একরামুল বারি
ইসলামের তাত্ত্বিক অর্থই হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা। কিন্তু বর্তমান সমাজে আমরা কতটা আল্লাহ্র দাসত্ব করছি বা আদেশ মেনে চলছি, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্মাচরণটা পুরোপুরি লোক দেখানো বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামায, রোযা, হজ, যাকাত পালন করলেই যে মুসলমান হওয়া যায় না, একথা কেউ মনে রাখে না। আল্লাহর ভীতি যদি প্রত্যেকের মধ্যে থাকে তবেই ঐসব এবাদতের মূল্য থাকে। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যে লোক দেখানোর জন্য নামায পড়লো, রোযা রাখলো, হজ করলো, যাকাত দিলো সে শিরক করলো।’ যার অর্থ হচ্ছে- সে কাজের কোনো ক্ষমা নেই। মানুষ সোজা পথে ঠিক তখনই থাকতে পারে যখন তাহার আল্লাহ কেবল একজনই হবে। এ জন্য কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করিয়া চলো, তাহা হইলে তাহারা তোমাকে আল্লাহর পথ হইতে ভুলাইয়া ভ্রান্ত পথে লইয়া যাইবে। সুরা আনয়াসঃ ১১৭
এখন তো দেখে মনে হয় বর্তমান সমাজে লোক দেখানোটাই আসল উদ্দেশ্য। সেজন্য এত নামায, এত রোযা, এত যাকাত, এত মসজিদের সংখ্যা বাড়া সত্ত্বেও আমাদের দুরবস্থা বেড়েই চলেছে। এক সাহাবী হজরত মহম্মদ (তাঁর উপর শান্তি বষির্ত হোক)-কে প্রশ্ন করেছিলেন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি? তিনি জানতে চেয়েছিলেন, নামায, রোযা, হজ, যাকাত, জেহাদ? উত্তরে আল্লাহর নবী বসেছিলেন, সর্বপেক্ষা প্রিয় হলো মানুষের ব্যবহার। অথচ আমরা আল্লাহর নবীর আদর্শ বিচ্যুত হয়ে লোক দেখানো ধর্মাচরণকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। যার ফলে মুসলমান সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের কাছে প্রতিনিয়ত ঘৃণিত হচ্ছে।
গতকয়েক দিন আগের একটি ঘটনা উল্লেখ না করে আর পারছি না। ব্যক্তিগত কাজে গতকাল আমি বেড়িয়েছিলাম। আমার ড্রাইভার গাড়িটি পার্কিং রেখে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে তার পিছনে রাখা বাইকে ধাক্কা লাগে। এবং সেটি পড়ে যায়, যদিও কোনো ক্ষতি হয়নি বাইকটির। একজন সুদর্শন যুবক যে বাইকটির মালিক তত্ক্ষণাৎ চড়াও হয়। আমি স্তম্ভিত, আমার ড্রাইভার ভীত-সস্ত্রস্ত। তখন রোযার মাস চলছিল। রোযার মাসে রোযা রাখা অবস্থায় তার ঐ দুর্বিনীত, উদ্ধত, অকারণ ক্রুদ্ধ আচরণের প্রতিবাদ করি আমি। যার প্রত্যুত্তরে আমার গাড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। স্থানীয় গ্যারেজে তার বাইক দেখানোর পর কোনো ক্ষতি না হওযায় আমি তাকে আবার রমযান মাসে আমাদের যথার্থ আচরণ স্মরণ করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে সে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করে না। আমার এ কথা বলার একটাই কারণ এটাই আজকের মুসলমান সমাজের চিত্র।
আমরা এত শ্রেষ্ঠ ধর্ম পেয়ে তা অনুসরণ করতে পারলাম না। কিছু লোক দেখানো নামায, রোযা, দান খযরাত করে কিছু মাদ্রাসা মক্তব করে সেখানেই ধর্মটিকে বেঁধে রাখলাম। চেষ্টা করলাম না ইসলামের আদর্শটাকে জীবনে বাস্তবায়ন করতে, সেই সাথে অন্যদের কাছে তুলে ধরতে। যাতে অন্য সম্প্রদাযে মানুষ সেই আদর্শ দেখে অনু্প্রাণিত হয়।
নামায পড়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে প্রভু হিসাবে মেনে মন্দ কাজ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখা। কিন্তু আমরা ক’জন সেই মন্দ কাজ থেকে দূরে সরে থাকতে পারছি! ঘড়ি থেকে একট স্ক্রু খুলে নিলে যেমন ঘড়ি চলে না কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে ঘড়ি মনে হয়। সেইরূপ নামায, রোযা, হজ, যাকাতের সঙ্গে আল্লাহ ভীতি না থাকলে প্রতিটি কাজের জন্য আমাদের অবস্থা ঐ স্ক্রুহীন ঘড়ির অবস্থা হয়।
রোযার সাথে ইফতার পার্টি দেওয়া এখন রাজনৈতিক দলগুলির অপরিহার্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ঐ সব পার্টিতে আমরা দেখেও দেখি না কোন জাযগা থেকে ইফতারের পযসা সংগৃহীত হচ্ছে। ঐ সব ইফতার পার্টিতে রোযদারের সংখ্যা থেকে রোযাহীন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি।
রোযা অবশ্য পালনীয করা হয়েছে এজন্য যাতে খোদাভীতির সর্বস্তরে হয়। আমরা জানি না বিরাট পযসা খরচ করে ইফতার পার্টি দিয়ে কতটা আল্লাহ প্রীতি সঞ্চয় হয়। আমার বলার উদ্দেশ্য হ’ল ইসলামের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে লোক দেখানোতে আমরা বেশি মেতেছি। আল্লাহ কীসে খুশি হবেন না ভেবে, নেতারা কীসে খুশি হবেন তাই ভেবে চলেছি। এ সবের জন্য আমাদের এই দুরাবস্থা। এর থেকে কি আমরা কখনো মুক্তি পাবো, সেটাই এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন।
লেখক – প্রবীণ আইনজীবী, কলকাতা হাইকোর্ট