featured

ইসলামাতঙ্কের সফল বহিঃপ্রকাশ ‘কাশ্মীর ফাইলস’ – সফিকুল ইসলাম মণ্ডল

285views

 

বলিউডি ছবিতে ভূস্বর্গ নামে অভিহিত কাশ্মীরের উপস্থিতি নতুন কোনো বিষয় নয়। জঙ্গি-বিচ্ছিন্নতাবাদের উত্থান পতন, স্বাধীন কাশ্মীরের দাবি তোলা , কখনো বা পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে বলিউডি জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন তুলতে হরহামেশাই সিনেমার পর্দায় দেখা যায়। কয়েকটি ছবির কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে। যেমন ধরুন স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এনএল জালান নামে এক পরিচালক ‘কাশ্মীর হমারা হ্যায়’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন। নামেই লুকিয়ে আছে ছবির বিষয়বস্তু ।
“সিকান্দার”-কীভাবে শিশুদের মানসিকতা সন্ত্রাসবাদে রূপ নিতে পারে, সেটাকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক পীযূষ।
পরিচালক বিশাল ভারদ্বাজ উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেটের অনুকরণে নির্মাণ করেছেন আরো একটি সিনেমা “হায়দার”।১৯৯৫ সালে কাশ্মীর বিদ্রোহের সময় হায়দারের বাবাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কাজ করার মাশুল গুনতে হয় জীবন দিয়ে।
অল্প বয়সী এক ছেলের জীবন ও তার পোষা গাধার ওপর ভিত্তি করে ‘তাহান’ নির্মাণ করেছেন সন্তোষ সিভান।
কার্গিল যুদ্ধ সহ বিভিন্ন সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে তৈরি পংকজ কাপুরের ছবি “মৌসম”।কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে বিধু বিনোদ চোপড়াও বছর দুই আগে নির্মাণ করেছিলেন ‘শিকারা’।
১৯৯০ এর সেই প্রেক্ষাপটেই কাশ্মীরি যুগলের ভালোবাসার গল্প বুনেছিলেন তিনি।১৯৯২ সালে মণিরত্নমের ছবি ‘রোজা’ মুক্তি পায়। মিশন কাশ্মীর’ , “শীন” ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ একে একে উঠে এসেছে কাশ্মীরের গল্প গুলো।

এছাড়াও ভূস্বর্গ কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্য, প্রবাহমান ঝর্ণাধারা, আপেল বাগিচা, পাহাড় -পর্বত, সারি সারি সবুজ অরণ্য, মিষ্টি মায়াবী চোঁখের সুন্দরী নারী,প্রেম ,ভালোবাসা — সবকিছু একাকার হয়ে আরো কতো যে সিনেমার জন্ম হয়েছে , সেগুলো সিনেমা বিশেষজ্ঞরা বলবেন। কিন্তু ১৯৯০-এ উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিজেদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার উপর ভিত্তি করে, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’- ছবি বিতর্কের ঝড় তুলেছে সারা দেশে। অনুপম খের, মিঠুন চক্রবর্তী, দর্শন কুমার, পল্লবী যোশী ছাড়াও অন্যান্য বলিউডের পোড় খাওয়া অভিনেতাদের নিয়ে তৈরি বিবেক অগ্নিহোত্রীর এই ছবি দর্শক, বলিউড তারকা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদদের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বহুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে । লক্ষ করার ব্যাপার হলো,জঙ্গিবাদে জর্জরিত কাশ্মীর বা পাক-হামলায় বিপর্যস্থ হওয়া বা ধরুন মাতৃভূমির জন্য লড়াই করতে করতে শহীদ হওয়া ভূস্বর্গ কাশ্মীরের থেকে এ ছবির বিষয়বস্তু একেবারে বিপরীত মেরুর মতো আলাদা। একটি নির্দিষ্ট লক্ষকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সুপরিকল্পিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হলো এই ছবি ।

বিবেক সাহেব এর আগেও অনেক গুলি ছবি করেছেন। তার মধ্যে দু’টি ছবিতো একেবারে ঘোষিত রাজনৈতিক বলা চলে।একটি ২০১৬-এর ছবি ‘বুদ্ধ ইন আ ট্রাফিক জ্যাম’। কাশ্মীর ফাইলের মতো সেটাতেও প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনুপম খের, যিনি কিনা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মস্ত বড় সমর্থক।বিবেকের ওপর রাজনৈতিক ছবিটি ছিল ‘দ্য তাসখেন্ত ফাইলস’। মিঠুন চক্রবর্তী যিনি কিনা একজন ঘোষিত বিজেপি সদস্য, এই ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু এই দুটো ছবিই তেমন বাজার করতে পারেনি।রাজনীতি নিয়ে বিবেক অগ্নিহোত্রীর তৃতীয় ছবি ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছে। বলা চলে একে বারে কিস্তিমাত করে ফেলেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই বিপুল টাকার বাণিজ্য করে ফেলেছে ছবিটি। প্রতি দিনই বাড়ছে বাণিজ্যের অঙ্ক। আর হ্যা, এই ছবিতে কারা অভিনয় করেছেন সেটা উল্লেখ আগেই করেছি। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছবিটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ , যা কিনা স্বাধীন ভারতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিরল ঘটনা! বেশিরভাগ বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার মুভিটিকে করমুক্ত ঘোষণা করে দিয়েছে। বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়, যে এ ছবির আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ?

পরিচালকের একটা ‘ধর্মশপথ’ আছে, ‘সত্য বলিব। কিন্তু সে সত্য বানাইয়া বলিব।’ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটি দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছিল, এ ধ্রুব সত্য কথাটি।এ যেন অর্ধ সত্য মিশ্রিত খণ্ডিত ইতিহাস!
ধর্ম পরিবর্তন করো, নয়তো মরো’— এই স্লোগান দিয়ে শুরু হয় ছবি। শেষ হয় ভারতীয় সেনার ছদ্মবেশে জঙ্গিদের একতরফা গণহত্যার মধ্য দিয়ে।
পুষ্করনাথ পণ্ডিতের (অনুপম খের) পরিবারের উপর কীভাবে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ নেমে এসেছিল সেই ঘটনার মাধ্যমেই মূলত উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
ছবির কাহিনী কখনোই সমান্তরালে চলেনি। বর্তমান থেকে কখন যে হঠাৎ লাফ মেরেছে অতীতে বুঝতেই পারবেন না। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের রমরমা এবং সমগ্র উপত্যকা জুড়ে তাদের হত্যালীলার খেলাকে বার বার দেখানো হয়েছে ছবির পর্দায়। এই সময়ে পুষ্করনাথ এবং আইএএস ব্রহ্ম দত্তের কথোপকথনে ‘ইয়াং প্রাইম মিনিস্টার’ বলতে নাম না করে রাজীব গান্ধীকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথচ, ’৮৯-এ রুবিয়া সইদ অপহরণ থেকে শুরু ’৯০ সালের যে ঘটনা দেখানো হচ্ছিল সেই সময় দিল্লিতে ভি পি সিংয়ের সরকার ছিল। এই সরকারেরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন রুবিয়ার বাবা মুফতি মহম্মদ সইদ। আর সেই সরকারকে বিজেপিই সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিলো। তখন জগমোহন ছিলেন জম্মু এবং কাশ্মীরের রাজ্যপাল।কিন্তু সেটাকে সুকৌশলে দেখানো হয়নি।
আবার জেএনইউ এর মতো দেশ সেরা একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের (ছবিতে কলেজ বলা হয়েছে) প্রগতিশীল ছাত্রদের ‘ব্রেন ওয়াশ’ করা এবং তাঁরা সঠিক ইতিহাস জানেন না— এরকম একটা চিত্র তুলে ধরার ভরপুর চেষ্টা চালিয়েছেন পরিচালক। আর কাশ্মীরবাসীর মানবাধিকার নিয়ে যাঁরাই প্রশ্ন তোলেন, তাঁদেরই তলে তলে জঙ্গিদের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে এরকম ভাবও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিতে। সন্ত্রাসবাদী ফারুক মালিক বিট্টার (চিন্ময় মাণ্ডলেকর) হাউস বোটে ‘এএনইউ’-এর অধ্যাপিকা রাধিকা মেননের (পল্লবী যোশি) রোমান্টিক ছবি লাগিয়ে সেই চিত্রই অবলোকন করলেন বিবেক মহাশয়। শেষে, সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি করে মোদী সরকার কতোটা যুক্তিযুক্ত কাজ করেছেন সেই প্রমাণ দেওয়া হয়ে উঠলো এই ছবির মুখ্য উদ্দেশ্য।

যেকোনো মানুষ হত্যাই অন্যায়। গত তিন দশকে সর্বমোট কতো জন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা করা হয়েছে?
তথ্য জানার অধিকার থেকে জানা যায় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মিলিটান্টদের দ্বারা হত্যার সংখ্যা ৮৯ , আর একটি সরকারি পরিসংখ্যানে সেটি দেখাচ্ছে ২১৯ জন। কিন্তু কাশ্মীর ফাইলে সেটাকে শুধু বেশি করে দেখায়নি,বরং হাজার হাজার সাধারণ কাশ্মিরী যে গুম,খুন হয়ে গেছে,তাদের নিয়ে টু শব্দটিও নেই !
ফাইল শব্দটি লাগিয়ে পরিচালক মহাশয় মূলত একটি অর্ধ সত্য, একপেশে গল্পকে সমাজে প্রাধান্য পাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বৈকি।

এই ছবি অনেক গুলো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসবে । প্রথমত সারা দেশে হিজাব, তিনতালাক, গোমাংস প্রভৃতি নিয়ে চলমান মুসলিম আতঙ্কের পালে আরো একটি তীব্র হাওয়া লাগানো । যার পরিণতিতে সারা দেশে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যার পরিবেশ তৈরি করা।
দ্বিতীয়ত, সারা দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্রের অগ্নিমূল্য দাম, দলিত আদিবাসী মুসলিমদের উপর অত্যাচার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ন বিষয় থেকে সাধারণ মানুষকে ধর্মের ললিপপ দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। এর ফলে সরকারের ভুল গুলো নিয়ে আলোচনা হবেনা, বিরোধিতা হবে না ।
তৃতীয়ত, ৩৭০ ধারাকে অবলুপ্ত করাটাকে সাধারণ মানুষের কাছে যুক্তিযুক্ত করে নেওয়া।

একটু সচেতনতার সাথে লক্ষ্য করলে দেখবেন উপরি উল্লেখিত প্রতিটিতেই দুর্বার গতিতে সফলতা লাভ করছে মুভিটি। ফল স্বরূপ তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে সারা দেশে।এতদিন ইসলামবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা অন্য সকল মাধ্যমে প্রচার হলেও সরকারি মদদে ছবির পর্দায় এভাবে আম ভাবে কখনোই প্রচার হয়নি। এই মুভি দেখার পরে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বিদ্বেষ মূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। কেউ কেউ তো মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করে জনসংখ্যা কমানোর মতো কথা বলছে। অনেক প্রেক্ষাগৃহ থেকে ছবি দেখার পরে জয়শ্রীরাম ধ্বনি উঠেছে। প্রকাশ্যে গনহত্যারও নিদান এসেছে কিছু ভিডিও থেকে। অথচ এখনো পর্যন্ত একজনও গ্রেফতার হয়েছে বলে খবর নেই।ফলে মুসলিম সমাজে একপ্রকার আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সচেতন যেকোনো মানুষই জানে ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু তাই বলে একটি একপেশী, অর্ধসত্য, বিদ্বেষে পরিপূর্ণ ছবির প্রচারে যখন একটি দেশের প্রধনমন্ত্রীকে দেখা যায় সেটা অবশ্যই চিন্তারতো বটেই।

Leave a Response