
সুতীর্থ মুখার্জী
বড় বিরক্ত করছে মহিলাটি। আঞ্জুম আপা বলে, এই মাসে নাকি অনেক হিন্দু মেয়ে বোরখা পরে ভিক্ষা চাইতে চলে আসে। এই মহিলার নাকি স্বামীর চিকিৎসার জন্য ষাট হাজার টাকা চাই। তাই এ বাড়ি, ও বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করছে। অহনা টানা চারদিন না দেওয়া সত্ত্বেও কি আশায় এসেছে আজ কে জানে!
অহনার এটা প্রথম সিয়াম। প্রথম বলাটা আক্ষরিক অর্থে ভুল হলেও আপেক্ষিকার্থে ঠিক। অহনা ইসলাম গ্রহণ করেছে চার বছর হল। এর মধ্যে সালাহ’র স্বাদ গ্রহণ করলেও সিয়ামের ঘ্রাণ সেভাবে পায়নি। প্রথম বছর পরীক্ষার ঝামেলায় কাটে, আর সেবার সিয়ামের গুরুত্ব সম্পর্কেও অতটা ওয়াকিবহাল ছিল না সে। দ্বিতীয় বছর মায়ের ভয়ে আর তৃতীয বছর অনেক কান্নাকাটি, লড়াই, মায়ের অত্যাচার, এমনকি বহু অভিনয়ে মধ্য দিয়ে। এই প্রথম, অহনা সিয়ামের ঘ্রাণ স্বাধীনভাবে, নিজের মত করে নিতে পারছে। দু কামরার ঘরে গত বছরে সেহরি কেটেছে কখনও জল বা একটা বিস্কিট দিয়ে। দুপুরে মা খেতে ডাকলে খাবার থালা নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসত। তারপর মাছ থেকে কাঁটাগুলো বেছে বেছে একটা প্যাকেটে সরিযে রাখত। ভাতগুলো একটা প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে গ্লাসের জলটা জানলা দিয়ে সুপুরি গাছটার গোড়ায় ফেলে ঠোঁটের উপর জল লাগিয়ে থালাটা গিয়ে এঁটো বাসনের জাযগায় রেখে আসত। যাতে মা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে যে মেয়ে খাবার খেয়েছে। আর ঐ কাঁটাবাছা মাছটুকু আর প্লাস্টিকে রাখা ভাতটা ছিল অহনার ইফতার। মসজিদে মাগরিবের আজান দেওয়ার আগে মাটিতে বসে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে দু’য়া করত অহনা- হে প্রভু, আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দাও। আমাকে নিজের মত করে তোমার দ্বীন পালন করার তৌফিক দান কর। হে প্রভু, আমি তো এত কষ্টের পরেও তোমাকে ছাড়া কাউকে সিজদা দিইনি। আমি অন্য কারো মুখাপেক্ষী হইনি। তুমি প্লিজ আমাকে একটা রাস্তা বের করে দাও যাতে সামনের বছর আমি নিজের মতন করে, স্বাধীনভাবে রোজা পালন করতে পারি। তারপর আজান দিলে অহনা খাটের তলা থেকে প্যাকেট আর প্লাস্টিক বের করে ইফতারে বসত।
আজ কথাগুলো মনে পড়লে অহনা জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। আজ ষষ্ঠ সিয়াম। এই দুপুর বেলাটা অসহ্যকর একাকীত্বে কাটে তার। আজ অর্ক কি নিযে ফিরবে, কে জানে! আজ ইফতারে একটু ঝালঝাল মোমো আর গরম সু্প খেতে ইচ্ছে করছে। অর্ককে মেসেজও করে দিয়েছে। আর অর্কও বাধ্য ছেলের মত ‘আচ্ছা’ রিপ্লাই দিয়েছে। ছেলেটা যেন আল্লাহর তরফ থেকে একটা আস্ত হাদিয়া অহনার জীবনে। আল্লাহ’র কাছে চাওয়া দোয়া এভাবে তিনি পূরণ করবেন, অহনা কল্পনাও করতে পারেনি। ঘটনাচক্রে অর্কও একজন রিভার্টেড মুসলিম। সে ইসলাম গ্রহণ করেছে তিন বছর হল। তাদের দুজনের আলাপ হয় গত বছরের অগাস্ট মাসে। সেপ্টেম্বরেই বিয়ে খুব ঘরোয়া অনুষ্ঠানে জনা পাঁচেক সাক্ষীর উপস্থিতিতে ইসলামিক নিকাহ পড়েছিল দুজনে। সেদিনও অহনাও কেঁদেছিল। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না আল্লাহ এভাবে তার প্রতি সাহায্য পাঠিয়ে দেবেন! যাই হোক, তারপর বাড়িতে জানাজানি, মনমালিন্য, বাড়িতে ধর্ম পরিবর্তন, বিয়ে এসব মানতে না চাওয়া আর ওদের দুজনের সব ছেড়ে এই কেরলের ত্রিবান্দামে একটা ছোট্ট সংসার। এখানেও দুটো মাত্র কামরা। তাতেই অহনা যেন রানি। সংসারের ভালো মন্দ, প্রতিদিনের রান্না সবকিছু অনায়াসে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে সে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে অহনা কেন জানি ফ্রিজের দরজাটা খুললো – খাবার উপচে পড়ছে ফ্রিজটাতে। ফল থেকে শুরু করে জুস, খেজুর, দুধ, লাচ্চা, বিরিযানি, মাংস – কি নেই ফ্রিজে! তবু কেন সে অর্ককে মোমো আনতে বললো! এমনিতেই ছেলেটা হাতে কিছু একটা না নিয়ে অফিস থেকে ফেরে না। হঠাৎ একটা হাদিস মনে পড়ল অহনার – অপচয়কারী শয়তানের ভাই। সাথে সাথে গত কয়েকদিনে অর্কর মুখে শোনা নানা খবর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল – সিরিয়া, ফিলিস্তিনে হাজার হাজার মানুষের সেহরি -ইফতার না করতে পারার হাহাকার, আফ্রিকায় এতটুকু জলের জন্য কচি সন্তানকে নিয়ে মায়ের দুশো কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার কথা। অহনার নিজের কথা মনে পড়ল। বাড়িতে খাবার থাকা সত্ত্বেও মায়ের ভয়ে বাসি মাছ আর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাত দিয়ে ইফতার করার কথা, বা এইবছর এই সময়ে দেশের অন্যপ্রান্তে দেবদীপ বা রুমকি বা আয়েসা’র সদ্য ইসলাম গ্রহণ করা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর কত কষ্ট করে, কত সহ্য করে সামান্য জল-মুড়ি-বিস্কিট দিয়ে ইফতার করার কথা।
এসব ভাবতে ভাবতে অহনার দুনিয়া বড় হতে লাগল। অহনার চীনদেশের মানুষের কথা ভাবতে লাগল। যেখানে কোন প্রদেশে রোজা রাখার অপরাধে কিছু মুসলমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ইশ ! তাদের সেহরি ইফতার কি দিয়ে হবে আল্লাহ! আর রোহিংগা ? সামান্য একমুঠো ভাতের জন্য যেখানকার প্রেগন্যান্ট মহিলারাও দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হচ্ছে!
অহনার মাথা বোঁ বোঁ করতে লাগল। মনে হল, একটা শক্ত কিছু দিযে ফ্রিজটাই যেন ভেঙে ফেলে। কিন্তু, সে জানে এই পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিৎ।
অহনা চুপচাপ বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে অজু করল। তারপর মুখ হাত পা মুছে পাখার তলায় বসে মেসেজ টাইপ করতে লাগল – আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। আজ আর কিছু এনো না প্লিজ। আজ শুধু জল আর খেজুর খেয়ে ইফতার করব। তুমি বরং আমাকে হাজারটা টাকা দিও। ঐ মহিলার অসুস্থ স্বামীর জন্য দিয়ে দেব। ও সত্যি বলুক বা মিথ্যে, আমি তো সাহায্য করার নিয়তেই দিলাম।
অর্ক মেসেজটা পড়ে মুচকি হাসল। মহিলাটি জানে না বোধহয় যে – অহনা ওর স্ত্রী। বারবার বাড়ির সামনে দেখে কাল মাগরিবেই ওকে দেড় হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছে সে…
লেখক – প্রাবন্ধিক ও গল্পকার