সাবিরুল ইসলাম
নাম শুনে যতটুকু অনুমান করা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে গঠিত এই বইটি। বইটি পড়ার আগে মনে হবে এখানে শুধু এরদোয়ানের জীবনী-কিন্তু না, এখানে সেই ১২৯৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত তুরস্কের নানা উত্থান পতন নিয়ে আলোচিত হয়েছে। সত্যের পথে অবিচল থাকলে বিজয় যে নিশ্চিত, বইটি তারই এক দলিল। বই’টি আপনি যখন পড়বেন, এর ঘটনার ঘনঘটায় আপনার মনে হবে এগুলো যেন স্বপ্ন বা অলৌকিক এবং আবেগময় কিন্তু পুরোটাই বাস্তব -একটি দেশ একটি নেতা মুসলিম বিশ্বে আবির্ভাব হওয়া একটি নতুন মহানায়কের জীবন। তাঁকে নিয়ে একেবারে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বই’টি ৫টি পার্টে সাজানো হয়েছে…….
পার্ট-১
প্রাথমিক জীবন:-
গুনেইসুর ছোট এক মহল্লার নাম মেরকেজ মহল্লা, সেখানেই বসবাস ছিলো এরদোয়ান বংশের। সেখান থেকে বাবা আহমদ এরদোয়ানের ইস্তামবুল চলে আসা, তার দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তাঁর জন্ম (রেজেপ তায়্যিব এরদোয়ান) থেকে শুরু করে তাঁর শিক্ষা জীবন, ফুটবলার জীবন, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে বাজারে রুটি, পানি, লেবু বিক্রিসহ ইসলামিক ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া এবং সাব-লেফটেনেন্ট হিসাবে সামরিক প্রশিক্ষন সম্পন্ন করা পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এ অধ্যায়ে।
পার্ট-২
আধুনিক তুরস্কের রাজনীতি :-
এই অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ১২৯৯ সালে উসমানি খেলাফতের গোড়াপত্তন ও তার বিস্তৃতি ঘটা- শিক্ষা, গবেষনা, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির মত সুপার পাওয়ারে অধিকারি হয়ে ওঠা এবং পশ্চিমাদের উদারবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার উসমানি খিলাফতে হানা দেয়া, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে ব্যপক পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা- যার ফলে ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২ টি সরকার গঠিত হয় যার কোনটি গড়ে ৫মাসের বেশি স্থায়ী না হওয়া । তুরস্কের সিমানাটুকু নিতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, গ্রিস, ও রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সরাসরি ও পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, দেশিও বামদের হাতে ক্ষমতা এবং ১৯২২ সালে উসমানি খেলাফাতের বিলুপ্তির ঘোষণার ইতিহাস জ্ঞাত পরিসরে লেখক তুলে ধরেছেন।
… তারপর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ক গড়ার নামে ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদের আমদানি, উসমানি খেলাফাতের মাদ্রাসা বন্ধ, ইসলামি পোশাক,কৃষ্টি-কালচার বাদ দিয়ে পশ্চিমা নোংরা কালচার আমদানি, চুড়ান্তভাবে সংবিধানে ইসলামি আইন বিলুপ্ত, উসমানি খিলাফাতের ইতিহাস মুছার জন্য ভাষার পরিবর্তন করে আরবি হরফ থেকে ল্যাটিন হরফ করা, জামায়াতে নামাজ ও আরবিতে আজান দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা, নারীদের পর্দার ব্যপারে বাধাদান আর প্রতিবাদী নানা দলের ওপর নজরদারী-নেতা কর্মীদের গ্রেফতার, কারাবন্দি ইত্যাদি ইত্যাদি কুকর্মের কথাও উঠে এসেছে এখানে।
পার্ট-৩
মূলরাজনীতিতে এরদোয়ান,
ইস্তাম্বুলের মেয়র ও কারাবরণ:-
এই অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ এমন-
– ১৯৮০ সালের ক্যু-এ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলেও এরদোয়ান কৌশলগতভাবে তার কাজ চালিয়ে যান।
– ১৯৮৪ সালে রেফা পার্টির বেইয়্যুলু জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এরদোয়ান বেইয়্যুলু পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নির্বাচনী কৌশল ও দাওয়াতিকাজের মাধ্যমে শূন্য থেকে রেফা পার্টিকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করান।
– দলের প্রধানদের অমত থাকা সত্ত্বেও জোরজবরদস্তি করে এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের মত জেহেপে-এর শক্তিশালি জায়গায় মেয়র পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন।
– এদোয়ানের মেয়র প্রার্থী হিসাবে আগমন।
– উন্নয়নের দুরবস্থা ও জনগনের করুন দুর্দশা আর ক্ষোভের পরিস্থিতিতে ইস্তাম্বুল নিয়ে পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগনের সামনে হাজির হন।
– তিনি নির্বাচনে ১লক্ষের অধিক ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
– ক্ষমতার ১০০দিনের মধ্যে ইস্তাম্বুল কে এতোটাই পরিবর্তন করে যে, এর আগে যারা ইস্তাম্বুলে এসেছিলো তারা পরবর্তিতে এসে চিনতে কষ্ট হয়ে গেছিলো। পরিষ্কার রাস্তাঘাট, পার্ক- বাগান, পানি শূন্যতা রোধ ও গ্যাসের সমস্যা সমাধান ইত্যাদিতে অল্পদিনে পুরো তুরস্কে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
– শুরু হয় নতুন তুর্কির চেইঞ্জ মেকিং।
– প্রিয় পাঠক! এখানে পাবেন -১৯৯৭ সালে এক সমাবেশে কবিতা আবৃতিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রদোহী মামলা, ১২০ দিনের কারাজীবন…।
পার্ট-৪
একে পার্টি গঠন, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী
ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন:-
এ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে-
– যখন তুরস্কের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন ফাজিলত পার্টির অর্ধেক, আনাভাতান পার্টি, জেহেপেসহ আর দুইএকটি দলের এমপি মিলে ৫৫ জন এমপি একে পার্টিতে যোগ দিলো।
– এরদোয়ান প্রতিটি জেলায় জেলায় সফর করে ও জনসভা করে। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অতচ তিনি তখনও রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
– কোন ভাবেই আদালত তার পক্ষে রায় দিচ্ছে না বরং তাকে ছয় মাসের মধ্যে পার্টি থেকে বের করে দেয়ার জন্য আদালত চিঠি পাঠায়। তিনি আদালতে কোন নোটিশ তোয়াক্কা না করে তার কাজ চালিয়ে যায় পুরোদমে এবং বলতেন আমি জয়ি হবোই।
– একদিকে যেমন মিডিয়ার প্রচার চলছে এরদোয়ানের রাজনীতি নিষিদ্ধ অন্যদিকে তার কাজের স্প্রিট বাড়াতে লাগলো।
– কোন ভাবেই নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারছেন না এদিকে আবার নির্বাচনও চলে আসলো।
– অতপর আল্লাহর রহমতে ঐতিহাসিক জয়ের মাধ্যমে এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী…!
– শুরু হলো ভিশন ২০২৩ বাস্তবয়নে নিরন্তর ছুটে চলা।
রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা, ধর্মীয় কার্যক্রমের প্রসার প্রচার এবং নারী সমাজের বহু আকাঙ্ক্ষিত এক স্বাধীনতা হিজাব পরতে পারলো। আবার ধর্মীয় কাজ বাস্তবায়নের কারনে পার্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।। কিন্তু জনগনের মাধ্যমে রক্ষা পায়। জনগনের কাছে সফলতার ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়ে আব্দুল্লাহ গুলের পর তিনি সরাসরি জনগনের ভোটের মাধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। এরদোয়ান তুরস্কের সকল প্রকার অরাজকতা, সহিনসতা মুক্তির এক বাহুতে পরিনত হয়।।
পার্ট-৫
১৫ জুলাইয়ের ক্যু, বিশ্ব রাজনীতি ও নেতৃত্বের গুনাবলী:-
১৫ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ক্যু ব্যর্থ হয় এবং বিশ্ব রাজনীতিতে একে পার্টির পরিচিত হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হয়। এতো কিছু অর্জন শুধু মাত্র একটা গুনেই সম্ভব তাহলো নেতৃত্বের অসাধারন গুনাবলি। তার গুনের মধ্যে অন্যতম হলো আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, প্রচুর অধ্যায়ন, পরামর্শভিত্তিক কাজ, কাজের তত্ত্বাবধায়ন, পরিশ্রম, সহজ সরল জীবন ও যুবকদের প্রাধান্য-এসব নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে লেখক হাফিজুর রহমানের কলমে।
আর হ্যাঁ !
এ অধ্যায়ে এসে আপনারও মনে পড়ে যাবে কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যখন সারারাত কৌতূহল আর উৎকন্ঠায় জেগে ছিলাম-
– রাত ১০.৩০ মিনিটে গোলাগুলির শব্দ, রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি।
– রাত ১২টার পরে টিভি থেকে ঘোষনা এলো সেনাবাহিনীর একটি অংশ ক্যু করেছে।
-পারিবারিক সফরে থাকা এরদোয়ান ১২.৩০ মিনিটে ৪/৫ মিনিট স্কাইপিতে জনগনকে সেনাবাহিনীর ক্যু ব্যর্থ করতে ডাক দেয়া।
-১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ঝাকেঝাকে মানুষের বেরিয়ে পড়া।
– জীবনের ঝুকি নিয়ে সত্যিকারের নেতার মত এরদোয়ানের তাৎক্ষনিক হেলিকেপ্টরে চলে আসা।
– ট্যাঙ্কের সামনে খালি হাতে জনগনের প্রতিবাদ… ঐতিহাসিক গতন্ত্রের জয়…
হ্যাঁ ! ১৫ই জুলাই ক্যু-এ আপনার না জানা সব কথা, কৌতুহল এবং ঘটনার বিষদ-বিস্তারিত প্রকাশ একমাত্র এই বই’তেই আপনি পেয়ে যাবেন। বইটি প্রকাশের পরপরই তুর্কি সিনেটে/লোকসভায় লেখক হাফিজুর রহমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের হাতে বইটি তুলে দিয়েছেন; অবশ্য লেখকেও কুর্নিশ করতে ভোলেননি এই মহানায়ক।
বইটিতে এরদোয়ানের কিছু অসাধারন বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে যেমন-
“আমরা শিয়া কিংবা সুন্নি নামে কোন ধর্ম জানি না। আমাদের একটি মাত্র ধর্ম, আর তা হলো ইসলাম। আমরা ইসলামের সেই ঐক্যের ছায়াতলে একত্রিত হব…।”
এরদোগান দ্যা চেঞ্জ মেকার
লেখক – হাফিজুর রহমান
প্রকাশনি- গার্ডিযান পাবলিকেশন
পৃষ্ঠা“ – ৩০৪
মূদ্রিত মূল্য“ – ৪০০ টাকা
০৩৩-২২৬৪৫৯৫২
লেখক – সাব-এডিটর, সাপ্তাহিক মীযান