গল্পসাহিত্য

অনুবাদ গল্পঃ অনুভূতি

565views

মূল হিন্দি গল্পের নাম – এহসাস ।। লেখক- প্রভাত দুবে

অনুবাদ – মুরসালিম শেখ


ডিসেম্বর মাসের এক শান্ত-শীতল দুপুর বেলা। আমি থানার অফিসে নিজের কামরায় চেয়ারে বসে সরকারি কাজ শেষ করে, অবসর সময়ে আমার স্বামীর সাহিত্যিক চিঠির জবাব সাহিত্যিক ভাষাতেই দেবার চেষ্টা করছিলাম। তিনি লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দির প্রফেসর।তিনি আমাকে অভিযোগ করেছিলেন যে,পুলিশ কর্মীদের মায়া-মমতা থাকে না যা অন্য কর্মক্ষেত্রের কর্মী ও কর্মচারীদের মধ্যে থাকে। আমি তাঁকে হিন্দি ভাষায় চিঠি লিখে এ কথা বলতে চাইছিলাম যে,পুলিশেরা উপরে কঠোর কিন্ত তাঁদের হৃদয়েও মায়া,মমতা,স্নেহ আর প্রেমের সাগর বয়ে যায়।

আমি চিঠিতে লিখছিলাম, “এক দিন সাগর নদিকে জিজ্ঞেস করলো,কতো দিন আমাকে মিষ্টি জলের সঙ্গে মেশাতে থাকবে?” নদি হেসে উত্তর দিলো,”যতো দিন তোমার মধ্যে মিষ্টত্ব না আসবে,ততো দিন।”—এ-ই তো প্রকৃত প্রেমের সম্পর্ক, প্রকৃত মিলনের সম্পর্ক।…”

আমি এই সুন্দর চিঠিতে অনেক কিছু লিখতে চাইছিলাম। তখনই আচমকা কামরার মধ্যে পায়ের শব্দে আমার ধ্যান ভেঙ্গে গেল।আমি কিছু বুঝে উঠতেই ওপিয়ম সেন্টের খুশবুতে আমার পুরো কামরাটা ভরে গেল। আমি চিঠির উপর থেকে চোখ তুলে দেখলাম, আমার সামনে এক পুরুষ ও স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দু-জনের হাবভাব দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো যে, সম্পর্কে ওরা স্বামী-স্ত্রী।

আমি তাড়াতাড়ি চিঠিটা গুটিয়ে রাখলাম এবং স্ত্রীটিকে আপাদমস্তক দেখে নিলাম। ওর বয়স কম-বেশি ৩৩-৩৪ বছর হবে। ওর সুন্দর চেহারায় সুন্দর করে মেক-আপ করা আছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ-স্টিকে ওকে অসাধারণ দেখাচ্ছিলো। পরনে বিদেশী জিন্স আর গায়ে বিদেশী পোশাক, হলুদ রঙের গলাখোলা হাফশার্ট পরে সুন্দর করে ‘ইন্’ করা। চোখে গাঢ় কাজল।গোড়ালি উঁচুকরা জুতো পায়ে। ববকাট চুল,কানে বহুমূল্য সোনার টপ। ডান হাতে একটা ফাইল আর বাঁ-হাতে একটা দামী মোবাইল। সব মিলিয়ে স্ত্রীটির মধ্যে একটা আকর্ষণীয় ভাব রয়েছে, যাতে আমি বিমুগ্ধ হচ্ছিলাম।

কিছু ক্ষণ পর আমি সঙ্গে আসা পুরুষটির দিকে তাকালাম। তার হৃষ্টপুষ্ট শরীর। কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছিলো তাকে। তার পোশাক -আশাক ও হাবভাবে তা-ই লাগছিলো।তার বয়স তার স্ত্রীর সমান বা ১-২ বছর বেশি হবে।

সামনের চেয়ারে বসার জন্য আমি ওদের দু-জনকে ইশারা করলাম। স্ত্রীটি চেয়ারে বসলো না।কিন্তু পুরুষটি ‘ধন্যবাদ’ বলে আমার কথাটি কবুল করলো।আমার কেন যেন মনে হতে লাগলো,মেয়েটির চেয়ে পুরুষটি বেশি সুন্দর।মনে হতে লাগলো,পুরুষটির চেয়ে মেয়েটি বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।মেয়েটি দাঁড়িয়েই হাতের ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে দিতে-দিতে রুক্ষ স্বরে বললো,”আপনি এটা পড়ুন আগে।”
আমি বললাম, “আপনি বসুন একটু।”
কিন্তু সে আমার কথায় কান না-দিয়ে সামনে দাঁড়িয়েই রইলো।
আমি ডান হাতটা বাড়িয়ে মেয়েটির হাত থেকে কাগজখানা নিলাম। এটি একখানা কম্পিউটার টাইপ করা অভিযোগপত্র, যাতে লেখা আছে, “আমি কল্পনা ঠাকুর, বি.এ. উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তা এবং এক প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরতা।আমার স্বামী আর.কে.ঠাকুর, যে এক প্রাইভেট কোম্পানির সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। তার সাথে আমি থাকতে চাই না, এই জন্য আমি তাকে অতিশীঘ্রই ডিভোর্স দিচ্ছি। আর আমার মা-বাবা তাকে যে যৌতুক দিয়েছে তা সব ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।সেই সঙ্গেই তার বিরুদ্ধেআইনি ব্যাবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।”

অভিযোগপত্রের নিচে কল্পনা ঠাকুরের পুরো ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ইত্যাদি লেখা রয়েছে। কাগজখানা পড়ে কল্পনা ঠাকুরকে কিছু প্রশ্ন করা উচিৎ বলে মনে করলাম আমি। টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু কাগজের টুকরো বের করলাম এবং ওকে জিজ্ঞাসা করে লিখতে থাকলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এঁর সঙ্গে থাকতে চাইছেন না কেন? ”
—” কিছু বিশেষ কারণ আছে যা বলা যাবে না। ” বেপরোয়া ভাবে বললো সে।
—-“দেখুন,তালাক তো আপনার আদালত থেকেই হবে।কিন্তু আমি যতোটুকু জানি সেই অনুসারে ততো ক্ষণ আপনি তালাক পাবেন না যতো ক্ষণ আপনি কোনো কংক্রিট কারণ দেখাতে না-পারবেন এবং সেই কারণ অবশ্যই সত্য হওয়া চাই।যতো ক্ষণ আপনি এঁকে তালাক দেওয়ার কোনো বিশেষ কারণ না -দেখাবেন ততো ক্ষণ পুলিশ আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। ”
বেশ খানিক ক্ষণ নিরব থাকার পর নিরবতা ভেঙে সে স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে বললো,”কথা হলো এই যে, এর মতের সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না। এই ২১ শতকেও ও ১৮ শতকের মতো কথা বলে। এর সঙ্গে আমার মতের পার্থক্যই নয়,মনেরও পার্থক্য রয়েছে। এই জন্যে আমি এর সঙ্গে থাকতে চাই না। ”
—” সব কথা ভালো করে খুলে বলুন।” আমি বললাম।
সে বললো, “অনাদি কাল ধরে এটা হয়ে আসছে,হচ্ছে এবং হতে থাকবে,যে,মেয়েদের হস্তরেখা পেনসিলে আঁকা হয় আর ওগুলো মোছার জন্য রাবার থাকে পুরুষদের হাতে। পুরুষ পরিচালিত এই সমাজে মেয়েদের হাতের রেখা আঁকা হয় চার দেওয়ালে বন্দি থাকার জন্যে,ওদের বানানো এই নিয়মকে যদি কেউ মেনে চলে তবে তার হাতের রেখা অক্ষত রইলো আর যদি কোনো মেয়ে জেনে-বুঝে অথবা ভুলবশতঃও ঐ নিয়মকে লঙ্ঘন করে তাহলে তার হস্তরেখাকে মুছে দেওয়া হয়। ”
ক্ষণিকের জন্যে সে থামলো এবং পুনরায় বলতে শুরু করলো,”যতোটুকু আমি বুঝতে পারছি,বিয়ের পর থেকেই বৌকে আলাদা চোখে দেখা হয়।তাকে আলাদা রাখা হয়। আলাদা মনে করা হয় এবং, বলা যায়, এটা বেড়েই চলেছে। বৌয়ে যা আশা করে, যে, দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হবে। কিন্তু পুরুষের সে দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হয় না। ”
এসব বলে সে চুপ করে গেল।
আমি একটু কড়া মেজাজ নিয়ে বললাম, “দেখুন,আপনি ভাষণ বন্ধ করুন।আপনি খোলাখুলি ভাবে বলুন,এর সঙ্গে থাকতে না -চাওয়ার কারণটা কী? ”
ঘাবড়ে গিয়ে পুনরায় নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলতে শুরু করলো, “এ আমাকে বলে যে, সব সময় তোমার সিঁথিতে সিঁদূর,কপালে টিপ,গলায় মালা,হাতে চুড়ি,আর পায়ে তোড়া পরা চাই।এসবই অঙ্গরাগ,একজন সধবা স্ত্রীর পরিচয় এবং অত্যন্ত জরুরী।এ এ-ও বলে যে , যখন শ্বশুর -পক্ষের বয়সে বড়ো কোনো পুরুষ অথবা নারী সাক্ষাৎ করতে আসে তখন তোমার মাথায় আঁচল দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।”
—“এসব তো নারীধর্ম,সকল মেয়েই এই ধর্ম পালন করে। আমিও যখন ডিউটিতে থাকি না তখন এই নিয়ম মেনে চলি।কিন্তু আপনার এসব করতে অসম্মতি কেন? ” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
—“আমার কাছে এসব অসহ্যকর,যন্ত্রণাদায়ক শৃঙ্খল।আমি এই শৃঙ্খল মানতে পারছি না, এই জন্যে এর সঙ্গে থাকা আমার সম্ভব নয়। ম্যাডাম,আরও একটা কথা বলতে চাই।”
—“হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন। আমি শুনছি।”
—“আমি বলতে চাইছি যে, সকলেই চায় যে,মেয়েরা উপার্জনও করুক,রান্না-বান্না করুক।আবার বৃদ্ধ শ্বশুর -শ্বাশুড়ির সেবাও করুক।ড্রইংরুমের শোভাবর্ধনও করুক,আবার সুখশয্যাও হোক।কেননা ওঁরা শিক্ষিত! সেই জন্যে আমাদেরকে এসব করতেই হবে। ওনারা যে সেবা করার সুযোগ দিলেন,সেটাতে কি ওনারা আমাদের কম উপকার করলেন? ” সে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললো।
এইসব বলে সে আবার চুপ করে গেল। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,”আপনার বিয়ের বয়স কতো হলো?”
—“৫ বছর।”
—-“কোনো বাচ্চাকাচ্চা আছে? ”
—-“এক ছেলে। চার বছরের।”
—-“সে কোথায়? ”
—“সে আমার কাছেই থাকে। ইস্কুল গিয়েছে।”
—“আপনার স্বামী কি মদ খান?”
—“না।”
—“আপনাকে মারধোর করেন কি?”
—“আজ্ঞে না,কতোই না রাগী!না-করে মারধোর, না-করে গালি-গালাজ…”
—“আপনার মায়ের বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা আনতে বাধ্য করেন কি?”
—“আজ্ঞে না,এর ইনকাম প্রচুর।আমার পয়সা এর প্রয়োজন হয় না। ”
—“আমি এ কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে,যখন ইনি মদ খান না,টাকা-পয়সা দাবি করেন না, তবুও এর সঙ্গে থাকতে আপনার অসুবিধাটা কোথায়?আপনি যে কথাগুলো আমাকে শোনালেন,এর কোনো গোপন অর্থ আছে কি?”
আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিতে গিয়ে চিন্তিত হয়ে সে বললো,”প্রকৃতির কোলে ফোটা ফুল আর আকাশের উঁচুতে পাখি ওড়া দেখে আমার মনে সুখের অনুভূতি জাগে।আমিও ফুলের মতো ফুটে সুবাস ছড়াতে চাই।আর উন্মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়তে চাই।আমি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাই।আমারও কিছু ইচ্ছা-অনিচ্ছা রয়েছে,কিছু মহৎ স্বপ্ন রয়েছে।আমার চোখে সিঁথিতে সিঁদুর,কপালে টিপ, গলায় মালা, এইসব অঙ্গভূষণ স্ত্রীদের জন্য পরাধীনতার চিহ্ন,যা আমি মানতে চাই না।এসব একজন উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রী কি করে মেনে নিতে পারে?”
আমি স্ত্রীটির কথা মন দিয়ে শোনার পর পুরুষটিকে বললাম,”আপনি কী চান?”
—“আমি এটাই চাই যে,ও বৌ হয়ে আমার সঙ্গে থাকবে,যেমন আর পাঁচটা পরিবারের মহিলারা থাকেন।ও ঘর ছেড়ে চলে গেছে আমাকে না-বলেই।ও অনেক দিন থেকে কোথায় এবং কার সঙ্গে থাকে,আমি কিচ্ছু জানি না। আজ রাস্তায় হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়েই ও আমাকে চিৎকার করে বললো,আমার সঙ্গে থানায় চলো তুমি,আমি তোমায় জেলে ঢোকাবো।”
কিছু সময় নিরবতার পর সে আবার বললো,”ও নিজেই স্বীকার করেছে যে, আমার বেতন প্রচুর,তাহলে ওর চাকুরি করার কী দরকার?ও যদি বলতো ওতেও ওর হচ্ছে না,তাহলে কথা ছিলো না।আমার শুধু চিন্তা আমার ছেলের কী হবে!কারণ আমি জানি,ও যে পথে চলছে আর চলবে তাতে ওর আর আমার ছেলের ভবিষ্যৎটা অন্ধকার! ও পড়ালেখা করা মেয়ে হয়েও বুঝতে পারছে না যে এই পুরুষশাসিত সমাজে স্বামী ছাড়া স্ত্রীর কোনো অস্তিত্ব নেই।আর একটি কথা,ও যদি আমার সঙ্গে না-থাকে তো না-থাক,কিন্তু, ও আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক।যদি আমার ছেলেকে আমি ফিরে না-পাই তো ছেলেকে পাওয়ার জন্যে এর বিরুদ্ধে আদালতে আমি কেস্ দায়ের করবো।”

স্বামীর এই কথা শুনে কল্পনা রেগে উঠলো। সে রাগের বশে কিছু বলতে চাইছিলো, ঠিক তখনই আমার কামরায় দু-জন পুলিশ নেশায় বুঁদ হওয়া এক মাতালকে নিয়ে ঢুকলো। ওদের পিছু-পিছু একজন মহিলাও প্রায় দৌড়ে এসে আমার কামরায় প্রবেশ করলো। আমি মহিলাটির চেহারার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম,ওর মুখে-চোখে আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে! মেয়েটি বেশ রূপবতী। তার নাক থেকে ফোঁটা কয়েক রক্ত বেরিয়ে শুকিয়েও গিয়েছে!আমি পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম,”কী হয়েছে?”
—“এই মাতাল মদ খেয়ে বাড়িতে ওর স্ত্রীকে পেটাচ্ছিলো। স্ত্রীটির মুখ-জবানিতেই আমরা ওকে গ্রেপ্তার করে এনেছি।”
আমি পুলিশদের হুকুম দিয়ে বললাম,”ওর স্ত্রীর লিখত অভিযোগ নাও। ওদের দু-জনের মেডিক্যাল চেক্-আপ করাও, মেডিক্যাল চেক্-আপ করার পর ওকে গারদে পোরো। যখন ওর নেশা কেটে যাবে তখন ওকে আমার সামনে নিয়ে আসবে।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি দুটি হাত জোড় করে বললো,”আমি কিছু বলতে চাই,সাহেব।”
আমি নললাম,”বলুন,কী বলতে চান আপনি?”
—“আমি এর বিরুদ্ধে লিখিত দিতে চাই না,আর পুলিশ কেসও করতে চাই না।”
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে শুধালুম,”এতো মার-পিটের পরেও?”
—“জ্বী হ্যাঁ, এতো মার-পিটের পরেও!”
—“কেন?”
—“আমাকে আমার স্বামীই তো মেরেছে,অন্য কেউ তো মারেনি!ও অবুঝ,কিন্তু খুব ভালো মনের মানুষ। ও কখনো-কখনো বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মদ খেয়ে ফেলে, তখনই আমাকে মারধোর করে,তাতে কী? ও আমাকে ভালোও বাসে খুব! সাহেব,ওকে ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দিন আর ওকে বুঝিয়ে বলুন আমাকে আর না-মারে।”
—“তো তুমি চাও যে এর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যাবস্থা না-নেয়?” আমি অবাকচকিত হয়ে শুধোলাম।
—“হ্যাঁ সাহেব,যখন ওর নেশা কেটে যাবে ও-ই আমাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবে, ঔষুধ খাওয়াবে আর আমার দেখভাল করবে,নিজের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করবে।আমার কাছে ক্ষমা চাইবে।এখন এসময় ওকে জেলে দিয়ে আমার কী লাভ হবে? এই পৃথিবীতে না-আছে ওর কেউ,ও-ছাড়া না-আছে আমার কেউ!আমাদের দুটো সন্তানও আছে, ও-ই তো আমাদের সকলকে লালন-পোষণ করে।যদি ওর কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদের কষ্টের সীমা থাকবে না! আমি ওকে খুব ভালোবাসি আর হয়তো ও-ও আমাকে খুব ভালোবাসে।সাহেব,ও আছে তাই আমি আছি,আমার অস্তিত্ব টিঁকে আছে, ওরই জন্যে আমার সিঁথিতে সিঁদুর,গলায় মালা,কপালে টিপ্ আছে,ওরই জন্যে আমার ষোলো কলা পূর্ণতা পেয়েছে। আমি খুব বোকা মেয়ে,সাহেব,কিন্তু এটুকু জানি যে, একজন মেয়ের জন্যে একজন পুরুষ অতোটুকুই দরকারী,যতোটুকু দরকারী একটি ছবির জন্যে একটি মজবুত ফ্রেম আমার কথার মানে এই যে, আমি ওকে ছাড়া অপূর্ণ। পুরুষ-স্ত্রী একে-অপরের পরিপূরক। হুজুর,ওকে একটু ভয়টয় দেখান, দেখিয়ে ছেড়ে দিন, ওকে সঙ্গে নিয়ে আমি বাড়ি যাই। মনে হচ্ছে, অনেকখানি মদ খেয়েছে বলে সকাল থেকে ওর কিছুই খাওয়া হয়নি! ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কিছু খেতে দেবো, তবেই আমিও কিছু খেতে পারবো।”
আমি পুলিশ দু-জনকে হুকুম দিলাম যে, “যতো ক্ষণ ওর হুঁশ না-ফিরবে,যেতে দিও না। হুঁশ ফিরলেই ওকে দিয়ে শপথপত্র লিখিয়ে নিও যে,যদি ভবিষ্যতে স্ত্রীকে মারধোর করে তাহলে ওর বিরুদ্ধে চরম ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।”
—“জয় হিন্দ্”, বলে পুলিশ দু-জন ঐ লোকটিকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে গেল।মহিলাটিও কৃতজ্ঞতাসূচক ভাব্ নিয়ে পিছন-পিছন চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই ঐ মদ্যপের স্ত্রীর আচরণ আমার মনকে নাড়া দিতে থাকলো। ঐ মহিলার কথাগুলো যেন বাতাসে ভর করে আমার কানে ভেসে বেড়াতে লাগলো।
আমি ঐ মহিলার বিচার শেষ করে, কল্পনাকে কিছু বলতে যাবো,তক্ষুনি কল্পনা আমার টেবিলের উপর রাখা অভিযোগপত্রটি চট্ করে উঠিয়ে নিলো এবং আমার সামনেই ওটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললো।
তারপরেই তার স্বামীর দুটি হাত নিজের দু-হাতে নিয়ে বললো,”এই মহিলা ঠিকই বললো যে,স্বামীই হলো স্ত্রীর সংসার।স্বামী -স্ত্রী একে-অপরের পরিপূরক।একে-অপরকে ছাড়া অপূর্ণ।ঐ নিরক্ষর মহিলার কথা শুনে আমার অনুভূতি জাগলো যে,তুমি ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন!চলো,এখন আমার জীবনে কোনো অভিযোগ থাকবে না। আমি ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম।আমি তোমায় কথা দিচ্ছি যে,তুমি যা বলবে, আমি তা-ই করবো।আমি ভেঙে যাওয়া ঘর আবার জোড়া দিতে চাই। ”
এসব শুনে স্বামী যখন চুপ করে রইলো তখন ঐ মেয়েটি মাথা নিচু করে স্বামীর পা দুটি ধরে বললো,”এখন তো আমাকে মাফ করে দাও!”
এ কথা শুনে স্বামীটি স্ত্রীর দুই কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ওকে দাঁড় করালো এবং বললো যে, “কল্পনা, এ কথা মনে রেখো যে, যে প্রিয়জন হয় সে যতো অপরাধই করুক,প্রিয়জনই থাকে। অনেক রোগ হলেও নিজের শরীরের মায়া কার না-থাকে!আমি এও জানি কল্পনা, যে,ক্ষমা চাওয়া এমন এক ঔষুধ,যা গভীর পর্যন্ত গিয়ে ভয়ানক ক্ষতকেও ভালো করে দেয়।এই জন্যে আমি তোমাকে আর তোমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করলাম। চলো,এখন নিজের ঘরে চলো।”
—“হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো।কিন্তু ছেলেটা যে ইস্কুলে আছে।”
এসব বলে স্বামী আর স্ত্রী আমার দিকে হাত জোড় করে বিদায় চাইলো।সেই সঙ্গে কল্পনা বললো, “ধন্যবাদ ম্যাডাম!আজ আপনি আমার ভুল ভেঙে দিয়ে ভালোই করলেন!” এসব বলে একে-অপরের হাত ধরে ওরা জোর কদমে আমার কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।

Leave a Response