Islamইসলাম

মদিনায় নবী করিম (সা.)-এর শিক্ষার আদর্শ মডেল

201views

একসময় মুসলমানরা ছিল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকবর্তিকা। দুনিয়া তাকিয়ে থাকত তাঁদের দিকে। কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরতে হয় মদিনায়, নবী করিম (সা.)-এর যুগে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে।ভাবুন তো! চতুর্দিক অশিক্ষা, বর্বরতা আর গোত্রীয় হানাহানিতে ভরা এক আরব সমাজ। সেই মরুভূমিতে এক ব্যক্তির আহ্বানেই বদলে গেল পুরো চিত্র। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু একজন নবীই নন, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ শিক্ষকও। তাঁর হাত ধরে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল মদিনায়, তা আজও এক অনন্য মডেল হয়ে আছে। আসলে এই শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল মক্কার পর্বেই, ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক সময়ে। মক্কায় নাজিল হওয়া কোরআনের আয়াতগুলো মূলত পড়া ও লেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করে, আর মদিনায় নাজিল হওয়া আয়াতগুলো শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ও কর্মের ওপর জোর দেয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো – কোনো জাতির মাঝে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষা দেওয়া; দাওয়াত অবশ্যই শিক্ষার একটি অংশ, কিন্তু সেটিই চূড়ান্ত নয়।

হিজরতের প্রায় দু’বছর আগে এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মদিনার কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁরা নবী করিম (সা:)-এর কাছে অনুরোধ করেন, যেন তাঁদের সঙ্গে একজন শিক্ষক পাঠানো হয়, যিনি তাঁদের কোরআন শিক্ষা দেবেন, ইসলাম ব্যাখ্যা করবেন এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান শেখাবেন। তখন সা’দ ইবন আল-আস্‌ (রা.)-কে মদিনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আরও একটি বিস্ময়কর দিক হলো, বদরের যুদ্ধে বন্দি হওয়া কাফেরদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল, তাঁদের প্রতি নবী করিম (সা:) নির্দেশ দেন – প্রতিজন যেন মদিনার দশজন শিশুকে পড়া-লেখা শেখায়, তাহলেই তারা মুক্তি পাবে।

মদিনায় নবী করিম (সা:)-এর মসজিদের সঙ্গে যুক্ত একটি বিশেষ স্থাপনা ছিল ‘সুফফা’। এটি ছিল ভ্রমণকারীদের ও গৃহহীন দরিদ্রদের আশ্রয়স্থল, আবার একইসঙ্গে ছিল এক আবাসিক বিদ্যালয়। এখানে কোরআন শিক্ষা, পড়া-লেখা, ইসলামী শরিয়ত (আইন), হিফজুল কোরআন, তাজবিদ এবং অন্যান্য ইসলামি বিদ্যা নবী করিম (সা:)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দেওয়া হতো। এখানকার ছাত্ররা অবসরে শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করত।

শুধু আবাসিক ছাত্ররাই নয়, প্রচুর সংখ্যক দিনমজুর বা দিনের ছাত্রও এখানে এসে পড়াশোনা করত। সুফফার ছাত্রসংখ্যা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হতো, তবে একসময় এখানে প্রায় সত্তরজন ছাত্র ছিল বলে বর্ণিত আছে। দূর-দূরান্তের গোত্র থেকে ছাত্ররা এখানে এসে শিক্ষা গ্রহণ করত এবং পাঠ সমাপ্তির পর নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যেত। নবী করিম (সা:) প্রায়ই তাঁদের সঙ্গে একজন সাহাবিকে পাঠিয়ে দিতেন, যাতে তাঁরা নিজ গোত্রে শিক্ষা কার্যক্রম সংগঠিত করতে পারে।

সুফফা-ই ছিল না মদিনার একমাত্র শিক্ষাকেন্দ্র। অন্তত আরও নয়টি মসজিদ ছিল, যেগুলো বিদ্যালয়ের কাজও করত। এলাকার মানুষ তাঁদের সন্তানদের এসব মসজিদ-বিদ্যালয়ে পাঠাতেন। নবী করিম (সা:) মদিনার মানুষদের উৎসাহিত করতেন, তাঁরা যেন নিজেদের প্রতিবেশীর কাছ থেকে শিখে নেয় এবং শেখায়।

নবী করিম (সা:) নিয়মিতভাবে তাঁর মসজিদের শিক্ষাচক্রগুলো পরিদর্শন করতেন। কোথাও কোনো ভুল বা অসঙ্গতি দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গেই সংশোধন করতেন। তিনি একটি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন যে, কেবলমাত্র যারা কোরআন ও সুন্নাহতে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, তারাই ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করবে। ফলে মানুষ একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল কোরআন-হাদিস শেখায় এবং রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে।

নবী করিম (সা:) শিক্ষায় বিশেষায়নের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে সাহাবাদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দিতেন, যদি কেউ কোরআন শিক্ষা, তাজবিদ, গণিত কিংবা শরিয়ত বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে চায়, তবে সে যেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাহাবির কাছে যায়।

শিক্ষকদের জন্য একটি স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, তাঁরা ছাত্রদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করবেন না। উবাদাহ ইবনুস সামিত (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, তিনি সুফফায় কোরআন ও লেখা-পড়া শেখাতেন। তাঁর এক ছাত্র কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে একটি ধনুক উপহার দেয়। কিন্তু নবী করিম (সা:) তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন এ উপহার গ্রহণ না করেন।

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নবী করিম (সা:) বিদেশি ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন লোকদের প্রয়োজন বোধ করতেন। জায়েদ ইবন সাবিত (রা.) ফারসি, গ্রিক, হাবশি ও আরামাইক ভাষা শিখেছিলেন। এমনকি একবার যখন হিব্রু ভাষাজ্ঞানী কারো প্রয়োজন দেখা দিল, তখন নবী করিম (সা:)-এর নির্দেশে জায়েদ (রা.) কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হিব্রু আয়ত্ত করেন। নবী করিম (সা:)-এর পক্ষ থেকে চিঠি লেখা এবং আগত চিঠি পাঠ করা ছিল তাঁর দায়িত্ব।

সেই সময়কার পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস নিয়ে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। তবে এটুকু স্পষ্ট, সব বিদ্যালয়ে একই ধরনের পাঠ্যক্রম চালু ছিল না। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতাই ছিল মূল কেন্দ্রবিন্দু। কোরআন ও সুন্নাহর পাশাপাশি নবী করিম (সা:) তীর-ধনুক চালনা, সাঁতার, উত্তরাধিকার ভাগ করার গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, বংশতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করেছিলেন।

মেয়েরাও বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করত। আসলে বুধবারের দিনটি নবী করিম (সা:) বিশেষভাবে নারীদের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন, যেখানে তিনি তাঁদেরকে শিক্ষা দিতেন এবং তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সে সময় নারীদের জন্য সুতা কাটা একটি বিশেষ পেশা ছিল, তাই তাঁদের এ কাজও শেখানো হতো। এমনকি নবী করিম (সা:) তাঁর এক স্ত্রীকে লেখার কলা শেখানোর জন্য এক মহিলাকে নিযুক্ত করেছিলেন। নবীজির স্ত্রী আয়েশা (রা.) ছিলেন ফিকহ, ইসলামী বিদ্যা, কবিতা এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধারণ পারদর্শী।

নবী করিম (সা:) মদিনা থেকে শিক্ষকদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পাঠাতেন। প্রাদেশিক গভর্নরদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণের। তাঁদেরকে লিখিত নির্দেশ দেওয়া হতো, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত তাঁদের দায়িত্বসমূহ – যেমন কোরআন, হাদিস, ফিকহ এবং অন্যান্য ইসলামী বিদ্যার শিক্ষক নিয়োগ করা। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নবী করিম (সা:) এক জন মহাপরিদর্শক নিয়োগ করেছিলেন, যিনি বিভিন্ন জেলা ও প্রদেশ ভ্রমণ করে বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি করতেন।

ভেবে দেখলে কি বিস্ময়কর মনে হয় না – যে সময়ে আরবরা ছিল অশিক্ষা, বর্বরতা ও অমানবিক আচরণের জন্য পরিচিত, সেই সময়েই নবী করিম (সা:) এমন একটি সংগঠিত ও পদ্ধতিগত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? পরবর্তীতে অনেক উন্নতি সাধিত হলেও, শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে পরিকল্পিত ও সুসংহত রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব এক দূরদর্শী মননেরই নিদর্শন। লিখেছেন: অসীম জাভেদ

Leave a Response