মুহাম্মদ মইদুল ইসলাম
ছোট থেকে একটা স্বভাব আমার এখনও যায়নি সেটা হল আমি এখনও কোনো কোনো দিন উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। দু-চার দিন ছুটি পেলেই এই রকম করি। কি জানি আমার মনের মধ্যে বরাবরই একটা অজানা জিনিসকে জানা ও অচেনা জায়গাকে চেনার বা দেখার নেশা কাজ করে।এর মধ্যে আছে আসলে এক অন্য অনুভুতি , অন্য রোমাঞ্চ- যা সবাই বুঝবে না। আর সব কথা অত ব্যক্ত করাও যায় না।
ঐ রকমই আজকেও ঘুরতে ঘুরতে এসে গেছি আমি কালুখালীর ঘাটের কাছে। ঘাটের ওপারটিতে বেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ও সিনসিনারি দেখতে পাচ্ছি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওপারটাই যাওয়ার খুব লোভ হচ্ছে । ওপারে যেতে হলে নৌকোয় চেপে ঘাট পার হতে হবে। ঘাটে দেখছি একটি নৌকা বাঁধা –কিন্তু তা চালাবার এই মুহুর্তে কেউ নেই। আমি নদীর একেবারে তীরে এসে দাড়িয়ে আছি। দেখছি এখানকার মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলি। অনতিদূরেই দেখতে পাচ্ছি পাড়ার কিছু ছেলে-পিলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে। এসব আমি দেখছি তো দেখছিই । যেদিকে তাকিয়ে আছি অনেক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে থাকছি। এমন সময় হঠাৎ একটি লাল কাঁকড়া আমার পায়ের আঙ্গুলে বেশ শক্ত করে কাঁমড়ে ধরেছে। আমি তখন বেশ ভয় আর যন্ত্রণায় লজ্জা করতে করতে হলেও উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার গলার ভয়ার্ত আওয়াজে একটি কিশোরী মেয়ে দৌড়ে ছুটে এল আমার কাছে। সে কাঁকড়াটে হাত দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে দূরে পাকসাটা দিল। তারপর পাশের একটি ঝোপ মত জায়গা থেকে এক দৌড়ে কচুর ডগা তুলে নিয়ে এল। তারপর সেই কচুর ডগার রস আমার সেই ছেঁড়া জায়গাটাতে লাগিয়ে দিল। আমি কিশোরী মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। খুব চেনা চেনা লাগল। গ্রাম্য সরলতা ও এক অকৃত্তিম মায়া মাখানো তার মুখের আদলে-কেমন মেঠো মেঠো ভাব- যা আজকের সময়ে বিলুপ্তপ্রায়।
-“আপনি কি ওপারে যাবেন?”- জিজ্ঞাসা করল সেই মেয়েটি।
-“হ্যা যেতে তো চাই – কিন্তু এই নৌকার মাঝি কে তো দেখছিনা, কে চালাবে নৌকা?’ নৌকার দিকে ইশারা করে বললাম আমি।
-‘আমি চালাব- আপনি উঠে পড়ুন’
-‘তুমি বাচ্চা মেয়ে নৌকা চালাবে কি বলছ?’
-‘নৌকায় উঠে বসুন তো , তারপর দেখুন চালাতে পারি কিনা!’ ফরফর করে কথাগুলি বলল চটপটে কিশোরী মেয়েটি।
আমি অগত্যা বসেই গেলাম নৌকাতে উঠে। সে আমাকে নিয়ে বেশ দ্রুতই চলতে শুরু করে দিল। জোরে জোরে নৌকার দাঁড় টেনে চলেছে সে।
-‘এটি আমাদেরই নৌকা- বাবা থেতে গেছে। একটু পরেই চলে আসবে ।’ বলল মেয়েটি।
-‘ ও তাই ? সেই জন্যে তোমার কোনো ভয় নেই।’বললাম আমি।
-‘ আপনি আমাকে এখনও চিনতে পারেন নি , না?’ প্রশ্ন করল মেয়েটি।
-‘ আমি তোমাকে চিনতে পারিনি ঠিকই –কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে এর আগে কোথায় দেখেছি!’
-‘মনে করতে পারছেন না তাই তো? আমরা আর এমন কী যে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে? কিন্তু আমরা অনেককেই মনে রাখি -এবং ভালো করেই রাখি। কোনো দিন ভুলি না-যেমন আপনাকেও ভুলব না কোনো দিন’
এ কোন কথা বলছে মেয়েটি? এই বয়সের একজন কিশোরী মেয়ে এ কেমন মর্মস্পর্শি কথা বলল আমাকে! এমন করে কথা সে কেন বলল এর সূত্র বা উৎস কি তা আমি আপাতত খুঁজে পেলাম না। কিন্তু মেয়েটির এমন ব্যবহার আর তার কথা শুনে তার প্রতি এক প্রকারের আবেগ আমাকেও যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল। তারপর আমি বললাম- ‘তুমি কি আমাকে সত্যিই চেন খুকী? কি ব্যাপার আমি কিছু বুঝতে পারছি না-তোমার কথা-বাত্রা শুনে……….।’
-‘দেখুন, গতবারের বন্যায় আমাদের এই গ্রাম যখন পুরো ভেসে গিয়েছিল –তখন আমরা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম কুঠিবাড়ীর চরের সেই প্রায়মারী স্কুলে। সেখানে স্কুলের একটি রুমে আমরা থাকতাম। ওখানেই আপনাকে বেশ কয়েকবার দেখেছি।’
-‘হ্যা হ্যা , ওখানে আমরা গত বছর বন্যা-পীড়িতদের মাঝে ত্রান বিতরণের কাজ করেছিলাম- মনে পড়ে।’
-‘ঠিক বলেছেন- ঐ খানে সেই ত্রাণ নেওয়ার জন্য আমিও লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিন খুব রোদ ছিল। আমি লাইনের অনেক পেছনেই ছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে পেছন থেকে টেনে এনে অনেক আগেই ত্রাণ-কিট দিয়ে দিয়েছিলেন।’
-তাই , বাব্বাহঃ এত কথা তোমার মনে আছে?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি। এবার আমারও স্মৃতি-ফলকে অনেক কথা জেগে উঠতে লাগল।
-‘ জানেন, সেদিন আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম।’
-‘কেন কেন এর মধ্যে আবার তোমার দুঃখ পাওয়ার কি ছিল?
-‘ঐ যে লাইনের অনেক পেছনে থাকার পরেও আপনি আমাকে একটি বাচ্চা মেয়ে বলে আগেই ত্রাণ দিয়ে দিলেন, এতে করে আগে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলির অনেকেই আপনাকে কঠিন গালাগালি করেছিল – একেবারে গোলমাল পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিয়েছিল! সেদিন আমার জন্য আপনাকে ঐ ভাবে অপমানিত হতে দেখে বড়ই দুঃখ পেয়েছিলাম আমি।’
‘ওহ হো ঐখানে তুমিও ছিলে? আর তোমার তো দেখছি সব কথা মনে আছে। দেখ এটাই তো সমস্যা আমাদের দেশের- প্রয়োজন সবার থাকলেও তার রকম-ফের যে এক নয় সেটা বোঝে ক’জন ?’ বললাম আমি।
কথা বলতে বলতে ঘাটের কাছে চলে এসেছি। মেয়েটি বেশ সুনিপুন ভাবে ঘাটে নৌকাটা ভিড়িয়ে দিল। আমি তাকে পারানি কত লাগবে জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমার সামনে হাত জোড় করে প্রণাম করার মত করে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল-‘কাকু আমাদের এতটা অকৃতজ্ঞ ভাববেন না প্লিজ।’
আমি তার হাতে টাকা গুঁজে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। সে তার হাত নিজের বুকের কাছে দুমড়ে ধরে নিয়ে কুঁকড়ে ঘুরে গেল। টাকা সে কিছুতেই ধরবে না। কি আর করব আমি-নৌকা থেকে অগত্যা নেমে পড়লাম। আমি এবার ঘাটের খাড়া পাহাড়ি বেয়ে উপরের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। আমার সামনে দিয়েই একটি লোক বেরিয়ে গেল। লোকটি গিয়ে সোজা ঐ মেয়েটির নৌকায় উঠল। হতে পারে সে ঐ মেয়েটির বাবা। তারপর মেয়েটির সাথে দু’একটি কথা হতে না হতেই মেয়েটির গালে লোকটা পটাপট চড় কষল। তারপর বলল-‘তুই মাংনা পার করিস লোককে? উডা তোর কে হয়? উজকার তো করতে হয় না? প্যাটের ভরাডা যে কত থাক্যা আসে তা তো জানো না!’
আমি ভীষণ বিচলিত হয়ে উঠলাম। আমি লজ্জায় না মেয়েটির কাছে আসতে পারলাম। আর না তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে যেতে পারলাম। ঘাটের সেই খাড়া পাহাড়িতে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলাম। লক্ষ করে দেখলাম মেয়েটি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে – সে আসলে এভাবে করে বোঝার চেষ্টা করছে যে, আমি তার বাবার হাতে তার মার খাওয়া দেখে ফেললাম কি না। সে সময় আমিও আমার দৃষ্টিকে অযথায় এদিক ওদিক এমন ভাবে ঘুরিয়েছি যাতে সে ভাবে যে, আমি তার মার খাওয়া বা অপমান হওয়া কিছুই দেখিনি। হতে পারে এতে করে খুব সামান্য হলেও তার কষ্ট কম হবে!কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে কষ্ট ও অপমান আমি অনুভব করলাম তা লাঘব করার আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না।নিজেকে বড়ই হতভাগা বলে মনে হতে লাগল।
আমার এমনই ভাগ্য, এই মেয়েটির জন্যই এক বছর আগে ত্রাণ বিতরণের সেই ক্যাম্পে আমি অপমান সহ্য করেছিলাম। তবে সেদিন অপমান হলেও আমি ওর মধ্যেই আলাদা এক ধরণের আত্মতৃপ্তি ও আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। আর আজ? আজকের অপমানে আমার মনে হচ্ছে যেন বুক আমার চিরে চিরে গেল!