
আবু রাইহান
তারপর
কিন্তু তারপর আর এক বিছানায় কোনদিনই শোয়া হলো না। মাঝখানে স্বামীর নিকট সান্নিধ্যে এসে পড়ল আতেকার বান্ধবী অধ্যাপিকা ফিরোজা। যাকে নিয়ে শাহেদ নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখে। অন্যদিকে শাহেদের কৈশোর তার মর্মদংশনের এক প্রধান উপাদান। 22- 23 বছরের পরীবানু তার অর্থদাতা। যে অর্থে শাহেদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত। শাহেদের বাবা শওকত সালকার এর বাসস্থান ছিল বেশ্যাপাড়া সংলগ্ন। সেভাবেই পরীবানু শাহেদের ফুপু। শাহেদের বর্তমান অবস্থা তো তার সকল অতীতকে অস্বীকার করার কারণেই সম্ভব হয়েছে। পরীবানুর অর্থপুষ্ট শাহেদ নিজের বিশ্বাসঘাতকতার দাহে সবসময়ই প্রজ্বলিত যা আতেকার কাছে প্রকাশে সে ব্যর্থ। আর ফিরোজা স্বামী মতিন সে তো চলে গেছে আমেরিকায়। অথচ ফিরোজা তাকেই ভালবাসতো। আর তাই নিজের নিঃসঙ্গতাকে সে একাকার করতে চায় শাহেদের দুঃখবোধের সাথে। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় আতেকা গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে সফর অসমাপ্ত রেখেই। এসেছে সে এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে, তা হলো আল্লাহর পথ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে আতেকার প্রথম শিক্ষক ইমাম সাহেবের সান্নিধ্য তাকে এ পথের সন্ধান দিয়েছে। শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে আতেকার প্রতি ইমাম হুজুরের সর্বশেষ কথা হল, আল্লাহ তোমার মতি সুস্থির করবেন। মনে রাইখো হুদাই ভোগ এর মধ্যেই সুখ নাই, আল্লাহর যত বেশি ইয়াদ করবা, আল্লাহ তত বেশি তোমার ইয়াদ করব। সন্দেহ নেই আতেকার পরিবর্তনে পাঠক চমকিত হন। কিন্তু তাই বলে এমন পরিবর্তন মনুষ্য জীবনে অসম্ভব তেমনটি ধারণা করা অযৌক্তিক। ব্যক্তি জীবনে অসুখী মানুষের জন্য এমন পরিবর্তন তো বরং বেশি স্বাভাবিক। যে মানুষ সুখের সন্ধানে এ ঘাট ও ঘাট করছে, সে যদি ধর্মের ঘাটে ভিড়ে সুখের সন্ধান পায়, তবে তা অলৌকিক কিছু নয়। ‘ডাহুকী’ উপন্যাস এ আল মাহমুদ জটিল মনোজগতের প্রেম আকাঙ্ক্ষা ও দ্বন্দ্বের ভাঁজগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে আলো ফেলে ফেলে স্পষ্ট করেছেন।আল মাহমুদের ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত অধ্যায়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হলেও এর প্রধান অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও চলাকালীন বাংলাদেশি অবস্থানরত বিহারীদের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের কাহিনী। ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসে কবি আল মাহমুদ চমৎকার উর্দু লিখেছেন। এটা কি করে সম্ভব হলো সে বিষয়ে আল মাহমুদ বলেছেন., আমাদের বাড়িতে উর্দুতে কথা হতো একসময়। উর্দু ফারসি চর্চা হতো। বাংলা ও ছিল। একটা কনজারভেটিভ মুসলিম পরিবার। মাদ্রাসার লোক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, মাওলানা আমি তো এরকম একটা পরিবারে মানুষ হয়েছি। আমার ইংরেজি শিক্ষা ও আছে। এরকম একটা পরিবারে যা হয় তাই। আমি যে খুব শুদ্ধ উর্দুতে লিখতে পেরেছি তাও না। ওতে হয়তো ভুল আছে, যতটুকু পেরেছি তাই লিখেছি। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি মিশ্র করতে। আল মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসে বিহারীদের বেশি দোষারোপ করেছেন তিনি। এ বিষয়ে আল মাহমুদের অভিমত, এটা ঠিক না। বিহারীদের প্রতি আমি কিন্তু দারুণ সহানুভূতিশীল। তোমরা জানো না, অনেক বিহারী আমার বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে খুব হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। আমি আসলে বিহারী বিদ্বেষী নই। ওই সময়ের বাস্তব চিত্রটা লিখতে চেষ্টা করেছি। আল মাহমুদ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে বিহারী মুসলিমরা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করেনি এতে তারা কি ভুল করেছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন হ্যাঁ। এখনো বলি তাদের নেতৃত্বের ভুলে তারা মারা পড়েছে। তাদের নেতৃত্ব যদি ভুল না করত, তাহলে তারা বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে বিয়ে শাদী করে সেটেল হয়ে যেত। নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটা কওম ধ্বংস হয়ে গেল বাংলাদেশ থেকে। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে।কাবিলের বোন উপন্যাসটি শুরু হয়েছে 1960 সালে। পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম মনতলা থেকে 16 17 বছরের কিশোর আহমদ কাবিল সেদিন ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামল। মনতলা হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কাবিলের ঢাকা আগমন কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্যে। ঢাকায় এসেছে উঠল চাচা আহমদ আলমের বাসায়। যাকে কিনা তার বাবা আহমদ কামাল্পুরি ত্যাগ করেছিলেন বিহারী বউ বিয়ে করার জন্য। ইতিমধ্যে কাবিলের আব্বা গতায়ু এবং পার হয়ে গেছে 15 টি বছর। চাচার বাসায় চাচি রওনক জাহান পরম আদরে বরণ করে কাবিল কে। আর চাচাতো বোন রোকসানা তো প্রথম পরিচয় কাবিল কে বসিয়ে ফেলে হৃদয়ের মনি কোঠায়। আর এভাবেই ও বাঙালি ও বাঙালি মানুষের যোগসুত্র ঘটে। বিনিময় হয় হৃদয়ের উষ্ণতার। পরবর্তীকালে কাবিল এর সাথে রোকসানার যে প্রেম পর্ব এবং সে অধ্যায়ের জটিলতা উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু সে সব কিছুকে ছাপিয়ে কাবিলের বোন উপন্যাসে যে প্রসঙ্গ টি আর ও প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে তা হলো মুক্তিযুদ্ধ প্রাক্কালে বাঙালি বিহারী দ্বন্দ্ব এবং সে দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থানরত বিহারী জনগণের নিরাপত্তাহীনতার মর্মন্তুদ চিত্র। জাতিগতভাবে মাইনোরিটি হওয়ায় একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে কিভাবে মানসিকতা বদলে যায় উপন্যাসটিতে আল মাহমুদ তা গভীর মমতায় অংকন করতে সমর্থ হয়েছেন।কাবিলের বোন উপন্যাসের প্রধান চারটি যুবা চরিত্রের মধ্যে প্রেম বিষয়ক জটিলতা থাকে কোনো সহজ হিসাব নিকাশ এর আওতায় ফেলা যায় না। কাবিল তার মামাতো বোন মোমেনা রোকসানা এবং তার মামাতো ভাই ও বাঙালি আন্দালিব। কাবিল ঢাকাতে আসতেই রোকসানা তার প্রতি আকৃষ্ট হয় অথচ এর আগে ফুফাতো ভাই আন্দালিব এর সাথে তার এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল। যেহেতু আন্দালিব নিজেই তার ফুফুর সকল ব্যবসায়-বাণিজ্যের দেখভাল করত এবং যথেষ্ট আস্থা অর্জন করেছিল। অন্যদিকে রোকসানাকে নিয়ে কাবিল গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগেই তার মা জাকিয়া বানু পিতৃহীন মোমেনাকে নিজের বাড়িতে এনে কাবিলের উপযুক্ত করতে থাকে বড় করছিলেন। আরো পরে আন্দালিব কাবিল দের বাড়িতে গেলে মোমেনার সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে যা সর্বশেষে চূড়ান্ত পরিণতি অর্থাৎ বিবাহের সিদ্ধান্ত পৌঁছায়। মোমেনার প্রতি সাধারণ দায়িত্ব পালনের সীমায় প্রথম থেকে কাবিল কে স্বাভাবিক মনে হলেও একসময় রোকসানা মোমেনার দ্বন্দ্বে যে বিষয়টি প্রকাশ পেতে থাকে যার গভীরতা রীতিমতো বিস্ময়কর। উপন্যাসের চূড়ান্ত পর্বে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধকালে রোকসানা আন্দালিব এর সাথে পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেছে।
চলবে…