আফরিদা খাতুন আঁখি
একটা ভূখণ্ড রাতারাতি একটি দেশে পরিণত হয় না। যেমন ভাবে কাদামাটি দিয়েএকটি ঘর বানাতে লাগে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম, তাদের শরীর থেকে ঝরেপড়া নোনা জল। ঠিক তেমনি ভাবে একটি ভূখণ্ড একটি দেশে পরিণত হয়ে ওঠারপিছনে থাকে কোটি কোটিমানুষের ত্যাগ, লাখো লাখো শহীদের রক্ত। ‘ভারত‘ নামক এই ভূখণ্ড, যে একটি মানচিত্রের আকার নিয়ে আজ এই বিশ্বের বুকে ‘দেশ‘ হিসাবে বিরাজ করছে তা কিন্তু শহীদের দেহ থেকে নির্গত টকটকে রক্ত আরতাজা প্রাণ বিসর্জনের ফল। আমাদের শহীদেরা এক শান্তিসম্প্রীতিময় ভারতেরস্বপ্ন মানসপটে এঁকে মুদিত করেছিলেন তাঁদের চোখ।সেই বীর সন্তানদের দেখাশান্তি সম্প্রীতির ভারতের স্বপ্ন তাঁরা আমাদের কাছে রেখেগেছেন, আমানতহিসেবে। সংবিধানের কসম খেয়ে আমরা প্রতিটি ভারতবাসী তা রক্ষা করার জন্যহয়েছি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কিন্তু দুঃখ না খেদের সাথে জানাতে হয়, স্বাধীনতার এত বছর পরে আসফাকুল্লা, নেতাজী, বিরসা মুণ্ডার এই ভারতে “স্বাধীনতা” এই কথাটি যেন ইউটোপিয়ার দেশথেকেভেসে আসা নিতান্ত অপরিচিত একটি শব্দ। স্বাধীনতা আজ তার সত্তা, পরিচয় সমস্তটা হারিয়ে ধর্ষিতার মতো মুখ লুকাচ্ছে প্রতিনিয়ত ভারত নামক এইভূ ধরার বুকে। সংবিধানের প্রতিটি অঙ্গ আজ হায়নাদেরবিষাক্ত থাবায় ক্ষতবিক্ষত। যেই সংবিধান ছিলপ্রতিটি দেশবাসীরখাবার,বাঁচার,বলার,থাকার রক্ষাকবচ সেই সংবিধানেরই অন্তিম লগ্নঘনিয়ে এসেছেএই ভূমিতে কখনো সিএএ নামক বিষাক্ত থাবার আঁচড়ে কখনো বা ইউএপিএ নামক হিংস্র কামড়ে। এমনকি দণ্ডায়মান ন্যায় বিচারের সেই পুতঃপবিত্রমহিলারস্বাধীনতা ছিনিয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ফ্যাসিস্টদের আস্তানাতে।রক্তের দামে কেনা এইদেশের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত মাথা খুঁড়ে মরছে দিল্লীররাজপথ থেকে শুরু করেগোরক্ষপুরের অলিগলিতে। হাজার প্রাণের সুবাসে সুরভিতস্বাধীনতা আজ দিল্লীর গণহত্যায় পোড়া লাশের গন্ধে আর ডাল লেকের হঠাৎ হঠাৎকরে ভেসে ওঠা বিকৃত চেহারারপচা গন্ধে পরিণত হয়েছে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধে।সংবিধান কে যারা রক্ত প্রাণ দিয়ে দিনরাত এককরে আগলে রেখেছিল বুকেরগভীরে স্বাধীন ভারতের শাসকের কৃপায় তাদের কপালেজুটেছে বুলেট,জেলেরঅন্ধকার, আর নির্মম অত্যাচার।
বিশ্বের বুকে ভারত আজ পরিচিত হয়েছে ত্রাসের দেশ হিসাবে, যেখানে প্রতিনিয়তবিরাজকরছে হত্যা, গুম, নৃশংসতা। আমদের সাধের দেশ প্রতিনিয়ত গুমরে মরছেঅনাহার, রাহাজানি, হিংস্রতার বেড়াজ্বালে। দেশের কাণ্ডারীরা মতেছে আজ দেশবিক্রির কারবারে।ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তারা আঁকতে চলেছে একটি রঙেরভারত, একটি ভাষার ভারত, একটি ধর্মের ভারত।
আপনার আমার মত গুটি কয়েকের কাছে আমাদের জন্মভূমি ধীরে ধীরেস্বাধীনতাহারালেও বিভেদকামীদের কাছে স্বাধীনতা আরো দৃঢ় হচ্ছে। গণতন্ত্রেরআবরণ ছেড়ে ভারত স্বাধীন সৈরাচারী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্যএগিয়ে চলেছে বেশ তড়িৎগতিতে। আজ যেনো ধর্মের আফিমের নেশায় বুঁদ হয়েথাকা মাতালরা রুদ্রের ন্যায় মেতেছেদেশের ঐতিহ্য, মান–সমভ্রম কে ধ্বংসকরার খেলায়। তাদের হিংস্রতার গেরুয়া রঙ গিলেখাচ্ছে সুরাইয়া তৈয়েবজীরনকশা করা ত্রিরঙ্গাটা।
এই কী ছিল তবে স্বাধীনতার মূল্য? তাহলে কী নেতাজী জিয়াওদ্দিনের ছদ্মবেশেএই স্বাধীনরাষ্ট্রের জন্য নিজেকে বিলীন করেছিলেন অজানার পথে? এই দেশকেইকী ‘ভারত হি মেরাদেশ‘ গর্ব ভরে বলার জন্য বেগম মহল আর লক্ষ্মী বাঈ এরমিলিত রক্তে উষ্ণ হয়েছিলসেদিন এ ভূধারা? কিশোর ক্ষুদিরাম কী এই স্বাধীনতারকাছেই সেদিন ঊষা লগ্নে সঁপেদিয়েছিল নিজের প্রাণ পাখিটা? কিছু বছর আগেওতো আজানের হৃদয়স্পর্শী আহ্বান আরঘণ্টার মনোরম ঝংকারে দ্বন্দ্ব ছিলনা, তাহলে মুণ্ডাদের হৃদয়ের ভালোবাসার ছোঁয়ায় গড়েওঠা মসজিদের হৃদয় ভেঙ্গে কেন স্থাপন করা হল মন্দিরের ভীত? কোন সাহসে মসজিদভাঙ্গার দিনটাকেদেশের শাসক স্বাধীনতা দিবসের সম্মান?এই দেশের প্রতিটা কণায় মিশেআছেহিন্দু–মুসলিম–শিখ–ঈসায়ীর রক্ত, যে রক্তের রঙ না ছিল সবুজ না ছিল গেরুয়া, ছিল কেবল টকটকে লাল।এই ভূমি কারোর পৈতৃক সম্পত্তি না। তাহলে কীসেরএইবাঁটোয়ারা? তাই আমিও প্রখ্যাত উর্দু কবি রাহাত ইন্দোরি সাহেবের মতো দীপ্তকণ্ঠে বলতে চাই–
“সবিকা খুন সামিল হ্যায় ইঁহাকে মিট্টিমে
কিসিকে বাপ কা হিন্দুস্থান থোড়ি হ্যা।“
লেখক গবেষক সোসিও এডুকেশনাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)