শাহনাওয়াজ আলী রায়হান
কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম রাম আর বামে মুর্তিভাঙ্গার প্রতিযোগিতা চলছে বঙ্গে ! কিন্তু মুসলিম সমাজের মূর্তিগুলোর কি হবে ? হ্যাঁ, ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ, কিন্তু তাই বলে পশ্চিমবাংলার মুসলিম সমাজে নয়। এক একটা রক্তমাংসের জীবন্ত মূর্তি দশকের পর দশক গেড়ে বসে আছে খানকাতে খানকাতে । নজরানা দিন, চরণস্পর্শ করুন, তাবিজ নিন, রাত জেগে ফজর কাযা করা ওয়াজ শুনুন তবেই সব মুশকিল আসান করে দেবেন এই মূর্তিগুলো আপনার । পানি-পড়াটা খাওয়ালে আপনার বউয়ের ছেলেই জন্মাবে, ভাইয়ের চাকরিটা হবে, বোনের পাত্র জুটবে আর ইহকালে আপনার যত বায়না আছে সব পূরণ হবে । তাই স্বয়ং নবীর (স.) কবরে যা যা করা যাবেনা, সেসব কিছুই এইসব মাজার-খানকাগুলোই করা যাবে ! তাইতো নবী (স.) মসজিদের মেঝেতে চাটাইয়ে ঘুমাতেন । আর ভক্তদের টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা এই জীবন্ত মূর্তিগুলো একাধিক অট্টালিকায় খেপে খেপে ঘুমিয়ে রাত কাটান। শুধু কি রাজনৈতিক ডিগবাজি খাওয়া পীরজাদারা , শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে দিনরাত সহি আকিদা চর্চা করা দরবারী আলেমরাও এক একটা জীবন্ত মূর্তি ! জানিনা উপমহাদেশের ভ্যাপসা গরমে বেদুইনদের মতো পোশাকে কী এমন পূণ্য আছে ( কারণ আমার জানামতে আরব সংস্কৃতি আর ইসলাম দুটো আলাদা জিনিস ), অথবা জালিম ও জুলুমের প্রতিবাদ না করে দিনরাত নামাজে বুকে হাত বাধা আর জোরে আমিনের ওকালতি করে কি এমন বিপ্লবি পরিবর্তেন আসবে উম্মতের আকীদায় ! আমি নিজেও মনে করি নামাজে রাফায়ে ইয়াদাইন করা উচিত, জোরে আমীন বলা বা একে অপরের কাঁধে কাঁধ পায়ে পা লাগিয়েই দাঁড়ানো উচিত। কিন্ত সেই দাঁড়ানো যদি আমার অহংকে মাজহাব-মুলুকিয়াতের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত এক আল্লাহর দাস না বানাতে পারে , তবে কী লাভ সহি আকীদা চর্চার ! হজরত মুহাম্মদের (স.) সেই অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলাকে সবচেয়ে উত্তম জিহাদ আখ্যায়িত করার হাদীসটি কি এদের সহি আকিদার তালিকায় নাই ? তবে দুই বাংলার দরবারী আলেমরা বর্তমান সৌদি শাসকের কুকীর্তি নিয়ে নীরব কেন ? ইউনিসেফ, সেভ দ্যা চাইল্ড বলছে ইতিমধ্যেই এক লাখ দশ হাজারের উপর শিশু প্রাণ হারিয়েছে ইয়েমেনে । এর জন্য সম্প্রীতি যুক্তরাজ্য সফরে আসা সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে পদে পদে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকদের প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক ব্রিটিশ সাংসদ সৌদির সঙ্গে অস্ত্রচুক্তিতে আগ্রহী প্রধানমন্ত্রী টেরেজা মেকে সমালোচনা করে বলেন মেয়েদের একটু গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে বলে কি এই ‘প্রগতিশীলতার’ অছিলায় ইয়েমেনে সৌদির সাথ খুন মাফ গণ্য হবে ? ‘বিধর্মী’রা সৌদির কুকীর্তির সমালোচনা করবে , আর দরবারী আলেমরা সালমান-সিসির ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে , এটা কোন আকীদায় আছে ? সৌদির টাকায় আপনারা আমাদের শেখাবেন মূর্তিপূজা শির্ক, মাজারপূজা বিদআত, সেটা না হয় মানলাম। আর বাপ-দাদার হাত ধরে চলে আসা রাজতন্ত্রের ইসলামে কোনও জায়গা নেই এটা বলবেন না ? মুজাদীদরা (র.) জেলে গেছেন, শহীদ হয়েছেন তবু দরবারী হতে রাজি হননি — সেই তারিখে ইসলাম আমাদের জানতে দেবেন না শায়খ ? বাশার আল আসাদের সমর্থক শিয়া আলেমদের তুলনায় আপনাদের ভূমিকা কী এমন আহামরি ! অন্যদিকে, মাজার ও দরবার থেকে সমদুরত্বে থাকা একটি ইসলামী সংগঠনের আমীরের বিরুদ্ধে বিলেত থেকে বাংলা ভাষায় কোরআন প্রচারের জন্য পাওয়া টাকার যথাযথ হিসেব না দিতে পারার গুরুতর অভিযোগ। হিসেব মিলানোর গুড়ে বালি দিয়ে এখন উনি নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া সংগঠনের অডিট রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়ার জিহাদে রত !
দরবারী আলেম, সরকারী লালবাতি মাওলানা, মাজারে নজরানার স্তূপে বসা পিরজাদাদের বাইরেও তো একটা বাঙালি মুসলিম সুশীল সমাজ গড়ে ওঠার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গে। যাঁরা আধুনিকতা ও ইসলামের চর্চা করবে, তাকলীদের পরিবর্তে ইজতিহাদকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু সেটাও গড়ে ওঠেনি। মিশন স্কুলগুলোর দক্ষিণ্যে আজকাল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার যতটা হিড়িক পড়েছে , তার চেয়ে খুব কমই দেখা গেছে আরবি-ফার্সী-ইংরেজি শিখে ইসলামকে সঠিকভাবে ব্যাখা, এমনকী মানবীবিদ্যায় অনুসন্ধিৎসু হতে বর্তমান প্রজন্মকে। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ আছে ঠিকই। কিন্তু একটি জাতির তো শুধু পেট নাই, আত্মাও আছে। তাই অর্থকরী পেশায় যাওয়ার পাশাপাশি সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ব,সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব-এর চর্চাও জরুরী । স্পেনের ইসলামী সভ্যতার অবদান হোক বা ইউরোপের রেনেসাঁ, এমনকি বাংলার নবজাগরণও এইসব বিষয়ের চর্চাকে এড়িয়ে সম্ভব হয়নি। হ্যাঁ, মুসলিমদের আবারও আরবী-ফার্সী-ইসলাম চর্চার নসীহত দেখে অনেক শহুরে ভদ্রলোক শ্রেণীর হিন্দু ভ্রু-কুঁচকাবেন। এরা তারা যারা নিজেরা রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছেন, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল , সুকুমারী ভট্টাচার্য বা নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির সংস্কৃত বা পুরানচর্চার গুণমুগ্ধ পাঠক। আইসিস বা আলকায়েদার এক একটা বোমা বিস্ফোরণের সময় এরাই আবার প্রশ্ন করবেন ‘ মডারেট মুসলিমরা গেল কোথায় ?’ ( যদিও এক্স-মুসলিম ছাড়া অন্য কারো ইসলামী লেখা পড়েন না !)। তা ইসলামের চর্চা ছাড়া তো মডারেট কেন , এক্সট্রিমিস্ট মুসলিমও হবেনা ! পার্থক্য ব্যাখায়। এই ইসলাম-ই মধ্যযুগে বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে জাতপাত-মূর্তিপূজা থেকে লিবারেশন থিওলজি হয়ে বের করে এনেছিল। আবার এই ইসলামের (অপ)ব্যাখাই উপনিবেশিক সময়ে বাংলার মুসলিম নেতাদের উত্তর ভারতের উর্দুওয়ালাদের অন্ধ অনুসারী করেছিল। আজও বাংলার প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্রভাবে ইসলামকে বোঝার চেষ্টা হলো না। বিশ্বজনীনভাবে যেমন অনেক সময় ইসলাম ও আরব সংস্কৃতি গুলিয়ে ফেলে স্বয়ং মুসলিমরাই, তেমনি উপমহাদেশে উর্দু আশরাফ সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা দেখা যায় ( কেরল কিছুটা ব্যাতিক্রম )। ফলে ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ সমার্থক হয়ে যায়। মুসলিম স্বার্থে ঘা লাগলেই যেন মুসলিমদের পথে নামার তাড়া ! ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে মার্কিন হামলার প্রতিবাদ যতটা ঈমানবর্ধক মনে হয়, কুশমন্ডির নির্যাতিতার জন্য প্রতিবাদ ততটা নয় । অথচ রাজতন্ত্র, যাজকতন্ত্রের মতো জাতীয়তাবাদেরও কোনও গুরুত্ব নাই ইসলামে — সে উর্দু -আরবি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হোক বা মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ! তাই হজরত মুহাম্মাদ (স.) মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি সকলের সই নিয়ে মদীনা সনদ তৈরির মাধ্যমে মদীনাতে যে রাষ্ট্রটি বানিয়েছিলেন সেটা ইসলামি রাষ্ট্র ছিল, মুসলিম নয় । হ্যাঁ, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে, একটির উদ্দেশ্য আদর্শের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, অপরটির একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের আধিপত্য। আজকে বাংলায় মুসলিমদের কর্মসূচিগুলোর বেশীরভাগই মুসলিম জাতীয়তাবাদ দ্বারা আবেগতাড়িত , ইসলামী আদর্শের সুচিন্তিত প্রয়োগ না। ফলে ক্ষমতার চর্চায় মুসলিমরা নিরপেক্ষ ও ক্ষুরধার হতে পারছে না । তিন তালাক, রোহিঙ্গা বা সিরিয়াকে যতটা আপন ইস্যু ভাবছে, বাংলার বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের সমস্যা বা পাশের জেলার অমুসলিম নাবালিকার ধর্ষণকে ততটা না ! অথচ হাদীসেই বলা আছে শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দাও বা কোনও জুলুম হতে দেখলে সেটার হাত ,মুখ বা অন্তর দিয়ে প্রতিবাদ কর।
আজকের বিশ্বায়নের পৃথিবীতে পুঁজিবাদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসলাম কি করে একটা প্রতিরোধ হতে পারে ,সে নিয়ে বাঙালি মুসলিম প্রজন্মের না আছে আগ্রহ , না যথাযথ পড়াশোনা। সে শুধু জানে বিজেপি- মোদি (নীরব-সরব-ললিত সবাই) – মালিয়া-চস্কি এদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে লেখাটাই হচ্ছে ঈমানী দায়িত্ব ! ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা বা রোহিঙ্গাদের জন্য পথে নামা – দুটোই সময়ের দাবি। ইসলামেরও। কিন্তু ওগুলো করলেই ইসলামের দাবি শেষ হয়ে যায়না। আরও অনেক কর্তব্য বাকি থাকে। দরবারী আলেম বা মাজারের হুজুররা সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক ন্যায় ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দ্বায়িত্ববোধকে এড়িয়ে শুধু মাইকের সামনে মুসলিমদের উদ্দেশে অনলবর্ষী বক্তৃতায় দায়িত্ব পালন হয়ে গেলে তায়েফে গিয়ে হজরত মুহাম্মদ (স.) রক্তাক্ত হতেন না বা ওহুদ উনার দন্ত মুবারক শহীদ হত না । আমরা মানি আর না-ই মানি, পশ্চিমবাংলার তিন কোটি মুসলিম ইসলামের এমন কোনও উত্তম আদর্শ প্রতিবেশী অমুসলিমদের সামনে তুলে ধরতে পারেনি যে তাঁরা আইসিস-আল কায়েদা-তালিবান-তসলিমা সীমান্তপারের সবকিছু ছেড়ে বলবে বেকার-মজদুর-কৃষক-নির্যাতিতা-আদিবাসী-দলিত সবার অধিকার নিয়ে সরব হওয়া আমার এই প্রতিবেশীটাই ইসলামের সাক্ষ্যদাতা । কুরআন বলে ” হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। ” ( সূরা নিসা, আয়াত ১৩৫)