Literature

আমার কাহাফ ভাবনা – আরিফ আজাদ

268views

ঘুম ভাঙার পর আসহাবে কাহাফের যুবকদের ভীষণরকম ক্ষুধা পেয়ে গেলো। তিনশতো নয় বছর তারা ঘুমিয়ে ছিলো— এতো লম্বা সময় পরে যখন তাদের ঘুম ভাঙলো, তখন খিদে লাগাটাই স্বাভাবিক বৈকি।

তিনশতো নয় বছর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার ইচ্ছায়, অলৌকিকভাবে তারা ঘুমিয়ে ছিলো। ফলে, তখন তাদের না খাওয়ার দরকার পড়েছে, না অন্যকিছুর। কিন্তু যখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন, তখনই অলৌকিকতার পর্দাটা তাদের ওপর থেকে সরে গেলো এবং জৈবিক সকল প্রয়োজনীয়তা সক্রিয় হতে শুরু করলো।

খিদে মেটানোর জন্য তো খাবার দরকার। কী করা যায় তাহলে?

ঠিক হলো— একজনকে তারা লোকালয়ে পাঠাবে খাবার কিনে নিয়ে আসার জন্যে। যেদিন তারা লোকালয় থেকে পালিয়েছিলো, সেদিন তাদের কেউ কেউ কিছু মুদ্রাও নিয়ে এসেছিলো সাথে করে। সেই মুদ্রাগুলো দিয়েই এবার তারা খাবার কিনতে চাচ্ছে।

ব্যাপারটা কুরআনে এভাবে এসেছে—

‘এখন তোমাদের একজনকে এই মুদ্রা সহ খাবার কিনতে পাঠিয়ে দাও। সে যেন দেখে কোন খাবারগুলো উত্তম এবং সেগুলো থেকে কিছু খাবার যেন সে কিনে নিয়ে আসে’- সুরা আল কাহাফ ১৯

কথাগুলো বলেছে ওই যুবকদলেরই একজন। দলের যেকোন একজনকে পাঠিয়ে শহর থেকে কিছু খাবার কিনে আনতেই এই তোড়জোড়।

আসহাবে কাহাফের যুবকেরা ভীষণ ক্ষুধা পেটে নিয়েও ‘উত্তম খাবারের’ কথা ভুলে যায়নি। এর কারণ কী হতে পারে?

তাফসিরে এসেছে— ওই সকল যুবকেরা ছিলো মূলত ওই সময়কার ধনাঢ্য লোকেদের সন্তান। পিতা-মাতার অঢেল ধন-সম্পদ তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি একটুও। যেহেতু ধনাঢ্য পরিবার থেকে উঠে আসা, ফলে নিত্যকার খাবারের মেনুতে তাদের ভালো ভালো খাবার থাকাই স্বাভাবিক। যেহেতু ভালো খাবার খেয়েই তারা অভ্যস্ত, সেহেতু দীর্ঘকাল পর ঘুম থেকে জেগে যখন তাদের খাবারের কথা মনে পড়লো, অভ্যেশবশতঃ হয়তো তখনও তারা ‘ভালো খাবার’ এর কথা ভুলতে পারেনি। সেজন্যেই তারা শহর থেকে ‘ভালো খাবার’ কিনে আনতে বলেছিলো।

এটা হচ্ছে একটা সম্ভাবনা। তবে, এটা যদি নিছক তাদের একটা অভ্যেশ হয়ে থাকে এবং তাতে যদি মানবজাতির জন্য কোন সুক্ষ্ম বার্তা লুকিয়ে না থাকে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ‘ভালো খাবার’ শব্দটাকে আলাদাভাবে উল্লেখ করতেন না। কারণ— আমরা জানি, কুরআন অদরকারি, অপ্রয়োজনীয় কোনোকিছুই উল্লেখ করে না। যেহেতু আয়াতটায় ‘ভালো খাবার’ শব্দদ্বয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা আছে, এর পেছনে নিশ্চয় কোন বার্তাও লুকোনো আছে। তবে, কী হতে পারে সেই বার্তা?

এখানে আমার ভাবনা দুটো:

প্রথমত, পেটে ভীষণ ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও আসহাবে কাহাফের যুবকেরা যে জিনিসটা ভুলে যায়নি সেটা হচ্ছে— উত্তম খাবার। মানে, খাবারের মধ্যে উপকারি যে খাবারটা, ওটাই তারা খেতে চায়।

কল্পনা করুন তো— আপনাকে একটা ঘরে দুদিন খাবার-দাবার ছাড়া বন্দী করে রাখা হলো। তৃতীয় দিন আপনার সামনে যদি খাওয়ার সুযোগ আসে, আপনি কি আসহাবে কাহাফের যুবকদের মতো ভাবতে পারবেন যে, আপনার আসলে উত্তম খাবারটাই খাওয়া উচিত? এমন খাবার নয় যা আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর? সম্ভবত আপনি সেটা ভাববেন না। আপনি তখন যা সামনে পান খেতে চাইবেন। কিন্তু আসহাবে কাহাফের যুবকেরা সেটা ভেবেছিলো। পেটে তীব্র ক্ষুধা নিয়েও ‘উত্তম খাবার’ খাওয়ার আগ্রহ দেখানো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে— খাবারের মেনুতে আমরা কী খাচ্ছি তা আসলে ভালো গুরুত্বের দাবি রাখে।

আমার আশপাশে যারা অবিরত ফাস্টফুড খেয়ে খেয়ে শরীরের চর্বি বাড়ায়, তাদেরকে পরেরবার দেখলে আমার আসহাবে কাহাফের যুবকদের কথাই বেশি মনে পড়বে। তাদের ধারণা— ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবারগুলো তাদের শরীরের আসলে কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু দিনশেষে এটাই ঠিক যে— ফাস্ট ফুডের একটা নেতিবাচক প্রভাব শরীরে পড়ে থাকে। হ্যাঁ, অনিয়মিত কিংবা কদাচিৎ কেউ যদি ফাস্ট ফুড খায় সেটার তেমন নেতিবাচক প্রভাব হয়তো নেই, কিন্তু দিনের পর দিন নিয়ম করে কেউ যদি ফাস্ট ফুড খেতে থাকে, তাহলে অতি-অবশ্যই বিভিন্ন রোগে ভুগবার প্রবল সম্ভাবনা তখন থেকে যায়।

রিসার্চ থেকে জানা যায়, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্ট ফুড অনেকসময় অবসন্নতা, টাইপ টু ডায়াবেটিস সহ নানান ধরণের রোগ শরীরে তৈরি করে। ফাস্ট ফুডে থাকা ট্রান্স ফ্যাট শরীরে এল ডি এল কোলেস্টেরলের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।

শরীরের জন্য উপকারি নয়, শরীরকে ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারে এমন কোন খাবারই আসলে আমাদের খাওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়, কারণ শরীরটা যদিও আমার, কিন্তু এর স্রষ্টা হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা। অন্যভাবে বলা যায়— শরীরটা আমাদের কাছে আল্লাহর দেওয়া একপ্রকার আমানত। কেউ যখন আমাদের কাছে কোন আমানত গচ্ছিত রাখে, তখন তার সংরক্ষণ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যত্ন-আত্তির করা আমাদের কর্তব্য বৈকি।

শরীর যেহেতু আমাদের কাছে আল্লাহর আমানত, সেই আমানতের ব্যাপারেও কি আমাদের সেভাবে সচেতন হতে হবে না? শরীর নামক সেই আমানতের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে ভালো খাবার-দাবার খাওয়া। এমনকিছু না খাওয়া যা আমাদের শরীরকে রোগ-শোকের দিকে ঠেলে দিবে। যদি আমরা হরহামেশাই ফাস্ট ফুড, পোঁড়া তেলে ভাজা খাবার খাই, তাহলে তা নিঃসন্দেহে ভালো নয় আমাদের শরীরের জন্য।

ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়েও আসহাবে কাহাফের যুবকেরা খাবার বাছাইয়ের আগে ভুলে যায়নি যে, তাদেরকে অতি-অবশ্যই ‘ভালো খাবারটা’ খেতে হবে, শহর থেকে যা-তা কিনে এনে খেয়ে নিলেই হবে না। শরীর যে আল্লাহর দেওয়া একটা আমানত, যা-তা খাবার খেয়ে সেই আমানতের যে ক্ষতি করা যাবে না— সেটা হয়তো তারা ভুলে যায় নি।

আয়াতটা নিয়ে আমার দ্বিতীয় আরেকটা ভাবনা আছে।

আসহাবে কাহাফের যুবকেরা তাদের জনপদ থেকে পালিয়ে গুহার মধ্যে কেনো আশ্রয় নিয়েছিলো? কারণ, তাদের গোটা জনপদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো তখন। জনপদের সবাই আল্লাহকে বাদ দিয়ে নানান উপাস্যের আরাধনা শুরু করলে, নিজেদের ঈমান বাঁচাতে তারা কতিপয় যুবক লোকালয় থেকে পালিয়ে একটা গুহায় আশ্রয় নেয় এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাদেরকে তখন এক দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেন।

লোকালয় থেকে যখন তারা পালাচ্ছিলো, তখন তারা জানতো যে, জনপদের কেউই আর মুসলিম নেই। তারা নিজেদের ঈমান হারিয়ে ফেলেছে। যেহেতু তারা তখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন উপাস্যের আরাধনা শুরু করেছে, সুতরাং জনপদের মানুষেরা যে-সব খাবার খায় বা বিক্রি করে, তার সবটাই যে হালাল হবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু, যুবকদল যেহেতু নিজেদের ঈমান বাঁচাতে পেরেছে, সেহেতু হারাম খাবার তো তারা কোনোভাবেই খেতে পারে না। তাদের খেতে হবে হালাল খাবারটাই।

হয়তো এই বোধটুকু থেকেই পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়েও তারা এটা ভুলে যায়নি যে— মুসলমান হিশেবে তাদেরকে উত্তম তথা হালাল খাবারটাই খেতে হবে। শহরের যেকোন একটা খাবার হলেই তাদের চলবে না।

এখান থেকে আমি আসলে কী শিখবো? কোন অমুসলিম জনপদ কিংবা অমুসলিম দেশে যদি আমি কখনো যাই, তাহলে খাবারের বেলায় আমি অবশ্যই যাচাই করে নেবো যে, আমি যা খাচ্ছি বা খেতে যাচ্ছি তা আসলে হালাল কি-না? মুসলিম হিশেবে হালাল খাবার খাওয়া এবং হারাম খাবার বর্জন করা আমার জন্যে অত্যাবশ্যকীয় ফরয। ইবাদাত কবুলের অন্যতম একটা শর্তই হলো এটা যে— খাবার হালাল হওয়া।

আসহাবে কাহাফের যুবকেরা প্রচণ্ড ক্ষুধা পেটে নিয়েও শরীরের জন্য ‘উত্তম খাবার’ অথবা মুসলমানিত্বের জন্যে ‘হালাল খাবার’ বেছে নিতে ভুলে যায় নি। সেই যুবকদলকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাদের জন্য অনুসরণীয় করে রেখেছেন।

সুতরাং, পরেরবার গপাগপ ফাস্ট ফুড খাওয়ার আগে, কিংবা অমুসলিম কোন দেশে গিয়ে বাছ-বিচারহীনভাবে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে যেকোন খাবার গলাধঃকরণের আগে আমরা একটু আসহাবে কাহাফের সেই যুবকদলের কথা ভাববো কি?

নিশ্চয়, আল্লাহই সর্বজ্ঞাত।

Leave a Response