__________________________
পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা (অবিভক্ত পরগনা) জেলার বসিরহাটের পেয়ারা গ্রামের বাসিন্ধা ছিলেন। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১০ই জুলাই ১৮৮৫, মৃত্যু ১৩ জুলাই ১৯৬৯ সালে,তখন ৮৪ বছর বয়স।[১]
মহা মনিষী ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জীবন যে কত দীর্ঘ বৈশিষ্ট্যগত ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন এবং জ্ঞানের পরিসীমা যে উনার কত ছিল তা আমার এই এক কলমে লিখে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে তার কৃতি জীবনকে ব্যাখ্যা করতে ও আমার কলমে তা তুলে ধরতে আমি প্রবল বলবান। বসিরহাটের পেয়ারা গ্রামের এই ছেলেটি ছোটবেলার জীবন যেমন সুন্দর তেমনি কর্মজীবনেও তার সুন্দর। বলা যায় অনেকটা পেয়ারা ফলের মতো, প্রাকৃতিক যেমন সুন্দর, তেমনি পুষ্টিগুণ ; পেয়ারা গ্রামের পুষ্টি তথ্য যেন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব। পেয়ারা গ্রামের বাসিন্দা, এই মনীষী ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে যদি কেউ জানতে চায় তাহলে সে প্রথমেই অনুভব করবে অনেকের ভিড়ে হারিয়ে গেছে আসল মানুষের অবদান। মানুষ জানে না এই গভীর জ্ঞানী ব্যক্তিটির কথা। বিশেষ করে আজকের তরুণ প্রজন্ম অনেকেই জানেনা কে ছিলেন তিনি বা তার কি অবদান। শহীদুল্লাহ ছোটবেলায় গ্রামের মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং কিছু পরে হাওড়া জেলায় স্কুল ভর্তি হন তিনি ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু ; ছোটবেলাতেই ঘরোয়া পরিবেশে তিনি একই সাথে বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি ও সংস্কৃত শেখেন। দশ বছর বয়সে বাবার কর্মস্থল কলকাতার হাওড়ায় চলে আসেন তিনি। ভর্তি হলেন একটা মাইনর স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৮৯৯ সালে মিডল ইংলিশ পাস করলেন। তারপর ১৯০০ স হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলে তখন ইংরেজি, বাংলা ছাড়াও আরেকটি ভাষা আরও পড়তে হতো। হিন্দু সংস্কৃত পড়তো হিন্দু ছেলেরা, ফারসি পড়তো মুসলমান ছেলেরা । শহীদুল্লাহ কিন্তু ফারসি না নিয়ে, নিয়েছিলেন সংস্কৃত। শহীদুল্লাহর স্মৃতিশক্তি ছিল খুব ভালো । যা পড়তেন তাই মনে রাখতে পারতেন। শুধু স্কুলের পাঠ্য বই নয়, বাইরের নানা রকম বইও পড়তেন,যেমন – কৃষ্ণকুমার মিত্রের লেখা মহম্মদ চরিত, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ আর তাপসমালা পড়তে খুব ভালো লাগে তাঁর। অন্য ছেলেরা যখন ঘুড়ি উড়ায়, লাটিম কিংবা মার্বেল দিয়ে খেলে, মাঠে ফুটবল খেলে শহীদুল্লাহ তখন ঘরে বসে বইয়ের পাতায় চোখ রাখতেন। স্কুল জীবন থেকেই ভাষা শেখার নেশা ধেরেছিল শহীদুল্লাহকে সাহেবকে ।[২]
হাজার ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ এফপ এবং ১৯১০ সালে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বিয়ে ডিগ্রী করেন। এর পরে উনার ইচ্ছা এমএ পড়বেন; তাও আবার বেদ বিষয় পড়বেন নাকি! তখন এম এ পাঠ্যক্রমে অন্যতম বিষয় ছিল বেদ। দু’মাস ঠিক ভাবে কাটলেও, গোলমাল বাধালেন বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। তিনি কোনও অহিন্দু (মুসলমান) কে বেদ পড়াবেন না । মুসলমান বেদ পড়বে, মানতে পারেননি তিনি। এ নিয়ে প্রচুর প্রতিবাদ মিছিল ও কাগজে লেখালেখি শুরু হয়। এই ঘটনায় সেই সময় শিক্ষাজগতে একটা সাংঘাতিক আলোড়ন পড়ে যায়। অগ্রগণ্য মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলি তাঁর ইংরেজি পত্রিকা ‘কমরেড’-এ ‘দ্য শহীদুল্লাহ অ্যাফেয়ার’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, কড়া ভাষায়। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ সত্যব্রত সামশ্রমীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহকে সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিষয় চালু করে যেন তাঁকে পড়ানোর ব্যবস্থা করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় চেষ্টায় হাইকোর্ট বিষয়টি সুরাহা করেন। ডক্টর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর সহায়তায় ও হাইকোর্টের রায়ে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯১২ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। [৩]
এর ঠিক দুই বছর পর বিএল ডিগ্রীও অর্জন করেন। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দীনেশচন্দ্র সেন এর তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা সহকারী হিসেবে দুই বছর কাজ করেন। এরপর তিনি পিএইচডি অর্থাৎ তিনি চলে যান প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় ; সেখান থেকে ডক্টরেট লাভ করেন, সাল তখন ১৯২৮। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও চর্যাপদ ও দোহা গান ছিল তার গবেষণার বিষয়।
গবেষণার নাম ছিল ‘Buddhist mystic song’।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রথম চিন্তক ছিলেন। তার পাণ্ডিত্যের মূল বিষয় ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব। বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয় গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে; বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা নয়। তবে খুব কাছাকাছির। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত ইত্যাদিতে তাঁর প্রচুর অবদান। তিনি উর্দু অভিধানও প্রণয়ন করেন এবং শ্রীলংকার ভাষার উৎপত্তি নির্ধারণ করেন।[৪]
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ছিলেন। চল্লিশটি ভাষা নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন, এবং ১৮ টি ভাষা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। অতএব তিনি আঠারোটি ভাষার পন্ডিত ছিলেন তবুও গভীরভাবে ভালোবাসতেন বাংলা ভাষা ও বাংলা মাতৃভূমিকে। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন। তার মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি টান কেমন তা জানতে একটি ঘটনা থেকে সামান্য কিছু অনুভব করা যেতে পারে ; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদেন ১৯২১ সালে। এই বিশ্ববিদ্যালকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন তাই পরে শান্তিনিকেতন শিক্ষক হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি অপছন্দ করতেন মোটেও তা নয়। তিনি রবি ঠাকুরের লেখা প্রতিনিয়ত পড়তেন, রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত ছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ’ এই দুই বইয়ের ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং তাকে বিশ্বভারতী ম্যানেজিং কমিটিতে সদস্য রূপে গ্রহণ করেন। ( রবীন্দ্রনাথ চিঠি, ২৯ শে বৈশাখ,১৩২৯।
শহীদুল্লাহ সাহেব নিজেই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করে দিয়েছিলেন। এমনকি উঠতি বয়স থেকেই শহীদুল্লাহ সাহেব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা বাংলা করার জন্য জোরালো আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৪৭ সাল থেকেই এ বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ ও ভাষণে তীব্র দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামিক বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা পঞ্জিকার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রুপপায়। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারা জীবন সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি একসময় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। আবার ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সম্মেলন এর সভাপতি ছিলেন, সেখানে তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক ছিলেন। [৫]
উনার সম্পাদিত কিছু পত্রিকা :
আঙ্গুর (শিশু মাসিক, কলকাতা, ১৯১৩, সম্পাদক)। ২. আল ইসলাম (মাসিক পত্রিকা, কলকাতা, ১৯১৮, যুগ্ম সম্পাদক)। ৩. বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (ত্রৈমাসিক, কলকাতা, ১৯৯৮, যুগ্ম সম্পাদক)। ৪. ঞযব চবধপব, (ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা, ১৯২২, সম্পাদক)। ৫. বঙ্গভূমি (মাসিক, ঢাকা, ১৯৫১, সম্পাদক)। ৬. তকবীর (পাক্ষিক, বগুড়া, ১৯৪৬, সম্পাদক)। ৭. কাজের কথা (পাক্ষিক, ১৯৫১, সম্পাদক)। [৬]
তিনি বাংলা ভাষাকে এক অন্য জায়গায় এবং উন্নত শ্রেণীতে পৌঁছে দিতে তিনি কিছু বই লেখেন তার মধ্যে প্রধান ভূমিকায় সেগুলি হলঃ
•ভাষা ও সাহিত্য বাংলা
•ভাষার ইতিবৃত্ত
•বাংলা সাহিত্যের কথা
•বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
•বাংলা ব্যাকরণ পরিচয়
•বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ইত্যাদি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ’ এই দুই বইয়ের ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং তাকে বিশ্বভারতী ম্যানেজিং কমিটিতে সদস্য রূপে গ্রহণ করেন।
( রবীন্দ্রনাথ চিঠি, ২৯ শে বৈশাখ,১৩২৯ [৭])
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’ দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
পাকিস্তান আমলে তাকে ‘ প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পদক(১৯৫৮)’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।তিনি ‘ চলন্ত শব্দ কল্পদ্রুম ‘ বলেও পরিচিত হন। [৮]
তিনি হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতিক বিরোধী সমর্থন করেননি। সর্ব সম্প্রদায়ের জন্য জাতীয় পর্বদিনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন; “এক জাতি হইতে গেলে জাতির সাধারণ পর্বদিন চাই। আমি মনে করি ১লা বৈশাখ দিনটিকে আমরা জাতির নববর্ষ দিন করিয়া লইতে পারি। তারপর কয়েকটি মহাপুরুষের জন্মদিন বাছিয়া লইয়া জাতীয় উৎসবদিন করিতে পারি। তৎপর যীশু খ্রীষ্ট ও হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম দিনকে জাতীয় পর্বদিন করিতে বাধা কি? “একজাতি গঠন”/ ‘ বুলবুল পত্রিকা’ কার্তিক সংখ্যা-১৩৪৪
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চির স্মরণীয় উক্তি “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি” উনার উক্তি থেকেই বোঝা যায় তিনি কত বড় মাপের একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এবং ব্যক্তিজীবনে নিষ্ঠাবান ছিলেন। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা এটি শ্রোতা জরিপ এর আয়োজন করে এই জরিপটি ৩০ দিন ধরে চালানো হয়েছিল ; বিষয়টি ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে। জরিপের ভোটে উঠে আসে শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ বাঙালি মানুষের কথা। ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান ঘোষণা দেয়। ২০ জন বাঙালির সেই তালিকায় ১৬ তম স্থানে উঠে আসে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নাম। তাকে বলা হতো ‘চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া’। এর পরবর্তীকালে যে কাজের জন্য তিনি অসামান্য কৃতিত্বের অবদান হয়ে ওঠেন সেটা হল বাংলা একাডেমী থেকে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান বের করা; এ নিয়ে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন “আমার মনে হয় শুধু তখন কেন, এখন কোন ব্যক্তি নেই যিনি এই কাজটি করতে পারতেন”। এছাড়াও তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাস কে লিখেছিলেন। তার জীবন আরো এক বিরাট কৃতিত্ব রয়েছে প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ শহীদুল্লাহ সাহেব সম্পাদনা করেছিলেন।[৯]
উনার ঝুলিতে গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা রয়েছে প্রায় চল্লিশটি এবং উনি নিজে হাতে কলমে ১৪০ টির বেশি বই লিখেছেন এবং কুড়িটি বই সম্পাদনা করেছেন। উনার লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যার শুধু ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে ৩৭ টি । এছাড়াও তিনি ছোট গল্প ও কবিতা লেখেন। কবিতা ২৯ টি । অনুবাদ শিল্পে ১১ টি কর্ম সম্পাদন করেন। যার মধ্যে অন্যতম রয়েছে আল্লামা ইকবালের “শিকওয়া” ও “জোওয়াবে শিকওয়া” তার এই অনুবাদ এক অতি উচ্চমানের ও উৎকৃষ্ট মানের শিল্পকর্ম। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম। জীবনে কোনদিন কখনো তিনি নামাজ কাজা করেননি এবং সারা রমজানজুড়ে প্রত্যেকটা দিন রোজা রাখতেন। তিনি জিলহজ মাসে হজ যাত্রাও করেছেন। অনেক ধর্মীয় সম্মেলনে বক্তব্য অনেকের নাম খ্যাতি ছড়ানোর পরেও তিনি তার ধর্ম প্রচার করতে পিছপা হননি। তিনি বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে একটি বাক্য বলেন, যা বিখ্যাত উক্তি হয়ে ওঠে এবং ছড়িয়ে পড়ে “তুমি যত বড় জ্ঞানী হও না কেন, যদি তোমার মধ্যে ইসলামের জ্ঞান না থাকে তবে তুমি একজন মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়”। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন খুবই সচেতন এবং কোরান বিষয়ে পণ্ডিত। ১৯৫০ সালে যখন পাকিস্তান সরকারের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তখন তিনি নিজের বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন মানুষকে আশ্রয় দেন শুধু তাই নয় তিনি তাদের জন্যে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাখন তিনি চকবাজারের জামে মসজিদে জুম্মার দিন বক্তৃতায় বলেন “যদি কেউ কোরআন শরীফ থেকে প্রমাণ করতে পারে যে নিরপরাধ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার বিধান রয়েছে তাহলে তিনি নিজের নাম পাল্টে ফেলবেন”।
এর পরে তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলার ঘোষণা দিয়ে বলেন “পারলে আমাকে প্রতিরোধ কর; উনার এমন শক্তিশালী বক্তব্যের পর চকবাজারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেমে যায় । উনার আরেকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে তা হল “প্রকৃতির নিজের হাতে আমাদের চেহারার ও ভাষার বাঙালিত্ব দিয়েছিলেন যে, মালা তিলক কিংবা টুপি-দাড়ি ঢাকার জোটি নেই। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব তিনি নিজের পরিবারকে খুবই ভালবাসতেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের নাম জন্মের সময় রাখা হয়েছিল শেখ মুহাম্মদ ইবরাহিম, আর মা ছেলের নাম রাখেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ; আর এই নামটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এবং তার নাম এই নামেই পরিচিতি লাভ করে। শহিদুল্লাহ সাহেব পিতা ছিলেন মফিজ উদ্দিন তিনি ব্রিটিশদের সাথে মনমালিন্য এর ফলে চাকরি ছেড়ে আদালতের সামনে দলিল লেখক এর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। শহীদুল্লাহ তার স্ত্রীকে অনেক সম্মান করতেন, স্ত্রীর প্রতি তিনি মাঝে মাঝেই আদরের ভঙ্গীতে রসিকতা করে বলতেন “আমার বউ এবং আমার বই সবচেয়ে প্রিয়” স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও পরে নাতি-নাতনিদের প্রতি গভীর ভালোবাসা এ যেন এক বিশাল মনের ও ব্যক্তিত্বের মানুষ। ভাষা আন্দোলনের প্রতীক ও বাঙালি জাতির এই কৃতী সন্তান পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ১৩ই জুলাই ঢাকায় মৃত্যু হয় । কিন্তু ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের মনেপ্রাণে জীবিত আছেন, আর থাকবেনও। উনার আর একটা উক্তি মনে পড়ে “মাতা,মাতৃভাষা, মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু; এই তিনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই সে পশু বিশেষ” উনার এমন জোরালো ভালোবাসা আমাদেরকে বাংলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে দিয়ে অমর হয়ে রইলেন।[১০]
বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতে স্নাতক প্রথম এই মুসলমান ছাত্র ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এই মহান ব্যক্তিত্ব নিয়ে যারা শিক্ষকতা ও গবেষণা করার সুপ্ত বাসনা তিনি একসময় নিতান্তই পেটের দায়ে বসিরহাটে ওকালতি করেন। তার পৃষ্ঠপোষক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ইংরেজিতে একটি কথা বলেছিলেন “ইজ নট ইওর প্লেস শহীদুল্লাহ, জয়েন দি ইউনিভার্সিটি”। অর্থাৎ জহুরি যেমন জহর চিনতে ভুল করেন না তেমনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও শহীদুল্লাহকে চিনতে ভুল করেননি। কারন সেই সময়ে যত ঊজ্জ্বল ছাত্র-ছাত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী ধারী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এরপর হুগলি কলেজে সংস্কৃত ও ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শহীদুল্লাহ। হরিনাথ দে’র পরামর্শে ইংরেজি ছেড়ে দিয়ে শুধু সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহ পেয়েছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। শান্তিনিকেতনে একাধিকবার দুই জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ছবি ও বই উপহার আদান প্রদান হয়। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে তরুণ গবেষক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তবে তা শহীদুল্লাহ সাহেব গ্রহণ করেননি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। কিন্তু এরপরেও পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল। বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহকে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই তিনি বাংলা বানান সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে তার সুচিন্তিত মত প্রকাশে উদ্যোগী হন। শহীদুল্লাহ মনে করেন রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র কবি সাহিত্যিক বা দার্শনিক নন তিনি আমাদের দেশের একজন এমন শ্রেণীর ভাষা বিদও বটে।[১১]
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি বই “বঙ্গালা ব্যাকরন” যেটি প্রথম সংস্করণ হয় ১৩৪২ সন। তখন এই বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শ্রেণীর জন্য এবং ঢাকা বোর্ড অফ ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারী এডুকেশন স্কুল এবং মাদ্রাসা পরীক্ষায় জন্য অনুমোদিত হয়। সেখানে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেন বইয়ের ৩ থেকে ৬ পাতায়; এই বইটি লিখতে তিনি কেন আগ্রহ হয়েছিলেন। “আজকাল নানা সাহিত্য নাটক এবং উপন্যাসের কথ্য ভাষার রূপ দিয়েছি। এতদিন আরও অনেক বিষয়ে এই ব্যাকরণ খানিকে প্রচলিত অন্যান্য বঙ্গালা ব্যাকরণ হইতে কিছু বিশেষ বলিয়া বোধ হইবে। নাতিদীর্ঘ পরিসরের মধ্যে একটা প্রয়োজনোচিত বঙ্গালা ব্যাকরণ রচনা আমার চিরপোষিত কামনা ছিল। কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি সুধিগন বিচার করিবেন।” তিনি আরও বলেন এই গ্রন্থ রচনায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের নিকট সাহায্য পাইয়াছি। তারজ্জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সমস্ত পুস্তকের প্রুফ সংশোধন করিয়া ও নানা উপদেশ দিয়ে ইহাকে সুসংস্কৃত করিয়াছেন। কবিবর শ্রীযুক্ত মোহিতলাল মজুমদার ছন্দ সম্বন্ধে কয়েকটি মূল্যবান বিষয় হইতে সংযোজিত করিয়াছেন। মহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত গুরুপ্রসন্ন ভট্টাচার্য কয়েকটি অলংকারের সংজ্ঞা ও উদাহরণ রচনা করিয়া দিয়াছেন। পন্ডিতসগ্রগন্য আচার্য শ্রীযুক্ত সুশীলকুমার দে ইহার সমস্ত অলংকার
প্রকরণ সংশোধিত করিয়াছেন এবং নানা প্রকারে আমাকে উৎসাহিত করিয়াছেন। আমি পুনরায় তাহাদের সকলের নিকট আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ইতি ১৭ই ফাল্গুন ১৩৪২ সাল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব এর লেখা একটি ইসলামিক বই, যেখানে তিনি সূচিপত্রের ‘আদর্শ মানব’ অধ্যায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আদর্শ মানব লিখতে গিয়ে বলেছেন “সকল মহা-মানবের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য উৎকর্ষ তার মধ্যেই সম্মিলিত হয়েছিল” এবং এক ফরাসি কবির উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন—
” হুসনে য়ুসুফ দমে ঈশা যাদ-ই-বয়ষা দারী।
আঁরবচা খুঁবা হমহ দারন্দ তু তনহা দারী”।।
অর্থাৎ তুমি হযরত ইউসুফ এর সৌন্দর্য, হযরত ঈসার মৃত সঞ্জীবনী শক্তি, হযরত মুসার অলৌকিক ক্ষমতা ধারণ কর, যে উৎকর্ষ তারা সকলেই মিলিতভাবে ধারণ করতেন তুমি মুহাম্মদ রসূল( সাঃ) একা তা ধারণ করো।
(ফরাসি কবি আলফ্রেড দে লা মার্টিন)[১২]
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের নিজের লেখা আরও একটি বই “ইসলাম প্রসঙ্গ” এই বইয়ের “ইসলাম ও বিশ্ব সেবা” অধ্যায়ে ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেব বিশ্ব সেবার এক অভিনব সুন্দরতা প্রকাশ করেছেন। সত্যিই এমন বিচক্ষণ দুর্দান্ত লেখা জুড়ি মেলা ভার। এমন শব্দ ব্যাকরণ ধ্বনি যাবার পরে প্রাণ জুড়ায়। নিম্নে তা অনুরূপ ব্যক্ত করলাম”।
সৌরজগতের প্রতি লক্ষ্য করো, দেখো গ্রহ উপগ্রহগুলি কি সুনিয়ম-শৃঙ্খলায় তাদের নিজ নিজ কক্ষে নিয়ত
পরিভ্রমণ করিতেছে। পৃথিবীতে দেখ বৃষ্টি হইতেছে, নদী বহিতেছে ফুল পড়িতেছে, বৈজ্ঞানিক বলিবেন, এ সমস্ত মধ্যাকর্ষণের ফল। জড়জগতে যেমন মধ্যাকর্ষণ মনোজগতেও সেইরুপ আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণের ফলে বন্ধুর প্রীতি, পতি পত্নীর প্রেম, পিতা-মাতার বাৎসল্য, সন্তানের মাতৃপিতৃ ভক্তি, দাতার দাক্ষিণ্যের, সজ্জনের দয়া। কি মধুর আকর্ষণ। এক পদার্থ পাত্রভেদে ভিন্নরূপ। এই যে প্রাণের সহিদ প্রানের টান—তাহার অফুরন্ত উৎস প্রেমময় আল্লাহতালা অনন্ত করুনা। তিনি আরো বলেন এর পরবর্তী পৃষ্ঠায় যে, সূর্য আলো দেয়, চাঁদের কিরণ বিলায়, বাতাস ব্যঞ্জন করে। মেঘ জল বৰ্ষণ করে। এই সমস্ত কাদের জন্য? সকলেই করুণাময়ী জীবের জন্য নয়? যেখানে কোনো ভেদা ভেদ নেই, সকলেই আল্লাহর দান ও সমান অধিকার। প্রেম-প্রীতি যাহা ধর্মের মূল তাহাও সকলের জন্য।[১৩]
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিখ্যাত সাহিত্য গবেষক আযহারুদ্দিন খান-এর মন্তব্য “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণালব্ধ ফলকে আন্তর্জাতিক সম্মানও গৌরবমণ্ডিত করেছেন এবং দেশ ও জাতির ব্যর্থতা থেকে মুক্তি দিয়ে জীবন ও প্রত্যয়ী করে তুলেছেন, তাদের মধ্যে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম।কারণ তিনি সারাজীবন বাংলা ও বাঙালির হিতের জন্য অন্যান্য ভূমিকা পালন করেছেন।[১৪]
ডঃ শহীদুল্লাহ মনেপ্রাণে একজন বাঙালি মুসলমান ছিলেন। শহীদুল্লাহ তার ধর্ম পালন করতে অনেক উৎসাহ মেজাজে থাকতেন। তিনি একবার গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন তখন পর্যন্ত তিনি মাথায় টুপি মুখে দাড়ি সঙ্গে নামাজ পড়ার বিছানায় (জায় নামাজ) নিয়ে যান। তখন প্যারিস থেকে সুনীতিকুমার কে চিঠি লেখেন, চিঠিতে নানা কথার মধ্যেই কথা উল্লেখ ছিল যে দাড়ি টুপির জোরে এ পর্যন্ত সামনে আছি।
(সুনীতিকুমার এর প্রতি পত্রঃ২০.১০.২৬)
তার একটি ঘটনা, যেখান থেকে তিনি যে কতটা উদার মনের কথাটা সহিষ্ণুতার প্রমাণ মেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার হিন্দু ছাত্র ছাত্রীরা শিবাজী উৎসব পালন করে; এ ঘটনার উল্টোদিকে মুসলমান ছাত্ররা ওরঙ্গজেব উৎসব পালন করতে চায় কিন্তু তা হতে দেয়নি এই ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব। তিনি তখন বলেছিলেন এতে ঘৃণা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে সৌহার্দের পরিবেশ নষ্ট হবে, যা কখনো করা উচিত নয়।
(বই-মেধাবী নীলিমা, পৃষ্ঠা ১৬)
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে শহিদুল্লাহ সাহেব নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন উনাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসার জন্য অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন মুসলিম বাংলার অন্যতম দিকপাল মাওলানা আকরাম খাঁ। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেব এত অসুস্থ ছিলেন তিনি চলাফেরা করতে পারতেন না। তাই চাকা লাগানো চেয়ারে বসে প্রত্যেহ আকরাম খাঁ এর কাছে হাজির হতেন, বিস্তারিত খবর নিতেন পরমাত্মীয়ের মত। শুধু প্রত্যেক দিন এই কাজ করেননি তিনি, হাসপাতালে রোগী হয়ে নতুন কেউ এলো কিনা সে খবর নিতেন। কারও সাথে অতি সামান্য পরিচয় করে নিয়ে তিনি তাদের দৈনিক খাবারও পৌঁছে দিতেন। এসব ঘটনাকে প্রমাণ করে যে তিনার সুদীর্ঘ কর্মব্যস্ত জীবন হলেও তিনি “মানুষ মানুষের জন্য” এমন দয়ালু কর্তব্যের কথা ভুলে যান নি।[১৫]
শহীদুল্লাহ সাহেব ছিলেন সহজ সভ্য মানুষ। তবে তিনি তার পছন্দ ও সত্যকে বলতে পিছপা হননি। তিনি যদি কোথাও কোন সভা সমিতিতে যেতেন তখন সেখানে কোন অতি আধুনিক মেয়ে মানুষ মাথায় কাপড় না দিয়ে থাকতো তবে তা দিয়ে দিতে উপদেশ দিতেন। মাথায় কাপড় না রাখা শহীদুল্লাহ সাহেব একেবারেই পছন্দ করতেন না। একালের আধুনিকা তরুনীদের লক্ষ্যে করে তিনি বলতেন “এলোকেশী সর্বনাশি”। এবং এর থেকে আর একটা জিনিস প্রমাণ হয় যে, শহীদুল্লাহ সাহেব উচ্চশিক্ষিত এবং ইউরোপ জার্মানিতে বেশ কয়েক বছর যাবৎ পড়াশোনা করেও কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন তার বিন্দুমাত্র দূরত্ব পায়নি।(বই- (ঐ) মেধাবী নীলিমা, পাতা-১০)।
শহীদুল্লাহ সাহেব কাজের আগ্রহ দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেন তখন সবাই ভাবলো তার বয়স হয়েছে। এখন মনে হয় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন এবং এই বয়সে নতুন কোন কাজের দায়িত্ব তিনি আর নেবেন না কিন্তু সবার ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে ডঃ আই, এইচ, জুবেরি অন্তরঙ্গ বন্ধু তিনারে আমন্ত্রণে ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেব এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ সংগঠনের দায়িত্ব নিলেন। তাই বলতে হয় এই বয়সে এমন ঝামেলার কাজের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ডঃ শহীদুল্লাহ ছাড়া আর কারো হতে পারে না। সেই কর্ম উদ্যম এর তুলনা নেই। (ঐ) মেধাবী নীলিমা, পাতা-১৩।
ডঃ শহিদুল্লাহ সাহেব ছিলেন মিতব্যয়ী কিন্তু কৃপণ নয়।
তিনি প্রয়োজনের বাইরে খরচ করতেন না। তার ছেলেদের শিক্ষার জন্য তিনি মুক্ত হস্তে টাকা দিতেন। সংসার খরচা দিতেন বিনা দ্বিধায়। মেহমান বাড়িতে এলে তিনি খুব খুশি হতেন। শহীদুল্লাহ সাহেব একদিন ঘরে অসুস্থ হলেন, তিনি দুর্বল তবুও নিজে উঠে জল ঢেলে জল খেয়ে বসলেন আর বললেন বেশ আম হয়েছে বাজারে, না? আম আমার বড্ড পছন্দ কিন্তু দেহটা ভালো নেই কাজেই খাওয়া চলবে না। গোপালভোগ খিরসাপাতি আমের মতো আম দুনিয়ায় আর কোথাও নেই। তাই কবি বলেছেন “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”। কথাটা মিথ্যা নয়। বর্ণে বর্ণে সত্যি। নইলে এমন চমৎকার আমার কোথায় মিলবে। কবি বোধহয় আম খেয়েই এমন কবিতাটা লিখেছিলেন। কথাটা বলে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। (ঐ) মেধাবী নীলিমা, পাতা- ১৯।
এক কবিদের আসরে ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেব সভাপতিত্ব করেন এবং স্বরচিত একটি কবিতা তিনি পাঠ করেন-
“শুনিয়া বধু তোমার
অমিও আহ্বান বাণী
সংসার মাঝারে মন উদাস মানি
ঘরে থাকা হলো দায় আঁখি হতে ধরে পানি
উড়িয়া পাখির মতো
পেনু তব ঘরখানি
কতবার ঘুরি-ফিরি
না হেরি মুখ নূরানী
দেখিনু সুধু তোমার
কালো রেশমী বোরখা খানি।
বলিলে গম্ভীর রবে,
“সাবধান! লান তরানী”।
কবিতার নাম হজ্জযাত্রী। শহীদুল্লাহ্ সাহেব হজ করতে গিয়ে লিখেছিলেন এই কবিতা খানি।(ঐ) মেধাবী নীলিমা, পাতা-১৩২।
তিনি ফরাসি ভাষায় খণ্ডকালীন আন্তর্জাতিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে।(উইকিপিডিয়া বাংলা)।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাক্তার শহীদুল্লাহকে লিখিত চিঠি দিয়েছিলেন এইভাবে বিদায়
সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন- শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীকে সাধারণত হস্তে সমর্পণ করিবার উদ্যোগ প্রায় সমাধান হইয়াছে। Constitution পত্র রেজিস্ট্রি হইবার সময় আসিয়াছে। আপনাকে ইহার সংসদের
(Managing Committee) সদস্য রুপে বরন করা হইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া সম্মতিতে বিলম্ব করবেন না। আশা ইহাতে আপনার আপত্তির কোন কারন হতে পারে না।
ইতি ২৯ বৈশাখ ১৩২৯ ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
______________________________________
রবীন্দ্রনাথের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্’র প্রতিঃ-
সবিনয় নিবেদন,
আপনার ১লা ফেব্রুয়ারী তারিখের পত্র প্রাপ্ত হইয়া অবাক হইয়াছি, আপনি আমার “জীবনস্মৃতি” ও “ছিন্নপত্র” পুস্তক হইতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করিয়া পুস্তকাকারে ছাপার জন্য আমার অনুমতি চাহিয়াছেন, ইহাতে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি আছে জানিবেন।
ইতি
৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯২৪
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
____________________________________
তথ্য সংগ্রহঃ
বই- মেধাবী নীলিমা
লেখক- আজহার উদ্দিন খান
প্রকাশক- শীতলকুমার ঘোষ
৭৩ মহাত্মা গান্ধী রোড
কলিকাতা- ৭০০ ০০৯
পাতা- ৬৩
অতএব পৃথিবীর বুকে স্রস্টার তরফ থেকে এখনো কোন কোন মহাপুরুষের আশীর্বাদ আসে। তেমনি আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল বাঙালি জাতির জন্য উনার ব্যক্তিত্ব চেতনা ধর্মসাধনা; সব কিছুই যেন তার ধ্যান-তপস্যায় গড়া। তিনি বাংলা ও বাঙালিকে পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল করে রাখতে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাখবে। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের কারো আমাদের কারো কারো কাছে অতি অপরিচিত হলেও ইতিহাস ও বর্তমান বাংলার ভাষার ভাবধারা তাকে ভুলতে পারবে না। তিনি যেমন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন তিনি তেমনি অসম্প্রদায়িক ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক মানুষ ছিলেন। মনে হয় প্রত্যেক বিশ্বাস অনুযায়ী আপন মতবাদ ও ধর্ম অনুযায়ী সঠিক দিক দর্শনের পথে জীবনকে চালিত করা উচিত। এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা হেরফের, কেউ কেউ ভাবতেই পারে ধার্মিক মনে সম্প্রদায়িক কিন্তু তা মোটেই নয় যারা সত্যি ধর্মীয় প্রাণ মানুষ তাদের মধ্যে অবস্থান করে পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের সম্মান। ধর্মী পালন করেও নিষ্ঠাবান ধার্মিক মানুষ হওয়া যায় তার একটি উক্তি বারবার মনে পড়ে “আমরা হিন্দু ও মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি”।
তথ্যসূত্র:
[১] উইকিপিডিয়া
[২] ছোটদের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সিরিজ (জ্ঞানতাপস)
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, লেখক- সান্তামারিয়া।
[৩] আনন্দবাজার পত্রিকা (অনলাইন সংস্করণ)
৪, এপ্রিল, ২০২০
[৪] bdnews24.com ( জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ :পূর্বজন্মের গল্প ) লেখক- শান্তামারিয়া,
১০ ই জুলাই ২০২০
[৫] ঐ
[৬] প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকা (বাংলাদেশ)
ঢাকা, শনিবার ৭ই নভেম্বর ২০২০
[৭] বাংলা উইকিপিডিয়া (সাহিত্য বিভাগ)
[৮] বাংলা ভাষার ইতিবৃত্তি (বই)
লেখক- ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রকাশনিঃ মাওলা ব্রাদার্স
বিষয়ঃ ভাষা শিক্ষা ও ব্যাকরণ
[৯] BBC NEWS | বাংলা ২ মার্চ ২০২০
[১০] bdnews24.com ( জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ :পূর্বজন্মের গল্প ) লেখক- শান্তামারিয়া,
১০ ই জুলাই ২০২০
[১১] আনন্দবাজার পত্রিকা (রবীবাসরীয়)
১৮ মার্চ, ২০১৮
লেখক- সুনন্দনকুমার সেন।
[১২] প্রকাশকঃ
আহমেদ মহমুদুল হক
মাওলা ব্রাদার্স
৩৯ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
ISBN 984 70156 01355
[১৩] বই- ইসলাম প্রসঙ্গ
মাওলা ব্রাদার্স সংস্করণ
প্রথম সংস্করণ ১৯৬৩
৩৯ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
ISBN 984 410 1917
[১৪] বই- মেধাবী নীলিমা
আজহার উদ্দিন খান
পাতা-১
[১৫] বই- অন্তরঙ্গ আলোকে
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লেখক- গোলাম সাকলায়েন
প্রকাশক- মহিউদ্দিন আহমেদ(১৯৭০)
মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম কালচারাল প্রেস(৬৮) বেচারাম দেউড়ি,ঢাকা।