কোন ফারাক ছিল না, যার বিস্তারিত বিবরণ আছে বিমলানন্দ শাসমলের ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’ বইতে। শাসমল দেখাইছেন, কীভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন মূলত ‘হিন্দুদের আন্দোলন’ হইয়া উঠলো, কীভাবে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা বাঙলায় ‘হিন্দু-ভারতীয় জাতিবাদ’ প্রচার করছিলেন এবং কীভাবে এই নেতারাই বাঙলায় কংগ্রেসের প্রধান সারির নেতা হইলেন। ১৯৪৭-এ বাঙলা ভাগের পেছনে বাঙলায় তিলে তিলে গইড়া ওঠা এই ‘হিন্দু-ভারতীয় জাতিবাদ’র দায় কম নয়।

৩.

শামেলির যুদ্ধে পরাজয়ের পর হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কির শিষ্যরা ১৮৬৭ সালে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা প্রায় সকলেই ১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়ায়ে ছিলেন। বিশ শতকের গোড়ায় এই ধারার ওলামারা আবার স্বাধীনতা আন্দোলনে অ্যাক্টিভ হন। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে শায়খুল হিন্দের নির্দেশে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী আফগানিস্তানে যান এবং বৃটিশ ইণ্ডিয়ায় আক্রমণের জন্য বহির্বিশ্বের শাসকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ‘রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র’ নামে সেই আন্দোলন বৃটিশের হাতে নাকাম হয়, শায়খুল হিন্দ মাল্টার দ্বীপে নির্বাসিত হন। তার সাথে তার প্রিয় শিষ্য হুসাইন আহমদ মাদানিও নির্বাসনে যান।

বিশ শতকের গোড়ায়, সর্বপ্রথম, কংগ্রেসের ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’-র ধারণার সাথে মোসলমানরা একাত্ম হইতে থাকেন। জিন্নাহ যোগ দেন কংগ্রেসে, ১৯২০ সালে গান্ধী ‘খেলাফত আন্দোলন’-এ শরিক হন, মুসলমানরা শরিক হইতে থাকে গান্ধীর ‘অসহযোগ আন্দোলন’-এ, গান্ধীর অনুরোধে মুসলিম নেতারা গরু কোরবানি করতে নিষেধ করেন মুসলমানদের। কম্যুনাল প্রাক্টিসগুলা শেয়ার করার মধ্য দিয়া, ন্যাশনালিজমের এক নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেন গান্ধী। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতারা শায়খুল হিন্দের আদেশে গান্ধীর লগে সন্ধি করেন, ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২০ সালে ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই, উপমহাদেশের রাজনীতিতে মাওলানা মাদানির আগমন। গান্ধী এবং খেলাফত নেতারা বোম্বাইতে জেলফেরত এই নেতাদের জন্য এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন।[১১]

শায়খুল হিন্দ গান্ধীর স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে একাত্ম হন, গান্ধীর আন্দোলনের পক্ষে জারি করেন ঐতিহাসিক ফতোয়া।[১২] সমানতালে চলতে থাকে সম্মিলিত আন্দোলন। ১৯২৪ নাগাদ এই দুই আন্দোলনই খতম হয়ে যায়। মাওলানা মাদানি দরস ও রাজনীতির কাজ একত্রেই চালু রাখেন।

১৯৩১ সালে জমিয়তে ওলামা হিন্দ তাদের বিখ্যাত ‘সাহারানপুর প্রোপোজাল’ পেশ করে। সাহারানপুর প্রোপোজাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভবিষ্যত সরকারব্যবস্থার প্রোপোজালের সাথে জমিয়তে হিন্দের প্রস্তাবনা–অতিরিক্ত প্রাদেশিক ক্ষমতা, পার্সোনাল ল’র ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধিকার এবং ধর্মের ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রিজার্ভেশন চালু রাখা–অন্তত এই তিনটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রস্তাবের বিপরীত ছিল। [১৩]।

১৯৩০-এর গোড়াতেই, আল্লামা ইকবালের ‘মুসলিম জাতি’র চিন্তা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে এবং মুসলিম লীগের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাইতে শুরু করে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর, আরেকটা মহাযুদ্ধের প্রায় খাদে দাঁড়ানো ইওরোপে জাতিবাদের সর্বনাশা তামাশা দেইখা ইকবাল জাতিবাদে ঈমান হারাইছিলেন। তিনি ভারতের মোসলমানদের সামনে তুইলা ধরলেন নতুন জাতিবাদ–মুসলিম জাতিবাদ। বিশ শতকের গোড়া থিকাই, জাতিবাদের সংজ্ঞা এবং জাতিবাদী আন্দোলন গইড়া ওঠার প্রাক্কালেই, মোসলমানরা নিজেদের ‘রিলিজিয়াস কম্যুনিটি’ বা ‘মাইনরিটি’র বদলে, ‘সেমি ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ হিশাবে প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো রিফর্মের আগে আগে, মুসলিম অভিজাতদের একটা দল তৎকালীন ভাইসরয়ের লগে দেখা কইরা তারে বলেন যে, ‘মুসলমানদের ভারতে অন্যান্য মাইনরিটির মতন দেখলে হবে না। মোসলমানরা এই জাতির ভিতরেই আরেকটা জাতি, এবং তাদের অধিকার সংবিধানে সুরক্ষিত থাকা উচিত।[১৪] এবং এর ভিত্তিতেই, মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।[১৫] ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের কনফারেন্সে ইকবালের দেওয়া বিখ্যাত ভাষণ, যারে পাকিস্তানের ভিত্তি ধরা হয়, বৃটিশ ইণ্ডিয়ায় মোসলমানদের ‘আলাদা জাতি’ হইয়া ওঠার কনসেপ্টে পূর্ণতা দেয়। মুলত, অন্যান্য মাইনরিটির চাইতে সংখ্যাধিক্য, বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন বৃটিশ ভারতের রাজধানী বাঙলা ও অন্যান্য প্রাদেশিক অঞ্চলে সংখ্যাধিক্য, ভারতে ছয়শ বছরের শাসনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মোসলমানদের ‘আলাদা জাতি’ হইয়া ওঠার পথ সুগম করছে। মোসলমানদের এই আলাদা জাত হইয়া ওঠার কালেই, মাওলানা মাদানি শক্তভাবে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান চিন্তার বিরোধিতায় নামেন।

৪.

আবারো সেই গোড়ার সুয়াল তোলা যাউক—মাওলানা মাদানি কেন পাকিস্তান চিন্তার বিরোধিতা করছিলেন? মাওলানা মাদানির ‘কওম’র ধারণা আল্লামা ইকবাল বা অন্যান্য মডার্ন ইসলামিস্টদের ‘কওম’র ধারণা থেকে ভিন্ন ছিল। মাওলানা মাদানি ছিলেন হিন্দুস্তানের ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’ বা জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। যদিও, মোসলমানদের জন্য আলাদা স্বায়ত্ত্বশাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ‘সাহারানপুর প্রোপোজাল’-এ ছিল, কিন্তু মাওলানা মাদানি নানা কারণেই মোসলমানদের আলাদা ‘জাতি’ ভাবতে গররাজি ছিলেন।

মাওলানা মাদানি ভারতীয় জাতিবাদের লিবারাল দৃষ্টিভঙ্গিতে ঈমান আনছিলেন। জনৈক সমালোচকের এক চিঠির জবাবে মাওলানা লেখেন—’আপনি লেখলেন যে, আমি হিন্দুদের দলে ঢুকছি, আর তাতে আপনি খুব অবাক। এইসব অপপ্রচারে আপনারাও আক্রান্ত হন! হিন্দুস্তানে আসার পর থিকাই তো মুসলমানরা হিন্দুদের সাথেই আছে। জন্মের পর থেকে আমি তাগো লগে আছি। এইখানেই আমি বড় হইছি। এক দেশে, এক শহরে দুইটা মানুশ থাকলে, অনেককিছুই শেয়ার করা লাগে। এই দেশে আসার পর থেকেই মোসলমানরা হিন্দুদের সাথে আছে। ঘর-বাজার-রেলস্টেশন-ট্রাম সবখানে… হিন্দুদের সাথে কে নাই কন তো? (হিন্দুদের সাথে থাকা অপরাধ হইলে) দশকোটি মোসলমান সেই অপরাধে অভিযুক্ত হবে।'[১৬]

মাওলানা মাদানি বিশ্বাস করতেন, ‘বর্তমান সময়ে রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি হইলো জাতিরাষ্ট্র’, আর ইণ্ডিয়া এরকম রাষ্ট্রই ছিল। তিনি ভাবতেন, জাতীয় ঐক্যে ফাটল তৈরি কইরা বিভেদ ঘটানো বৃটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির অন্তর্ভুক্ত, যা তারা অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে কাজে লাগাইছে। ইণ্ডিয়ার স্বাধীনতার জন্য ঐক্য খুবই জরুরি ছিল মাদানির কাছে। পাকিস্তান আন্দোলনরে তিনি বৃটিশদের কূটচাল হিশাবেই দেখতেন।

মাওলানা মাদানি তার পাকিস্তান-বিরোধী আর্গুমেন্টে বেশ কয়েকটা পয়েন্ট তৈরি করেন। প্রথমত, জিন্নাহর বিভিন্ন বক্তব্য কোট কইরা তিনি দেখান যে, জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তান কনসেপ্টের ব্যাপারে ক্লিয়ার না। দ্বিতীয়ত, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতাকর্মীরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যে মাইনরিটি মুসলমান, যাদের সংখ্যা পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি, তাদের উপর এই ঘটনার কী মারাত্মক প্রভাব পড়বে, তা তুইলা ধরেন। মাওলানা মাদানি দেখান, এমনকি পাকিস্তানেও মোসলমানরা বিপদে পড়বেন।

তৃতীয়ত, ইসলামি রাষ্ট্র প্রশ্নে মাওলানা মাদানি ছিলেন একাধারে প্রাগম্যাটিক ও ট্রাডিশনাল। প্র‍্যাগম্যাটিক এই অর্থে যে, মাওলানা মাদানি একথা বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ বলতে যা বোঝায়, সেসবের কিছুই হবে না। পাকিস্তান একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে। আর তাই হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ, মডার্ন ওয়ার্ল্ডের বাস্তবতায় ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা মাদানির মতে নানাভাবেই ছিল কঠিন। মাদানি জিন্নাহর নানা মন্তব্য (‘পাকিস্তান হবে ওয়েস্টার্ন ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি/ শিল্প কারখানা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতই সরকারের হাতে থাকবে’) কোট করে, তার ব্যক্তিগত জীবন ও অনুসৃত বহু নীতি কোট করে ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা’র ব্যাপারে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। ‘ইসলামি শরিয়া’ প্রতিষ্ঠার কোন ইচ্ছা জিন্নাহর ছিল না, তার আধুনিক চিন্তাধারা এই ‘শরিয়া’ পালনও করত না। তাইলে পাকিস্তান কী ছিল? পাকিস্তান ছিল শিক্ষিত মোসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষা ও বাঙলার অত্যাচারিত মোসলমানদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। এর সাথে ধর্মের সম্পর্ক ছিল কেবল পরিচয়ের খাতিরেই, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে না। মোসলমান রাষ্ট্রই জিন্নাহর কাম্য ছিল, ইসলামি রাষ্ট্র না৷ রিভিশনিস্ট হিস্ট্রিয়ানদের মধ্যে আয়শা জালাল ও ইয়াসমিন খান তাদের বই—যথাক্রমে ‘দ্য সোল স্পোকসম্যান’ এবং ‘দ্য গ্রেট পার্টিশান’-এ উল্লেখ করছেন, ‘পাকিস্তান ওয়াজ আ বার্গেইন চিপ অফ জিন্নাহ’—অর্থাৎ জিন্নাহর নানান দাবিদাওয়া নিয়া দর কষাকষি করার একটা টোকেন ছিল পাকিস্তান। জিন্নাহর এহেন জাতিবাদে মাদানির সায় ছিল না, তিনি ধরতে পারছিলেন, আর যাই হোক, শরিয়া বা ইসলামি রাষ্ট্র জিন্নাহর লক্ষ্য না। তাই মুসলিম লীগের ‘ইসলামি রাষ্ট্র’র ধারণারে তিনি অপোজ করছিলেন। এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ মুসলিম লীগের ‘এন্টি ইসলামিক’ কর্মকাণ্ডের একটা তালিকা হ্যাণ্ডবিল আকারে প্রচার করছিলো, যেগুলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার সাথে ইসলাম-প্রশ্নের মীমাংসা করা মুসলিম লীগের লক্ষ্য ছিল না, তাদের লক্ষ্য ছিল একটা মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্র গঠন।[১৭] আবার, মাওলানার চিন্তা ছিল ট্রাডিশনাল ওলামাদের চিন্তা। সেই আলোচনাটি একটু মুলতুবি রাখি।

৫.

মাওলানা মাদানির ‘মুত্তাহিদা কওমিয়া আউর ইসলাম’ বইটা ইকবালের সাথে তার বিখ্যাত বিতর্কের প্রেক্ষিতে লেখা। এই বইয়ে মাওলানা মাদানি কোরান-হাদিস এবং আরবি লিটারেচারের সুপ্রচুর দলিল দিয়া ‘কওম’ আর ‘মিল্লাত’ শব্দের ফারাক বয়ান করছেন। ‘কওম’কে তিনি ইংরাজি ‘ন্যাশন’ অর্থে নিছেন, এবং ওনার মতে, মুসলিম মিল্লাত এক হইলেও পৃথিবীর সমস্ত মোসলমানই আলাদা আলাদা ‘কওম’র অংশ। এবং এই যে ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’ বা ‘মুত্তাহিদা কওম’, এর বৈধতা মাওলানা মাদানি খুঁজছেন ‘মদিনা সনদ’র ভেতর। মদিনা সনদ বিশ্লেষণে মাদানি দেখাইছেন, ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র ধারণা মদীনায়ও ছিল।

মাওলানা মাদানির এই ব্যাখ্যা অবশ্য তার নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুযুগ থেকেই, দেওবন্দি ওলামারা ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র কথা বলছেন। মাওলানা মাদানির ওস্তাদ শায়খুল হিন্দও এই চিন্তাই লালন করতেন। জমিয়ত ই উলামায়ে হিন্দের সাবেক সভাপতি আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরীও ‘মদিনা সনদ’ থেকে ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র বৈধতা তুইলা ধরছিলেন।

মজার ব্যাপার, মাওলানা মাদানির ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র ক্রিটিকরা দেখাইছেন, এই ন্যাশনালিজমের ধারণা মোটেই সেক্যুলার না। মাওলানা মাদানির মতে, এই ‘ন্যাশনালিজম’ ছিল ‘সাময়িক ও বিশেষ ব্যাপার’।[১৮] মদিনার ইহুদীদের সাথে রাসূলের চুক্তির ‘হাইসিয়াত’ কী ছিল, তা কি ‘ন্যাশন’ গড়ার চুক্তি ছিল, নাকি কমন এনিমির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় সাময়িক চুক্তি? মাওলানা মাদানি ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র কথা বললেও, এই ব্যবস্থারে তিনি সাময়িক বলছেন। ফলে, মাদানির কম্পোসিট ন্যাশনালিজমের ‘সেক্যুলার শুদ্ধতা’ নিয়া প্রশ্ন ওঠে।

মাওলানা মাদানি ‘ফ্রিডম অব রেলিজিওন’র ভিন্ন ব্যাখ্যা দিছেন৷ পশ্চিমে ‘ফ্রিডম অব রেলিজিওন’রে তিনি ‘এন্টি-রেলিজিওন’ বা ‘এন্টি ইসলাম’ হিশাবেই দেখতেন। তিনি মনে করতেন যে, বৃটিশ শাসনের আণ্ডারে সেই ‘ফ্রিডম অব রেলিজিওন’র চর্চা মোসলমানদের আভ্যন্তরীণ ধর্মীয় সঙ্গতি নষ্ট করছে। সেই সঙ্গতি ও সংহতিরে আবার সুগঠিত করতেই, বৃটিশ-পরবর্তী ভারতের ধর্মীয় ব্যাপারে নাক না গলানো উচিত, এবং সাংবিধানিকভাবে মোসলমানদের ধর্মীয় বিধি-বিধানের স্বীকৃতি থাকা উচিত। মাওলানা মাদানি এও বলছেন, সমগ্র ভারত যেন ইসলামের ছায়াতলে আসে, সেজন্যেই এই ‘ন্যাশনালিজম’রে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। ফলে, অনেক ক্রিটিকই মাওলানা মাদানির ‘ন্যাশনালিজম’র এই চরিত্ররে আধুনিক ‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘সেক্যুলারিজম’র সাথে মিলাইতে পারেন নাই।

৬.

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে উত্থান ঘটে উপমহাদেশের আরেক চিন্তাবিদ আবুল আলা মওদুদির (১৯০৩-১৯৭৯)। মাওলানা মওদুদি প্রথমে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মুখপাত্র ‘আল জামিয়া’র সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে মাওলানা মওদুদির ইসলাম ও রাষ্ট্রচিন্তার সাথে দেওবন্দকেন্দ্রিক ওলামাদের বিরোধ তৈরি হয়।

আল্লামা ইকবালের সাথে দেখা করার তিন বছর পর, ১৯৪১ সালে লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামি গঠিত হয়। শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই না, চল্লিশের দশকে কলোনিগুলো ভেঙে যাওয়া এবং ক্ষুদ্র-বৃহত অনেক মুসলিমপ্রধান স্বাধীন দেশের উদ্ভব, ষাটের দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের বাস্তবতায় ‘প্যান আরব’র পরিবর্তে গড়ে ওঠা নতুন ‘মুসলিম উম্মাহ’-র ধারণা এবং আশির দশকের শেষের দিকে সংঘটিত আফগান যুদ্ধ আর ইসলামে সশস্ত্রপন্থার আধুনিক ধারণা ও বিকাশ—এই গ্লোবাল প্রেক্ষাপটেও জামায়াতে ইসলামির ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতের ইসলাম ব্যাখ্যার একটা অন্যতম দিক ছিলো ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। সোশাল ও পলিটিকাল ইসলামের এই ধারণা, সারা বিশ্বের মত উপমহাদেশেও তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। তবে এর নেতৃত্বে তখন ছিলো মুসলিম লীগ। কিন্তু মুসলিম লীগের সেক্যুলার নেতৃত্ব এবং চিন্তার কারণে, জামায়াত ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে।

ওয়েস্টার্ন সেক্যুলারিজমের বিরোধিতার পাশাপাশি, ‘দ্বীন’-এর ব্যাখ্যা এবং আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামের পলিটিকাল অবস্থান নিয়ে জামায়াত শুরু থেকেই দেওবন্দভিত্তিক ওলামাদের ট্রাডিশনাল অবস্থান ও চিন্তার বিরোধিতা করে। আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে ইসলাম-প্রশ্নের সমাধানে ট্রাডিশনাল ওলামারা ব্যক্তি ও সমাজকে বেশি গুরুত্ব দিতেন, জামায়াত সেখানে হাজির করে ‘মডার্ন ইসলামি স্টেট’-এর ধারণা। ফলে শুরু থেকেই ইসলামের ইতিহাস বিশ্লেষণ, রাসূলের মাদানি জীবন ও রাষ্ট্রগঠন, সাহাবাদের আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ, খেলাফত-পরবর্তী সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের সালতানাত ও ইমারাতের ধারণা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাখ্যায় ট্রাডিশনাল ওলামাদের সাথে জামায়াতের চিন্তাগত দূরত্ব তৈরি হয়।

পোস্ট-কলোনিয়াল সমাজে ইসলাম ও দ্বীন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ওলামাদের এপ্রোচের সাথেও একমত ছিলো না জামায়াত। ওয়েস্টার্ন মডার্নিজমের প্রভাবে যে ‘আধুনিক মানুশ’-এর ধারণা তখন গড়ে উঠছিলো, ইসলামের নানা বিষয়ের ব্যাখ্যায় সেই ‘আধুনিক মানুশ’ এবং তার চিন্তাপদ্ধতির সাথে সঙ্গতি রেখেই ইসলামের ব্যাখ্যা করা উচিত বলে মনে করতেন মাওলানা মওদুদি। অন্যদিকে ট্রাডিশনাল ওলামারা ইওরোপিয় এনলাইটেনমেন্ট এবং এর উপজাত নানা ধারণা ও চিন্তাপদ্ধতিকে কখনোই স্বীকার করেন নাই। তারা মনে করেন, ইসলামের ঐতিহ্যবাহী ধারা মেনেই ব্যাখ্যার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

মাওলানা মওদুদি ‘স্টেট’র ধারণা সামনে আনেন, এবং মডার্ন সোশাল ও পলিটিকাল ইন্সটিটিউশানগুলারে ইসলামের সূত্রে ব্যাখ্যা করেন। মাওলানা মওদুদির চিন্তাধারার সাথে আল্লামা ইকবালের চিন্তার বিশেষ অমিল ছিল না। তবে, আল্লামা ইকবালের ‘মুসলিম জাতিরাষ্ট্র’ গঠনের কাণ্ডারি ছিলেন সেক্যুলার জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ, যারা মূলত কোন ইসলামিক রিভাইভাল চান নাই, ভারতের মোসলমানদের সংখ্যালঘিষ্ঠতা থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় উন্নীত করতে একটা রাষ্ট্র গড়তে চাইছেন। এই গড়তে চাওয়ার বাস্তব প্রেক্ষাপটও হাজির ছিল। কিন্তু, ইসলামি রাষ্ট্র তারা গড়তে চান নাই।

ঠিক এইখানেই মওদুদির সাথে মুসলিম লীগ ও জিন্নাহর বিরোধ তৈরি হয়। ১৯৩৯ সালে তাফহিমুল কুরানের ডিসেম্বর সংখ্যায় তিনি লেখেন, ‘পুরা পৃথিবী জানে, জিন্নাহ ইসলামের ‘ই’-ও জানে না…..।’ ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওদুদি সাহেব লেখেন, ‘মুসলিম লীগের সাথে মিলেমিশে যাওয়া আলেমদের সেই পরিণতি ভোগ করা লাগবে, যে পরিণতি হইছিল তুরস্কের কামাল পাশার লগে হাত মিলানো উলামাদের…. (কারণ পাকিস্তান আন্দোলন) এমন লোকদের হাতে বন্দী যারা সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী।'[১৯] এমনকি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানে মাইগ্রেশন করলেও, মাওলানা মওদুদি জিন্নাহর সমালোচনা অব্যাহত রাখেন। যেমন, ১৯৪৭-এর ১১ আগস্ট অ্যাসেম্বলিতে দেওয়া জিন্নাহর ভাষণের তিনি সমালোচনা করেন, যেখানে জিন্নাহ বলেন যে, নতুন রাষ্ট্র হবে প্লুরালিস্টিক এবং নাগরিকদের ধর্ম নিয়া স্টেটের কোন মাথাব্যথা থাকবে না। ১৯৪৯ সালে জিন্নাহর মৃত্যু ও লিয়াকত আলি খান কর্তৃক পাকিস্তানরে ‘ইসলামি রিপাবলিক’ ঘোষণার পরই মওদুদি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় হন।[২০]

৭.

হোসাইন আহমদ মাদানিসহ দেওবন্দি ওলামাদের রাষ্ট্রদর্শন কেন মুসলিম লীগের বিপরীতে গেল? এর উত্তরে কয়েকটা কথা বলা যাইতে পারে।

প্রথমত, রাষ্ট্রপ্রশ্নে ট্রাডিশনাল ওলামাদের অবস্থান। উমাইয়া খেলাফতের সময় থেকেই, রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের বেসিক শিক্ষা ও ওলামাদের এক ধরণের বিরোধ ও দূরত্ব তৈরি হয়। ইসলামের রাষ্ট্র প্রকল্পের কোন একরৈখিক রূপ পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডেই পাওয়া যায় না। ট্রাডিশনাল ওলামাদের রাষ্ট্রের সাথে সহাবস্থানের নীতি তৈরি হয়। এই নীতি হলো, রাষ্ট্ররে ম্যাক্সিমাম বা মিনিমাম ইসলামবিরোধী না হওয়ার শর্তে তার সাথে সহাবস্থান। উমাইয়া ও আব্বাসি খেলাফতের প্রায় পুরাটা জুইড়া, রাষ্ট্রের লগে ওলামাদের সংঘাত রাষ্ট্রের লগে ওলামাদের বিভাজনের এই নয়া নীতির শর্ত তৈয়ার করে।

ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর লেখা ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা’ বইতে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের রিগিট কোন রূপরেখার কথা অস্বীকার করেন। মৌলিক নীতিমালা মাইনা চলার স্বার্থে শাসকের সাথে সহাবস্থানের নীতি তিনি ঘোষণা করেন। উপমহাদেশে আলেমদের রাষ্ট্রের লগে বোঝাপড়ার সূত্রও ছিল তাই। রাষ্ট্রযন্ত্র তার মত চলবে, ইসলাম ও ওলামারা তার বাইরে আবরণ ও ভেতরে প্রভাবকের ভূমিকায় থাকবেন—এইটাই ছিল ট্রাডিশনাল ওলামাদের রাষ্ট্রচিন্তার ধারা।

বিশ শতকের শুরুতে কলোনিয়াল বিভিন্ন মুসলিম ভূখণ্ডে ‘প্যান ইসলাম’সহ আরো বিভিন্ন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন তৈরি হয়। ইসলামের রাষ্ট্রপ্রশ্ন ও রাষ্ট্রপ্রকল্প, মডার্ন স্টেটের সার্বভৌম ক্ষমতার কালে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সোসাইটি বা সমাজ নতুন আধুনিক স্টেটের ভেতরে ফাংশান করতে থাকা একটা প্যাসিভ পাওয়ার, সোসাইটিরে ইচ্ছামত শেপ দিতে পারে মডার্ন স্টেট, এই ধারণা প্রবল হইয়া ওঠে। আবার, অনেক মুসলিম ভূখণ্ড কলোনিয়াল শক্তির হাত থিকা মুক্তি পাইয়া নয়া স্টেট বানাইতে যায়, ইসলাম ও মডার্ন স্টেট-স্টাইলের সমন্বয়ে তারা এক ধরণের স্টেট বানায়ও, যা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের ‘প্যান-ইসলামিস্ট’দের নাড়া দেয়। ফলে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রপঞ্চটি ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কলোনিয়াল অত্যাচারে জর্জরিত মোসলমানদের ভেতর জনপ্রিয়তা পায়।

ওলামায়ে দেওবন্দ বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের আন্দোলন ছিল ‘খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র আন্দোলন। কিন্তু মডার্নিটি, এর সামগ্রিক চিন্তাপদ্ধতি ও কর্মপন্থা এবং ওয়েস্টার্ন মডার্ন স্টেটের ধারণা নিয়া ওলামায়ে দেওবন্দের দ্বিধা ছিল। তারা কখনোই বিশ্বাস করেন নাই যে, ওয়েস্টার্ন ভ্যালুজের ভিত্তিতে একটা সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হইতে পারে। বরং, তারা এ ব্যাপারেই সন্দিহান ছিলেন যে, এই সময়ে ‘ইসলামি স্টেট’ নামে যা কিছু তৈরি হবে বা হইতেছে, তা আদৌ ‘ইসলামিক’ কিনা বা হইতে পারবে কিনা। মডার্ন ইসলামিক স্টেটের ভয়াবহ ডিলেমা দেখা গেছে ৭১-এ, যখন পূর্ব বাঙলার বিরুদ্ধে যুদ্ধরে পাকিস্তানে ‘জিহাদ’ বলা হইছে। মডার্ন স্টেটের ধারণা ও সামগ্রিক নীতির সাথে ইসলামের রাষ্ট্রপ্রকল্প বা চিন্তার ডিলেমা বিস্তর, এমনকি খোদ রাষ্ট্রপ্রশ্নেই ধর্মের ভূমিকার সীমানা নিয়া ইসলামের ডিবেট বেশ ক্লাসিক। ফলে, ওলামায়ে দেওবন্দ ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রকল্প ও প্রপঞ্চে তেমন সাড়া কখনোই দেন নাই।

দ্বিতীয়ত, ওলামাদের চিন্তাটা তাইলে কেমন ছিল? মাওলানা মাদানির ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’ দিয়া এর সবটা বোঝা যাবে না। উপমহাদেশের ট্রাডিশনাল দেওবন্দি আলেমরা বৃটিশপূর্ব মুসলিম শাসনামলের সন্তান ছিলেন। ফলে, তাদের মনেও অখণ্ড ভারতের একটা স্মৃতি ও ছবি ছিল, যে ছবি কলোনিয়াল ইন্ডিয়ায় মুইছা গেলেও, ওলামারা তা নিয়া নস্টালজিক ছিলেন বটে। মুসলিম লীগ বিরোধী ওলামাদের দল ‘মজলিসে আহরার’-এর নেতা শাহ আতাউল্লাহ বুখারির চিন্তা এইক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বুখারি ভাবতেন, আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শক্তিরে খণ্ড-খণ্ড কইরা ফেলবে, উত্তর ভারতের বিশাল এবং বৈচিত্র‍্যময় ইন্দো-ইসলামিক সভ্যতার কেন্দ্রভূমি থিকা মোসলমানদের উৎখাত করবে এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সম্রাট অশোকের সময়ের পির থিকা এই প্রথমবারের মত, ভারতবর্ষের এই বিরাট ভূভাগের মালিকানা হিন্দুদের হাতে চইলা যাবে।[২১] আতাউল্লাহ বুখারির এই চিন্তার কয়েকটা দিক আছে৷ প্রথমত, ইস্ট ও ওয়েস্ট পাকিস্তানের আইডিয়া আতাউল্লাহর ভাল লাগে নাই। আতাউল্লাহ মুসলিম এই দুই পার্টের ভিতরে যুদ্ধের আগাম সম্ভাবনা (দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শক্তিরে খণ্ড খণ্ড করা) দেখছিলেন। বর্তমানে বাঙলাদেশের ভারতপ্রীতি ও পাকভীতি সেই ঐতিহাসিক আশঙ্কারই বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষের যে ইতিহাস ওলামারা জানতেন, তা ছিল মুসলিম শান-শওকত ও প্রতিপত্তির ইতিহাস৷ এর কাউন্টার ইতিহাস উৎপাদিত হইছিল কলোনিয়াল ইণ্ডিয়ায়, যেখানে মোসলমানদের ‘বহিরাগত’-ও বলা হইছিলো৷ উত্তর ভারতসহ এই বিশাল ভূভাগের প্রায় পুরাটাই মোসলমানদের হাতছাড়া হইয়া যাইতেছে, এইটা আতাউল্লাহরা দেখতেছিলেন। উত্তর ভারতের ওলামারা এই ব্যাপারটা মানতে পারেন নাই। বিশাল ভারতবর্ষরে প্রায় একতরফাভাবে হিন্দুদের হাতে তুইলা দেওয়ার আইডিয়া তারা পছন্দ করেন নাই। কারণ, ওলামাদের কাছে রাষ্ট্রের চাইতে সমাজের গুরুত্ব ছিল বেশি। অনিশ্চিত নতুন ঐতিহ্যের চাইতে নিশ্চিত পুরাতন ঐতিহ্যের প্রেম ছিল বেশি। মাওলানা মাদানির ভারত সমর্থনের আরেকটা কারণ ছিল, দেশভাগের পরেও যে বিপুল পরিমাণ মোসলমান আরো ক্ষুদ্র মাইনরিটিজ হিশাবে এই দেশে থাইকা যাবে, তাদের পক্ষে কাজ করা। দেশভাগের দাঙ্গার সময়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রদেশে কীভাবে ছুইটা গেছেন মাদানিসহ তার কর্মীরা, মাওলানা যাকারিয়ার আত্মজীবনী ‘আপবীতী’তে তার উল্লেখ আছে।

আজ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার কারণে ভারতে হিন্দুত্ববাদী আইডিয়ার উত্থানের পালে জোর বাতাস বইতেছে। ভারত হিন্দু, পাকিস্তান মোসলমান—এই আইডিয়া ভারতের মোসলমানদের কপালে শনি নাইমা আসছে। বিশাল ভারতের বুক থেকে মোসলমানদের ঐতিহ্যের চিহ্ন একে একে মুইছা যাইতেছে। মোসলমানদের বড় দুই ভূখণ্ড পরস্পর বৈরিতার বেড়াজালে আবদ্ধ হইয়া এসব দেইখা যাইতেছে৷ ভারত ভাইঙা যাবে, মোসলমানদের অনেকেরই এই আশা আতাউল্লাহ বুখারির সেই ভারত হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কার ক্ষততেই ব্যর্থ প্রলেপ। হয়ত আজ অখণ্ড ভারতেও এই হিন্দুবাদী ভারতের উত্থান ও জয় হইতে পারত। তবে সত্য এই যে, দেশভাগ হইছে। এবং এও সত্য, দেশভাগ হয়ত অনিবার্যই ছিল৷

৮.

কী হইত, কী হইল—এসব দিয়া ইতিহাসের সত্য ধরা যায় না। অনেক কিছুই হইতে পারতো। অনেক কিছুই হয় নাই। কিন্তু ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কপালে নাইমা আসছে চরম দুর্দশা।

আর মাত্র দুইদিন পরেই প্রকাশিত হবে আসামের এনআরসির ফলাফল। প্রায় ৪০ লাখ মানুশ বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কায় আছেন, যারা আসামেরই সন্তান। কাশ্মীরের অটোনমি উইথড্র করা হইছে, কাশ্মীর আজ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক নগর। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলার নাম পরিবর্তন করা হইছে অরুন জেটলির নামে। সমগ্র ভারতে চলতেছে হিন্দুবাদের উগ্র প্রদর্শনী। আতাউল্লাহ বুখারির আফসুসের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক।

কিন্তু দেশ এক থাকলেই কি এই পরিস্থিতি এড়ানো যাইতো, নাকি তখন অন্তত স্বাধীন দুইটা ভূখণ্ডও পড়ত এই প্রবল হিন্দুবাদের খপ্পরে? ইতিহাসের আগাম খবর বলা যায়, ‘কী হইলে কী হইত’, বলা যায় না। মাওলানা মাদানি ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’ আর ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ভারতে মোসলমানদের মিলেমিশে বসবাসের কথা বলছিলেন, জিন্নাহ সাহেব ‘মেজরিটি মোসলমানের রাষ্ট্র’ গড়ার জন্য ইণ্ডিয়ার মাইনরিটি মোসলমানরে আত্মত্যাগ করার কথা বলছিলেন। সেই ‘কম্পোসিট ন্যাশনালিজম’র দায় চুকাইতে চুকাইতে ‘আত্মত্যাগ’-ই হয়ত ভারতের মাইনরিটি মোসলমানের নিয়তি।

নিশানি :

১. জি এইচ ফারুকি, দ্য দেওবন্দ স্কুল অ্যান্ড দ্য ডিমাণ্ড ফর পাকিস্তান, ১১৯ (ক্রিয়েটিং আ নিউ মাদিনা, ভেনকাট ধুলিপালা, ২৭৯)।

২. আলি ওসামা কাসেমি, মুসলিমস এগেইন্সট মুসলিম লীগ, ৪৩।

৩. মাহনামা দারুল উলুম, ফেব্রুয়ারি ২০১৩, http://www.darululoom-deoband.com/urdu/magazine/new/tmp/06-Hadhrat%20Shaikhul%20Islam_MDU_02_February_13.html.

৪. ইকবাল আওর সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানি, প্রফেসর ইউসুফ সালিম চিশতি, ৩৮৩।

৫. আলি উসমান কাসমি, মুসলিমস এগেইনস্ট মুসলিম লীগ, ৩।

৬. প্রাগুক্ত।

৭. উইকিপিডিয়া, মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদি।

৮. আলি উসমান কাসমি, প্রাগুক্ত, ১৮।

৯. প্রাগুক্ত, ১০।

১০. ইরফান হাবিব, অন ন্যাশনালিজম অফ ইণ্ডিয়া, ইন্ট্রোডাকশন।

১১. প্রাগুক্ত, ৪০।

১২. প্রাগুক্ত, ৪০।

১৩. প্রাগুক্ত, ৪২।

১৪. প্রাগুক্ত, ১৫-১৬।

১৫. প্রাগুক্ত, ১৫-১৬।

১৬. ভেনকাট ধুলিপালা, ক্রিয়েটিং নিউ মাদিনা (কোটেট ফ্রম ‘দ্য ক্যারাভান’, মার্চ ২০১৫)

১৭. প্রাগুক্ত।

১৮. কম্পোসিট ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ইসলাম, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, ১৫০।

১৯. আলি হাসান কাসমি, মুসলিমস এগেইন্সট মুসলিম লীগ।

২০. প্রাগুক্ত। (বিস্তারিত দেখুন: ১০৯-১৪২)।

২১. সাইয়েদ মুহাম্মদ কাফিল বুখারি, পাকিস্তান মে ক্যায়া হোগা: খুতুবাতে আমিরে শরিয়ত সাইয়েদ শাহ আতাউল্লাহ বুখারি।

Leave a Response