আরবি হিজাব শব্দের বাংলা তরজমা “একটি অন্তঃপট বা পর্দা”। পবিত্র কুরআন নারী ও পুরুষদের পার্থক্য করতে পুরুষদের দৃষ্টি অবনত রাখার মধ্য দিয়ে পর্দার নির্দেশ প্রদান করেছে এবং নারীদের হিজাবে আবৃত থাকাকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে। হিজাব নারীর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে মুহসিনিন অর্থাৎ পবিত্র নারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। এই হিজাব নিয়ে অবশ্য অসংখ্য প্রশ্ন আছে এবং হিজাব নারীকে বন্দি করে রাখার কৌশল বলে প্রচারের অন্ত নেই।
আজ বিশ্ব হিজাব দিবস। হিজাব দিবস পালনের নেপথ্যে আছে অনুপ্রেরণার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা। নিউইয়র্কের হিজাব ব্যবহারকারী নারী নাজমা খান হিজাব পরিধানের কারণে বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের স্বীকার হয়েছিলেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি তার পরিবারের সাথে আমেরিকাতে আসেন। কৈশরকাল থেকেই হিজাব পরিধানের কারণে শিক্ষাজীবনে তিনি প্রায়ই নিগ্রহ ও অপমানের শিকার হয়েছেন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ভয়াবহ ঘটনা বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়ার দহনে নতুন করে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। তারপর থেকে হিজাবী নাজমা খানের উপর নিগ্রহের মাত্রা নতুন রূপ লাভ করে। প্রতিদিনই রাস্তায় চলতে গেলে গিয়ে তাঁকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো। আলজাজিরার একটি ইন্টারভিউয়ে তিনি তাঁর উপর নিগ্রহের উদাহরণ পেশ করেন।
“রাস্তায় আমাকে ধাওয়া করা হত, থুতু নিক্ষেপ করা হত, রাস্তায় ঘিরে লোকজন বিভিন্নভাবে গালমন্দ করতো এমনকি আমাকে সন্ত্রাসী, ওসামা বিন লাদেন ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকা হত।”
নাজমা খান হিজাব ব্যবহারের কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন মুসলিম নারীদেরকে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলকে আহবান জানান। তাদের অভিজ্ঞতা পড়ার পর নাজমা খান আবেগ ও আপ্লুত হয়ে জানান, “আমি যেনো আমার বোনদের মধ্যে আমার নিজের অভিজ্ঞতাকেই খুঁজে পাচ্ছি।” এই সময়েই তিনি বিশ্বব্যাপী বিশ্ব হিজাব দিবস হিসেবে একটি দিন পালনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রতিবছরই ১লা ফেব্রুয়ারী নাজমা খান “ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে” নামক নতুন সংগঠনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্বাসের নারীদের মুসলিম নারীদের সাথে সংহতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে একদিনের জন্য হিজাব পরিধানের আহ্বান করেন।
“ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে” সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট নাজমা খান একদিনের জন্য এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন নারীদের কাছে এই বার্তাই পৌছে দিয়েছেন যে, মুসলিম নারীর তাদের থেকে ভিন্ন কিছু নই। ২০১৩ সালে সূচনার পর থেকে বর্তমানে সারাবিশ্বে ১৯০টি দেশে এই হিজাব দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিশ্ব হিজাব দিবস পালনের মাধ্যমে তাদের বর্তমান নাজমা খান ও বিশ্বব্যাপী তাঁর সাথীদের লক্ষ্য হচ্ছে হিজাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং এর শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও হিজাবে আবৃত হওয়ার জন্য মুসলিম নারীদের প্রতি উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও মুক্তমনারা বিভিন্ন সময়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক কর্ণাটকের উডুপির একটি কলেজে হিজাব পরিধান করার অপরাধে ক্লাসে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। হিজাবি সেই বোনেরা প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে স্কুলের বারান্দায় ও সিঁড়িতে বসে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। কলকাতার যাদবপুর ও দমদমের মত শিল্প ও সংস্কৃতির উঠোনে হিজাব পরিধান করা মুসলিম মহিলাদের ঘর ও মেস ভাড়া দেওয়া হয়না। ডিজিটাল দুনিয়ায় মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির শিখরে অবস্থানের দাবি করে থাকে। তবুও মুসলিমদের হিজাব পরিধানের নিজস্ব পছন্দটাকে কোন মতেই মেনে নিতে পারেনি। পরিশেষে একটি বাস্তব প্রশ্ন আজ খুবই প্রাসঙ্গিক- তোমার দেহ প্রদর্শনের স্বাধীনতা থাকলে, আমার হিজাবে আবৃত হওয়ার স্বাধীনতা থাকবে না কেন?
আজ হিজাব দিবসের এই শুভক্ষণে স্যালুট জানাই নাজমা খানকে যিনি স্পষ্টত ঘোষণা দিয়েছেন, “হিজাব শুধু একটুকরো কাপড়ই নয় যা দ্বারা আমি মাথা ঢাকবো। হিজাব বরং আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় আমি কে।”