অনিকেত দে
বাংলায় ইসলাম ধর্মের ইতিহাস পড়তে গেলে কয়েকটা জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। মুসলমান শাসকরা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছেন আটশো বছর ধরে, অথচ অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা উত্তর, মধ্য বা পশ্চিম ভারতের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। কেন হঠাৎ বাংলাতেই ইসলাম ধর্মের এমন প্রসার ঘটল? তার উপরে বাঙালী মুসলমানের সাংস্কৃতিক জগৎও উপমহাদেশের অন্যান্য মুসলমান সমাজের চেয়ে বেশ আলাদা। ইতিহাসগতভাবে আমাদের ধৰ্মস্থাপত্য প্রধানতঃ ধানক্ষেতের মধ্যে কুঁড়েঘরের আদলে তৈরী ছোট ছোট পোড়া ইঁটের মসজিদ, আর অসংখ্য পীর-ফকিরের মাজার। এর উপরে আছে বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয়ের উপাস্য সত্যপীর, মানিক পীর বা বনবিবির মত দেব-দেবী। সুদূর আরবদেশ থেকে আসা একটি ধর্মবাদ সুজলা বাংলায় এমন বৈচিত্রময় ধর্ম-জগত সৃষ্টি করল কেমন করে?
ইসলামে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়। সাহারা মরুভূমি থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত প্রসারিত দেড় হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি ধর্ম একমাত্রিক হওয়া সম্ভব নয়। তৌহিদ বজায় রেখেও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র হয়েছে : তাই তো তুরস্কের প্রাচীন চার্চ ও মসজিদের স্থাপত্যে তফাৎ সামান্যই, গৌড়ের মসজিদগুচ্ছের সাথে দিল্লির জামা মসজিদের তুলনায় বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দিরের মিল বেশি। তাই কেবল আজকালকার সৌদি আরব-পুষ্ট কিছু নেতার চোখে ইসলামের ইতিহাসকে দেখলে অনেক কিছুই অদেখা থেকে যাবে। মধ্যযুগের বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব ও প্রসার বুঝতে গেলে সেই সময়ের বাংলার মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করতে হবে, তাদের চোখে তাদের পৃথিবীটাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তারা কোথায় থাকত, কি খেত-পরত, সূর্যাস্তের সময় কি গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরত- তাদের রোজকার জীবনের এইসব খুঁটিনাটির থেকে ধর্মকে আলাদা করা যায় না।
বাংলার অধিকাংশ অধিবাসী কেন মুসলমান ধৰ্মগ্রহণ করল, এই বিষয়ে মোটামুটি দু-রকমের মতামত পাওয়া যায়। প্রথমটি হিন্দুত্ববাদীদের বেশ প্রিয়- মুসলমান শাসকেরা জোর করে তরবারির সাহায্যে হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছে। এই মতালম্বীরা ভাবেন না যে জোর করে কয়েক লক্ষ মানুষকে ধর্মান্তর করানো বেশ দুঃসাধ্য এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার। যুদ্ধে হারার পর কিছু হিন্দু রাজা ও তাঁদের সভাসদদের অবশ্যই বলপ্রয়োগ করে মুসলমান করা হয়েছিল, তবে সেই ব্যাখ্যা বাংলার অসংখ্য মুসলমান চাষী-জেলের সম্বন্ধে খাটে না। বরঞ্চ মুসলমান শাসকরা চাইতেন অমুসলমান প্রজা থাকুক- তাতে ক্ষমতা কয়েকজন নিকট মুসলমান অমাত্যের মধ্যে ধরে রাখা যায়, জিজিয়া-তীর্থকর প্রভৃতি করও বসানো যায়। জোর করে ইসলাম গ্রহণের তত্ত্বটি তাই ইতিহাস বা সাধারণ যুক্তি কোনটাতেই দাঁড়ায় না।
ধর্মান্তর বিষয়ে দ্বিতীয় মতটি আবার মুসলমান জাতীয়তাবাদীদের বেশি পছন্দ। তাঁরা বলেন যে, হিন্দুসমাজের জাতিভেদ ও বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে লাখে লাখে নিম্নবর্গীয় হিন্দু মুক্তির আলোর ন্যায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল।এই সামাজিক মুক্তির যুক্তিটি বসনিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মত ইসলামী দুনিয়ার অন্যান্য অংশে ধর্মান্তর প্রসঙ্গেও প্রয়োগ করা হয়। অথচ ইতিহাসে এই ব্যাখ্যাটিও টেঁকে না। হিন্দু সমাজের মত ভারতের মুসলিম সমাজে জাতিভেদ যথেষ্টই আছে – বিভিন্ন জাতের ভিন্ন প্রার্থনাগৃহও আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে হিন্দুধর্মের সাথে ইসলামের মূল ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধ বর্ণাশ্রম নয়, পৌত্তলিকতা ও একেশ্বরবাদ নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে বর্ণহিন্দুসমাজ কখনই উত্তরভারতের মত পোক্ত ছিল না, রামানন্দী বা দশনামীদের মত বলশালী সাধু সম্প্রদায় অষ্টাদশ শতকের আগে বাংলায় আসতেই পারেনি। নবদ্বীপ- ভাটপাড়ায় প্রাচীন পণ্ডিতসমাজ থাকলেও মাছখেকো বাঙালী বামুনদের গোঁড়া হিন্দুস্তানী-মারাঠী ব্রাহ্মণরা ধর্তব্যেই আনতো না। বাংলার অধিকাংশ অধিবাসী ধর্মে ছিল হয় বৌদ্ধ বা শাক্ত, পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের ভক্তি-আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে বৈষ্ণব। এরাই পরবর্তী কালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
এবার মধ্যযুগের বাংলার মুসলমান সমাজের বিস্তার আরেকটু তলিয়ে দেখি। ১২০৬ সালে তুর্কি সেনানায়ক বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণের পর থেকেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম ছড়াতে শুরু করে। তার পর প্রায় তিনশো বছর মুসলিম সমাজ সীমাবদ্ধ থাকে মূলত গৌড় চট্টগ্রাম নবদ্বীপ শ্রীহট্ট প্রভৃতি পশ্চিমবাংলার বর্ধিষ্ণু নগরগুলিতে। মুসলমান নবাব, বণিক, মহাজন, সুফী সাধক ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে সংখ্যার বিচারে তারা খুব বেশি না। ইসলাম ধর্মের প্রধান প্রসার ঘটতে শুরু করে তুর্কি আক্রমণের প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পরে, ১৫৭৫ সালে মুঘলসম্রাট আকবরের বাংলা দখলের পর। তখন পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ জলাভূমি সমেত সমগ্র বাংলাদেশ চলে গেল মুঘল দখলে, নতুন রাজধানী স্থাপিত হল ঢাকায়। সেই থেকে পরবর্তী তিনশ বছরে প্রধানত পূর্ববঙ্গে – বগুড়া, বরিশাল, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চলে- অসংখ্য চাষী ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ করে, বাংলার জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান হয়ে যায়। ১৮৭২ সালে প্রথম ব্রিটিশ জনগণনার সময় দেখা যায় যে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে- হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ, ও মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ, এমনকি পুবের কিছু জেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মালম্বী।
কেন তবে প্রধানত পূর্ববঙ্গেই ইসলাম প্রসারিত হল? কেনই বা সেই প্রসার হল সম্রাট আকবরের সময়, যে সম্রাট হিন্দুদের সমর্থন করে উলেমাদের বিরাগভাজন হতেও দ্বিধা করেননি ? এই প্রশ্নের একটি চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ঈটন, এবং এই রচনাটি ঈটনের কাছে অনেকাংশে ঋণী। ঈটন অসংখ্য মুঘল সনদ পড়ে দেখেছিলেন, মুঘল যুগে অধিকাংশ পূর্ববঙ্গই ছিল জঙ্গলে ভর্তি, আজকের সুন্দরবন তার এক ছোট্ট স্মৃতি রক্ষা করছে। ১৫০০ সালের আশেপাশে গঙ্গা তার পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো পথ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে নতুন খাতে বইতে শুরু করে, যে খাতের নাম আজ পদ্মা। নদীর এই খামখেয়ালিপনায় অনেকটা নতুন উর্বর জমি সৃষ্টি হয়। জনমানবহীন এই প্রান্তরে আকবরের নির্দেশে চাষবাস শুরু হয়। কিনতু বাঘে-কুমীরে ভরা জঙ্গলে চাষ করতে যাবে কে? ঈটনের মতে এই কাজটির জন্যে এগিয়ে আসেন বহু পীর-ফকির, এবং তাঁদের বিপুল পরিমান জমি দেন করতে শুরু করেন মুঘল সুবেদাররা। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান সকলেই এই পীরদের সাথে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেন। পীরেরা বিভিন্ন ভাবে ইসলামের বাণী প্রচার করেন, নানা কেরামত দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রমাণ করেন, এবং ওই নির্জন জঙ্গলে একাধারে যাজক-শাসক-ডাক্তার প্রভৃতির ভূমিকা পালন করেন। নতুন বসতি স্থাপনকারীরা এই সন্তদের সংস্পর্শে থেকে ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ করেন, ক্রমে তাঁদের বংশধররা আজকের বাংলার মুসলমান চাষিসমাজের জন্ম দেয়।
ঈটনের গবেষণা সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না আমাদের। মুঘল আক্রমণের আগে পূর্ববঙ্গ নিশ্চয়ই একেবারেই জনমানবশূন্য জঙ্গল ছিল না? কারা থাকত তবে সেখানে ? কেনই বা শুধু পীরেরা জঙ্গলে যেতে রাজি হলেন? সব প্রশ্নের উত্তর না জানা থাকলেও এইটুকু পরিষ্কার যে মুঘল যুগে জঙ্গলের সাফ করে পূর্ববঙ্গে কৃষি বিস্তারের সাথে বাংলার মুসলমান চাষিসমাজ সৃষ্টির একটি নিবিড় সম্বন্ধে আছে। চন্ডীমঙ্গলের মত তৎকালীন হিন্দুকাব্যও জঙ্গল কেটে চাষবাসের বিবরণ দেয়, তবে পীর-সুফীদের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার অধিকাংশ চাষি ইসলাম ধর্মই গ্রহণ করে। এই ধর্মগ্রহণ পরবর্তীকালে রাজনৈতিক তাৎপর্য পায়, কারণ ব্রিটিশ ঘাঁটি গাড়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, এবং হিন্দুদের পূর্ববঙ্গের জমিদারী প্রদান করে। কলকাতার ক্ষুদ্র হিন্দু জমিদারগোষ্ঠীর সাথে পূর্ববাংলার বৃহৎ মুসলমান কৃষকসমাজের বিরোধ প্রকট হয়েছে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে, ফজলুল হক ও আবুল মনসুর আহমেদের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা রাজনীতিতে, ও সর্বশেষে পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনে। মধ্যযুগে পুব বাংলার চাষির ইসলামায়নের সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তাই আমরা আজও বহন করে চলেছি।
প্রশ্ন জাগে, সেই সময় ইসলাম ধর্ম যাঁরা গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা তাঁদের ধর্ম বা সামাজিক জগৎটিকে কিভাবে দেখতেন? মুসলমান হওয়া মানে কি তাঁদের কাছে একেবারে নতুন এক জীবন, নাকি পূর্ব ধর্মবিশ্বাসের থেকে তেমন কিছু আলাদা নয়? কিছু উত্তর পাই সেই সময় থেকে রয়ে যাওয়া দু-একটি গ্রন্থে। ১৬০০ সালের আশেপাশে চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের সুফী সৈয়দ সুলতান নবীবংশ নামক একটি কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি নবীর একটি বংশপরিচয় ও পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের জীবনবিবরণ, আরবি সাহিত্যে যাকে কিসাস-আল-আনবিয়া। কোরান অনুসারে হজরত মহম্মদের পূর্বে ঈসা মুসা প্রভৃতি বহু পয়গম্বর এসেছিলেন। সৈয়দ সুলতান বুঝেছিলেন যে ইসলামের পয়গম্বর ও হিন্দুদের অবতার ব্যাপারদুটি অনেকটা এক রকম, অন্ততঃ মানুষকে একটা নতুন বিষয় বোঝাবার জন্য একটি সার্থক অনুবাদের মাধ্যম। সেই কাব্যে তাই সুলতান নিঃসংশয়ে মহম্মদকে দেখান বিষ্ণুর অবতার রূপে, আবার বিষ্ণুকে বর্ণনা করেন ঈশা বা মহম্মদের মত ইসলামের ঈশ্বর-প্রেরিত এক দূতের মতন করে। আরব মরুর বহু দূরে, খাল-বিল-জলার বঙ্গদেশের মানুষ তখনও আহল-এ-কেতাব নন, তাহলে তাঁদের তৌহিদ-খুৎবা-পয়গম্বর প্রভৃতি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি বোঝাবার উপায় কি? তাই সৈয়দ সুলতানের মত প্রচারকরা সেই সময় সাংস্কৃতিক অনুবাদের মাধ্যমে দুই ধর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন করেন। তাঁদের শ্রোতার জানা বিষয়গুলি অবলম্বন করে, তাদের জগৎ যতটুকু সম্ভব কম পাল্টে তাঁরা নতুন বিষয়গুলি বোঝাতে শুরু করেন।
বিশাল ঐতিহাসিক পরিবর্তন সিনেমার মত এক লহমায় হয় না, আর সতের কোটি বাঙালী মুসলমানও একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ধাপে ধাপে, বহু সুফী-সন্তের প্রয়াসের ফলে ইসলামের বাণী বাঙালি মানসে ও সমাজে স্থান পেয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায় কোরানের বাণীর আরবি আঁতুড় ত্যাগ ও বিভিন্ন সমাজের হৃদয়ে শিকড় স্থাপন। এই শিকড় তৈরিতে প্রয়োজন অনুবাদের, কারণ আজও পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানের ভাষা বা সংস্কৃতি আরবি নয়। তাই নবীকে অবতাররূপে বর্ণিত হতে দেখে আঁতকে ওঠার কোন কারণ নেই, এটি সাধারণ যুক্তিতেই একটি অনুবাদের মাধ্যম মাত্র। বাংলায় ইসলাম প্রসার লাভ করেছে কোরানের পাশাপাশি নবীবংশ, সত্যপীরের পাঁচালি, বনবিবির পালা, মানিক পীরের মেলা ও গাজী কালুর গানে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আজও হিন্দু-মুসলমান উভয়ের উপাস্য, কারণ বাংলার হিন্দু ও মুসলমান নিজেদের ধৰ্মতাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তফাৎ বুঝেও আদানপ্রদানে পারদর্শী । মধ্যযুগ থেকে দুই ধর্মের মধ্যে অনুবাদ ও কথোপকথন বাংলার এক নিজস্ব ঐতিহ্য।