প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা.-এর জন্মদিন ১২ রবিউল আওয়াল। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১০ নভেম্বর নবী সা.-এর জন্মদিন। আমরা রাসূল সা.-এর জন্মদিনটি মসজিদ-মাদ্রাসায় কিংবা গ্রাম বা শহরের মহল্লায় মঞ্চ তৈরি করে তাঁর জীবনের ওপর আলোচনা ও নাত-এ-রাসূল পেশ করার মাধ্যমে পালন করি।
নবীর জন্মদিন পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যেন তাঁর শিক্ষাকে নতুন করে আত্মস্থ করতে পারি। আর সেই সঙ্গে নবীর মানবতাবাদী আচরণ ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নবী সা.-কে অনুসরণ করি।
আসুন এবার আমরা নবীর শিক্ষাকে আমাদের জীবনে মূর্ত করে তুলতে একটু অন্যরকমভাবে উদযাপন করি। আসুন আমরা ১২ রবিউল আওয়াল বা ১০ নভেম্বর নবীর জন্মদিন থেকে পূর্ণাঙ্গ একটি সপ্তাহের প্রতিদিনকে আলাদা আলাদা কাজের জন্য বেছে নিই।
এই এক সপ্তাহ প্রিয়নবী সা.-এর বাণী ও শিক্ষা শুধু পড়ার বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যবহারিক ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করতে সক্রিয় হই। এর জন্য সাতদিনে সাতটি কার্যসূচি নেওয়া যেতে পারে। যেগুলি রাসূলুল্লাহ সা. স্বয়ং পছন্দ করতেন ও অন্যদেরও সেই কাজগুলি করার উৎসাহ দিতেন। এমনই সাতটি কর্মসূচি পুবের কলমের পাঠকদের জন্য।
১.বৃক্ষরোপণ দিবস
যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তেও তোমাদের হাতে একটি চারাগাছ থাকে, সেটি রোপণ কর।—হযরত মুহাম্মদ সা.
প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় মহানবী সা.-এর পয়গাম হল, ছোট হলেও পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা এবং অপচয় রুখতে ভালো কাজ করতে হবে। উষ্ণায়ন নিয়ে আজকের বিশ্বের সংকট মুহূর্তে এই বার্তা পরিবেশের যত্ন নেওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহা নবীর এই বার্তাকে সামনে রেখে আমাদের কিছু কাজ করা উচিত, যা পরিবেশকে পরিষ্কার ও সবুজায়ন করতে সাহায্য করবে—
- রাস্তা ও ড্রেন পরিষ্কার
- রাস্তা বা অনুমদিত ফাকা জায়গায় কিংবা বাগানে চারা গাছ লাগানোl
- চারাগাছ বিতরণ
- আশেপাশের গাছগুলি পরিষ্কার করে রাখা, পানি দেওয়া, পশুপাখি বা কীটপতঙ্গদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা।
- পরিবেশ রক্ষা ও জল সংরক্ষণের জন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়া
- পরিষ্কার পরিচ্ছনতা ও পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানো
২.প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে বেছে নিন রাসূলুল্লাহ সপ্তাহ-এর দ্বিতীয় দিনটিকে
মুহাম্মদ সা. বলেছেন, তোমরা তরকারি রান্না করার সময় বেশি করে ঝোল দাও যাতে প্রতিবেশীকেও একটু দিতে পারো।
সম্পর্ক রক্ষার প্রতি মহানবী সা. বিশেষ জোর দিয়েছেন। দেখা গেছে, পরিবার– প্রতিবেশী– সমাজ এমনকী প্রতিপক্ষের সঙ্গেও তিনি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই দিনটিতে আমরা সম্পর্ক স্থাপন এবং সম্পর্ক আরও ভালো করার জন্য উদ্যোগী হতে পারি পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে। এজন্য আমদের যা যা করা দরকার– তা হল—
- পরিবারের যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বা দূরে থাকার কারণে সম্পর্ক দূর্বল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে আবারও মনে করা, তাদের বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজনে ফোনে যোগাযোগ রাখা।
- উপহার তা যতই ছোট হোক না কেন সেটা নিয়ে প্রতিবেশী, বন্ধু ও স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
- দরিদ্র ও প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করা।
- গরমকালে ভ্রমণকারী বা পর্যটক অথবা তূষ্ণার্থ পথিকদের পানি বিতরণ করা।
৩. এতিম দিবস পালন
তুমি যদি তাদের (এতিমদের) প্রতি ক্ষমাশীল হও, তবে আল্লাহ্ তোমার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করবেন।—রাসূল মুহাম্মদ সা.
যাদের যত্ন নেওয়ার কেউ নেই, তাদের যত্নআত্তি করলে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করা যায়।রাসূলুল্লাহ সা. এতিম-অনাথ ও অসুস্থদের যত্ন ও তত্ত্বাবধান করার প্রতি জোর দিয়েছেন। যাদের কেউ ছিল না, তাদের অভিভাবক ছিলেন মুহাম্মদ সা.। এই দিনটিতে যেসব কাজ করা যেতে পারেন—
- গরিবদের খাবার, জামাকাপড়, শীতবস্ত্র বিতরণ করা
- বূদ্ধাশ্রম ও অনাথ আশ্রমে গিয়ে সময় কাটানো
- হাসপাতালে অসুস্থদের দেখতে যাওয়া ও ফল মিস্টি বিতরণ করা
- হুইলচেয়ার ও ওয়াকিং স্টিক বিতরণ করা
- দুস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও খাবার বিতরণ করা
৪. শান্তি দিবস
মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, রুঢ় হয়ো না। তাদেরকে উৎসাহিত করো, ঘৃণা কোরো না।—মুহাম্মদ সা.
ইসলাম মানে শান্তি। যাকে সালাম দেওয়া হয়, তখন তার উপর শান্তি কামনা করে দোয়া-ই করা হয়। আবার ‘সালাম’ বা শান্তি আল্লাহর একটি নাম। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই মুহাম্মদ সা. পৃথিবীতে এসেছিলেন। নবী সা.-এর সেই শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে আমরা যা করতে পারি
- সন্ত্রাস বা হিংসার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা
- স্কুলের কচিকাচাদের নিয়ে পিসওয়ার্ক।
- ইসলামের শান্তির পয়গাম নিয়ে লেখা বই বিতরণ বা বক্তব্যের আয়োজন করা
- আত্নঃধর্মীয় (ইন্টার-ফেত) আলোচনা সভা
- বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া
৫. স্বাস্থ্য-দিবস
আল্লাহর দেওয়া দু’টি নিয়ামত অনেকে অপচয় করে, একটি হল সুস্বাস্থ্য অপরটি অবসর সময়।—মুহাম্মদ সা.
স্বাস্থ্য হল আল্লাহ্প্রদত্ত অন্যতম সেরা নিয়ামত। আর অন্যকে আরোগ্য লাভে সাহায্য করা হল সেবার অন্যতম একটি পথ। মুহাম্মদ সা. এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করতেন। রোগের জন্য ওষুধ নিতে উৎসাহ দিতেন। তিনি খেজুর, মধু, কালো জিরে নিয়মিত খাওয়ার ব্যাপারে নসিহত করতেন। এগুলি যে খুবই উপকারী, তা বিজ্ঞানীরাও আজ স্বীকার করছেন। আসুন আমরা আয়োজন করি
- স্বাস্থ পরীক্ষা শিবির
- রক্তদান শিবির
- স্বাস্থ্য ও শৌচাগার সচেতনতা
- নবী সা. যেসব প্রাতূতিক ওষুধ হিসেবে খেতেন সেগুলি প্রচার ঘটানো
৬. শিক্ষা-দিবস
পিতামাতার পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য সেরা উপহার হল তাদেরকে সঠিকভাবে শিক্ষাদান করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান।—মুহাম্মদ সা.
সুশিক্ষা ছাড়া সমাজের উন্নতির জন্য আশানুরূপ কাজ করা সম্ভব নয়। কুরআন শুরু হচ্ছে ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ো শব্দ দিয়ে। সদাচারণ, বোধশক্তির উত্তরণের জন্য সঠিক শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে নবী সা. অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
- সুবিধাবঞ্চিত স্কুলে গিয়ে বই-খাতা-কলম ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ
- পুরস্কার ও স্কলারশিপ প্রদান
- স্কুলে পানীয়জলের সুবন্দোবস্থ আছে কিনা, শৌচালয় আছে কিনা ইত্যাদির খোঁজ নেওয়া
- স্কুলে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবনীর ওপর ক্যুইজ, প্রবন্ধ ও বক্তব্যের আয়োজন করা
- নারী ক্ষমতায়নের উপর সেমিনার
- শিক্ষা সচেতনতা ও কেরিয়ার কাউন্সিলিং প্রোগ্রাম
৭. প্রচার-দিবস
একটি বাক্যে হলেও আমার কথা ও শিক্ষা অপরকে জানাও।—মুহাম্মদ সা.
অন্ধকার দূর করে আলো জ্বালাতে দরকার নবী সা.-এর বাণীর বেশি বেশি প্রচার। ইসলাম নিয়ে বহু মানুষের ভুল ধারণা রয়েছে। তাই মুহাম্মদ সাল্লালাহূল আলাইহিস সালাম-এর বাণী সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নানাভাবে তাঁর শিক্ষা, বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করা যেতে পারে এই দিনটিতে।
- জনগণের সেবক অর্থাৎ পুলিশ, নার্স, দমকল কর্মীদের হাতে শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দেওয়া।
- নবী সা.-এর বাণী লেখা ব্যাজ, স্ট্যাম্প, স্টিকার ইত্যাদি বিতরণ এবং সম্ভব হলে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় লাগানো।
- নবা সা.-এর উপর কর্মশালা ও আলোচনা সভার আয়োজন।