সেক খালিদ আলি
আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করতে গিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শে মাধ্যমে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন৷ এর দ্বারা তিনি মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।
উপদেষ্টা পরিষদের ইসলামী পরিভাষা হল ‘মজলিসে শূরা’। মজলিস অর্থ-সভা, সমিতি, পরিষদ, সংস্থা ইত্যাদি। আর ‘শুরা’ অর্থ পরামর্শ। সুতরাং মজলিসে শূরার অর্থ হচ্ছে-পরামর্শ পরিষদ।- এ পর্যায়ে একটি সাধারণ পরিষদ এখানে অধিকাংশের অংশগ্রহণ থাকে।এবং একটি উচ্চ পরিষদ যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ থাকবেন।
পরামর্শ বা মতবিনিময় সামষ্টিক জীবনের একটি চিরাচরিত রীতি ও প্রচলিত পন্থা যা একটি যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হিসাবেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। মানুষের সামাজিক ও জীবন ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ সবসময়ই অবিচ্ছেদ্য হয়ে আসছে। এমনকি অত্যন্ত স্বৈরতান্ত্রিক শাসকবর্গও সময়ে সময়ে জনসাধারণকে তুষ্ট ও শান্ত করতে এবং নিজেদের স্বেচ্ছাচার ও একগুঁয়ে মনোভাবজনিত ভুলভ্রান্তি হ্রাস করার জন্য পরামর্শের ব্যবস্থা করে থাকে।
মানবসমাজ যখন এককেন্দ্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাসে তখন থেকে পরামর্শ বা মতবিনিময়ের ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়।মানবেতিহাসে অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ ও মতবিনিময় কেবল সামষ্টিক জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অন্যের সুষ্ঠু মত ও চিন্তা থেকে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন যাপনেও পরামর্শের নীতি অনুসরণ করে থাকে। ইসলাম অপরাপর জাতির গঠনমূলক ও ইতিবাচক রীতিপ্রথার প্রতি অনুমোদন দিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ও সৃষ্টিশীল সামাজিক নিয়ম-কানুনকে গ্রহণ ও সংরক্ষণের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই এই খোদায়ী ধর্ম পরামর্শ ও মতবিনিময়ের নীতিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি যৌক্তিক পদ্ধতি এবং কল্যাণকর সামজিক রীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে।
ইসলাম একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান যা খোদাভীরু লোকদের মতবিনিময়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কোন বিশেষ শ্রেণি বা গ্রুপের প্রাধান্য এর প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং এই ব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ এক বিকল্প ব্যবস্থা।এই ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সুনিশ্চিত করে থাকে। তাই এই ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই পরামর্শ বা মতবিনিময়ের নীতিকে পাশ কাটিয়ে যায় না; বরং একে একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা অপরিহার্য বলে মনে করে।পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-কে মুসলমানদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে সামাজিক বিষয় পরিচালনার একটি নির্দেশাত্মক আহ্বান জানিয়েছে। কুরআন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে এবং পরামর্শকে সাফল্যের চাবিকাঠি আখ্যায়িত করে সহযোদ্ধা ও স্বধর্ম অনুসারীদের সাথে পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বলেছে। সূরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলে, যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।’
অন্যদের সাথে পরামর্শ করা ছিল মহানবী (সা.)-এর একটি স্থায়ী নীতি – উল্লেখ্য যে, মহানবীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, কথা ও কাজের মধ্যে ঝকঝকে আয়নার মতো কুরআনই প্রতিবিম্বিত হয়েছে এবং তাঁর জীবনাচারের মধ্য দিয়ে খোদায়ী হুকুম ও কুরআনী নীতিমালা প্রকাশিত ও মূর্ত হয়েছে।
মহানবী (সা.) যেসব উপলক্ষে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন, যেমন বদর, খন্দক এবং তায়েফের লোকদের সঙ্গে চুক্তিস্বাক্ষর প্রভৃতি- ইসলামের ইতিহাসের কোন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর কর্তৃক পরামর্শের নীতি অনুসরণ এবং তার প্রতি গুরুত্ব আরোপের বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলেননি।
ইসলাম নির্দেশিত এই পরামর্শ ব্যবস্থা নিজ পরিবার,সমাজ,সংগঠন,রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি পরামর্শ ব্যবস্থা দূর্বল হয় তাহলে পারিবারিক কলহ,সামাজিক অশান্তি,রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা,সাংগঠনিক ক্ষেত্রে পারস্পারিক সম্পর্কের অবনতি,পরনিন্দা,পরচর্চা দিনের পরদিন বৃদ্ধি পাবে।এমনকি একটি আদর্শবাদী সংগনেরও পরিকাঠামো ভেঙ্গে পড়া অবশ্যম্ভাবী।
পরামর্শদাতা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য
ইসলামে পরামর্শের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হলেও ইসলামী শিক্ষার আলোকে তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে পরামর্শ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। ওই তিন শ্রেণির মানুষ হলো- ভীতু, লোভী ও কৃপণ।
ভীতু ও কাপুরুষ লোকেরা দের সঙ্গে পরামর্শ করতে নিষেধ করা হয়েছে এ কারণে যে, তারা অতিরিক্ত ভয়ের কারণে কখনোই কোনো ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। কাপুরুষতা মানুষের আত্মবিশ্বাস, ঈমানের দুর্বলতা ও অক্ষমতার প্রমাণ বহন করে। এগুলো মানুষের খারাপ বৈশিষ্ট্য।
অভিজ্ঞ ইসলামি চিন্তাবিদের অভিমত হলো, ভীরু লোকের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই। কেননা সে বিপদে পড়লে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। কৃপণ লোকের সঙ্গেও পরামর্শ করতে নেই। কেননা সে অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। আর লোভীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই, কেননা সে লোভ-লালসাকে সবসময় বড় করে দেখে। সুতরাং এমন লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে নেই।
হযরত আলী (আ.) বলেছেন – ‘বিজ্ঞ আলেম, বিশেষজ্ঞ ও খোদাভীরু দূরদর্শী ব্যক্তিই সর্বোত্তম পরামর্শদাতা।’
পরামর্শ বা মত বিনিময়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়-
♦ বুদ্ধিমত্তার সাথে পরামর্শ করাই দূরদর্শিতা।
♦ পরামর্শের সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তোমার মত ব্যক্ত কর।- ইবনে মাজা
♦ কল্যান কামনার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দেওয়া।কারণ দ্বীন মানে হল সর্বক্ষত্রে কল্যাণ কামনা করা। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, হে আলী! আল্লাহর কাছে ভালোর প্রত্যাশী কেউ বিপথে পরিচালিত হয় না এবং মতবিনিময়ের সময় যারা সৎ পরামর্শ করে তাদের অনুতাপ করতে হয় না।
♦ অকল্যাণকর পরামর্শ প্রদান করা থেকে বিরত থাকা হাদীসে বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে এমন কাজের পরামর্শ দিল যে সম্পর্কে সে জানে যে এর বিপরীতে কাজে কল্যাণ রয়েছে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। -এর বিপরীতে বলা হয়েছে তোমার ঈমানদার ভাইকে জ্ঞান দিয়ে সাহায্য কর, যা তাকে দিক-নির্দেশনা দেবে এবং তোমার মত ব্যক্ত কর, যা কাজকে সংহত করবে।
♦ সংখ্যগরিষ্ঠ মতকে মান্যতা দেওয়া -রাসুলুল্লাহ (সঃ) তিনটি ধ্বংসকারী বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো নিজের মতকে অগ্রাধিকার দেওয়া।আর এটি সব সর্বাধিক ভয়াবহ।