ইসলাম

উনিশ শতকে ‘মুসলিম’দের শিক্ষার সংক্ষিপ্ত পশ্চাৎপট

461views

ইমানুল হক

আমাদের  (ইংরেজদের) জনশিক্ষা প্রণালী মোটেও নিম্নশ্রেণির মুসলমানদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।

                                        উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ১৮৭১

 

‘ভারতীয় বিশেষত বঙ্গবাসী ‘মুসলমান’ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ সম্পর্কে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ একাডেমিক ধারণা বা ‘ডিসকোর্স’ এর সারবত্তা অতি সংক্ষিপ্ত—মুসলমানরা নবাবি বা সাম্রাজ্য হারিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরূপ মনোভাব নেওয়ায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্তের সম্পাদ্য — এটা ইচ্ছাকৃত। ‘স্বখাত’ সলিলে ডুবে মরা। ব্যাপারটা কি সত্য-ই তাই? নাকি প্রকৃত অনুসন্ধিৎসা আর জ্ঞানচর্চার অন্যতর অনুশীলন এই সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে সূক্ষ্ম সুপ্ত সাম্প্রদায়িক মন ও মননকে- যা আসলে তার অনিবার্য অজ্ঞাত বিক্ষেপণ!

ইসলাম নিছক কোন অধ্যাত্মবাদী নিভৃতচারী ধর্ম নয়। জীবন ও জীবিকাকে বাদ দিয়ে শুধু ঈশ্বরের নাম ভজনা তার নীতির বিরোধী। পুরোহিত বা পাদ্রিগিরির মতো শুধু ধর্মাচরণের নাম করে জীবন ধারণ ইসলামি মতে ধর্মবিরুদ্ধ কাজ স্বয়ং নবীজি ও টুপি সেলাই করে অর্জিত আয়ে সংসার যাপন করতেন। ধর্ম‘গুরু’ বা দেশের সম্রাট হিসেবে অর্থ নিতেন না। নবীজি নিরক্ষর হলেও শিক্ষার অপর সর্বাধিক গুরত্ব আরোপ করেছেন। বলেছে, শিক্ষার জন্য সুদূর চীন দেশে যাও। জানিয়েছেন, শহিদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি আল্লার নিকট প্রিয়। বন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ নয়, চেয়েছেন দশজন নিরক্ষরের শিক্ষা। কোরাণের প্রথম শব্দ-ই হচ্ছে-ইকরা। মানে পাঠ করো।  সে কারণে ইসলাম বিজ্ঞান চিন্তা ও চেতনায় অনেক অগ্রসর ছিল। হজরত মহম্মদ( ৫৭০-৬৩২ খ্রি) নিজে কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। কোন মানুষের এমনকী নিজের কোন অলৌকিক শক্তি আছে তিনি বিশ্বাস করতেন না।

আর সে কারণে আরব জাতি অনেক এগিয়ে যায় বিজ্ঞান চিন্তায়। 1, 2, 3 ইত্যাদি হরফ গুলি আরবি হরফ। ইংরেজি নয়। আলখোয়ারজেমি এগুলির আবিষ্কারক। তিনি কেবল ‘0’ নেন ভারত থেকে। ‘অ্যালজেব্রা’ শব্দটি এসেছে আরবি আবিষ্কারক আল জেবরের নাম থেকে। ‘আরসেনাল’ শব্দটিও আরবি শব্দজাত। নৌবাহিনীতে উন্নত ছিল তাঁরা। পৃথিবীর প্রথম বই বা্জার আরব দুনিয়ায়। বাগদাদে। চা বা কফি হাউস কালচার মক্কার অবদান। বাড়িতে পর্দা ঝোলান, কবিতা পাঠের আসর, কবিতার  সাথে বাজনার ব্যবহার আরব অবদান। মশলাদার খাবার, সেলাই করা পোশাক আরবি তথা ‘মুসলিম’ অবদান।

এই রকম একটি উন্নত বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও উনিশ শতকে ‘মুসলিম’রা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ল কেন? ধর্মীয় কারণে? ধর্ম তো শিক্ষার বিরোধী নয়। তাহলে?

উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত ‘মুসলিম’ সমাজ সাধারণভাবে শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে থাকলেও উনিশ শতক থেকে তাঁরা পিছিয়ে পড়তে থাকেন।

এর পিছনে প্রধান কারণ তিনটি

ক।। রাজনৈতিক

খ।। অর্থনৈতিক

গ।। সাংস্কৃতিক

ইংরেজ আগ্রাসনের ফলে নবাবি গেছে, লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাধারণভাবে ‘মুসলিম’ সম্প্রদায়ভুক্ত জমিদার ও আমিররা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। আর ইংরেজ সরকারের সাধারণ নীতি ছিল ‘মুসলিম’ কর্মচারী নিয়োগ না করা। রাজস্ব, ভূমি, জরিপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘মুসলিম’দের যে অধিপত্য ছিল তা প্রায় সর্বাংশে খর্ব হল। ইংরেজরা বহন করছিল মধ্যযুগীয় ‘ক্রুসেডে’র আদর্শ। সেই আদর্শের ফলে ‘মুসলিম’দের আর্থিক সাংস্কৃতিক সামাজিকভাবে শেষ করা ছিল তাদের সাধারণ নীতি। সেই নীতি থেকে উনিশ শতকের একবারে শেষভাগের আগে ‘মুসলিম’দের উন্নতির জন্য কোন চেষ্টা করেনি।                                                        -চলবে…

Leave a Response