মতামত

কবি আল মাহমুদ যখন কথা সাহিত্যিক, ১ম পর্ব

862views

আবু রাইহান

বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী প্রধান আধুনিক কবি আল মাহমুদ।  কবি খ্যাতিতে বেশি ঔজ্জল্য ছড়িয়ে পড়ার ফলে পাঠকের কাছে সেভাবে মূল্যায়িত হয়নি তার কথা সাহিত্যিক সত্তা। কবি আল মাহমুদের আত্মজৈবনিক রচনা “যেভাবে বেড়ে উঠি” প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকরা তাকে একজন অসাধারণ গদ্যকার হিসাবেও আবিষ্কার করেন। বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমার পাঠ নেহাৎ কম নয়। যে ক’জন গদ্যশিল্পী শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনা করেছেন, তাদের রচনা আমি গভীরভাবে মনোযোগসহ পাঠ করেছি। আমার গদ্যভাষা নির্মাণ করেছি সেভাবেই। আমার একটা স্বতন্ত্র গদ্যভাষার পরিচয় করানোর ইচ্ছা ছিল বাংলা সাহিত্যে। 1986 সালে প্রকাশিত ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ গ্রন্থটি যথার্থ বিচারে উপন্যাস না হলেও, উপন্যাসের স্বাভাবিক কিছু লক্ষণ এতে সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে কবি আল মাহমুদ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ লেখাটিকে আপনি কি বলবেন উপন্যাস নাকি আত্মজীবনী। এই প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, এ ধরনের অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। এটাকে অনেকে ফিকশন বলছে। কিন্তু আসলে এটা আত্মজীবনী। তবে এটিকে আমি উপন্যাসই বলবো, উপন্যাস লিখেছি তবে নিজেকে নিয়ে। আমি এটা লিখে যখন আত্মজীবনী বলে দাবি করেছিলাম, তখন অনেকে বললেন যে এর মধ্যে বহু মিথ্যা আছে। কিন্তু যেই আমি বললাম এটা উপন্যাস এবং মিথ্যে আছে। তখন আবার তারাই বললেন না এটা সত্য। সত্যিই সাহিত্য সমালোচকরা বড়ই অদ্ভুত। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ উপন্যাসের নায়ক কে একটা অস্থির চিত্তের চরিত্র বলে মনে হয়েছে। এছাড়া এত অল্প বয়সী একটা বালকের উপলব্ধির মাত্রা টাকে অনেক সময় বেশ বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। এ ধরনের সমালোচনায় লেখক আল মাহমুদের অভিমত, যখন আমি ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ লিখেছি, তখন আমার বয়স ছিল 21। এই বয়সের কোনো ছেলেকে বালক বলা যায় না। সে তো তখন পূর্ণাঙ্গ যুবক।কবি আল মাহমুদ কবিতা লেখার পাশাপাশি ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘গন্ধবণিক’ এর মত অনেকগুলো ছোট গল্প লিখে ফেললেও, প্রকৃত অর্থে তার প্রথম উপন্যাস ডাহুকী প্রকাশিত হয় 1992 সালে। উপন্যাস প্রকাশিত হতে এত দেরি হওয়ার বিষয়ে লেখক আল মাহমুদ জানিয়েছিলেন, উপন্যাস লেখার জন্য গল্প লিখে হাত পাকা করা দরকার। আমি কবিতা লিখতে চেয়েছি। ছোট গল্প লিখে প্রশংসা পেলাম। আগ্রহ বাড়লো। এরপর উপন্যাস লেখার একটা তাগিদ অনুভব করলাম। যারা আমাকে ভালোবাসে সেইসব ভক্তরা উপন্যাস লেখার জন্য তাগিদ দিল। আর আমি যেহেতু সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। কাজেই গদ্য আমার ভালোই আসে। তরতর করে লিখে যেতে পারি। সব ছোট গল্পের লেখকের ই উপন্যাস লিখেছেন। ছোট গল্প লিখেছেন অথচ উপন্যাস লেখেননি এরকম লেখক খুব কম। জগতের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লেখকই তো ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ লেখক। ‘ডাহুকী’ উপন্যাসের প্রধান মহিলা চরিত্র আতেকার গ্রামে ছুটে যাওয়ার পেছনে প্রধান  কারন কি  শিকড়ের সন্ধান, নাকি অসুখী মন? এ ধরনের প্রশ্নে লেখক জানিয়েছিলেন, দুটি সত্তা এখানে কাজ করেছে। এ ধরনের একটি নারী চরিত্র আমি দেখেছি বলেই লিখেছি। একেবারেই যে বানানো তা নয়। হয়তো আমার ফ্যামিলিতে দেখেছি। আতেকার চরিত্র আকস্মিক না। তার মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের আজকের আরবান চরিত্র তৈরি হয়েছে। কিছু দিন আগেও এটা ছিল না। আগে তো গ্রামই ছিল। এর যে টানাপোড়েন এটা উপন্যাসটিতে এসেছে। ধর্মহীনতা জীবনে সুখ আনতে পারে না ‘ডাহুকী’ উপন্যাস এর লেখক হিসাবে আপনি এরকম একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন এ ধরনের প্রশ্নে লেখক আল মাহমুদ জানিয়েছেন, আমার নিজের জীবনের শেষটা তো এরকমই। আমি তো একসময় নাস্তিকতার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয় কোন সময় আমি নাস্তিক ছিলাম না। আজকে মনে হয় যখন আমি নিজেকে মারক্সিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলাম তখনও মন থেকে নাস্তিক হতে পারি নি। আমার পরিবার, আব্বা আম্মা আস্তিকই ছিলেন। এগুলো আমার কবিতায় ও প্রতিফলিত হয়েছে। আমার একটা কবিতায় আছে আমি নাস্তিক ও নই, আস্তিক ও নই। এটা এক সময় বলেছিলাম। কিন্তু আমি আস্তিক। যদি আমি নাস্তিক ও হতাম বলতে পারতাম। কিন্তু আমি যেহেতু তা ছিলাম না, দোদুল্যমান ছিলাম, সেজন্যই আমি বলেছি। একজন পতিতার আর্থিক সহায়তায় ‘ডাহুকী’ উপন্যাস এর শাহেদের পড়াশোনাকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় পাঠকের কাছে, এ ধরনের সমালোচনায় লেখক আল মাহমুদ এর বক্তব্য, যেটুকু আমি লিখেছি সেটুকু আমি দেখেছি। আমি তখন পতিতালয়ের কাছেই নবাবপুরে থাকতাম। আমি এটা দেখেছি। একটি অনাথ ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগাতে একজন পতিতা কে। দেখেছি এরকম বহু মানুষকে এরা বাঁচিয়ে রাখতে। অদ্ভুত ব্যাপার ভাবলে অবাক হতে হয়। 1992 সালে প্রকাশিত ‘ডাহুকী’ লেখক এর প্রথম সার্থক উপন্যাস। এই উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা লাভ করার ফলে লেখক এর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। ফলে পরবর্তী এক দশক ধরে আল মাহমুদের উপন্যাস  প্রতিভা ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। ‘কবি ও কোলাহল’, ‘উপমহাদেশ’ এবং ‘কাবিলের বোন’ এই তিনটি উপন্যাস একই বছরে 1993 সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পরের বছরের একমাত্র উপন্যাস ‘পুরুষ সুন্দর’। 1995 সালে প্রকাশ পায় তার আরও তিনটি উপন্যাস ‘নিশিন্দা নারী’, ‘মরু মুষিকের উপত্যকায়’ এবং ‘আগুনের মেয়ে’। এছাড়া কবি আল মাহমুদের অন্যান্য উপন্যাস গুলির মধ্যে রয়েছে ‘যে পারো ভুলিয়ে দাও’, ‘পুত্র’, ‘চেহারার চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি। “ডাহুকী’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আতেকা বানু। 38 বছরের বর্তমান আতেকা এবং তার কিশোরী কাল উপন্যাসটিতে অঙ্গাঙ্গী ভাবে উপস্থাপিত। এক কালে স্কুলে যাওয়ার সাথী কেরামত এর সঙ্গে তার প্রেম ছিল। সে প্রেমের দীপ্তি দীর্ঘদিন পর আজ রাতে কার ভেতর আকাঙ্ক্ষা ছড়ায়। উপন্যাসে অন্য যে মানুষগুলো উপস্থিত, তাদের মধ্যে আতেকার স্বামী অধ্যাপক শাহেদ, কেরামতের স্ত্রী সুফিয়া বানু এবং দর্শনের অধ্যাপক ফিরোজ প্রধান। তবে অতৃপ্ত দাম্পত্য ছাড়া উপন্যাসটিতে আরো একটি উপ কাহিনী রয়েছে, সেটি হলো অধ্যাপক শাহেদ এর শৈশব ও কৈশোর স্পর্শিত- যেখানে বেশ্যাপাড়ার একজন নারী পরম মমতায় উপস্থিত। আতেকা বানু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো এই দম্পতি কিন্তু পারিবারিক জীবনে সুখী নন। সেই কবে ছোট এক ঘটনা থেকে পৃথক শোয়া শুরু করেছিল।

চলবে…

Leave a Response