History

দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী-জিন্না বার্তালাপ, ৫ম পর্ব

490views

মইনুল হাসান

তারপর

জিন্নাকে গান্ধী

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪

প্রিয় কায়েদ-ই-আজম

গতকাল দুপুর ৩.৩০ মিনিটে আপনার চিঠি পেয়েছি। যদিও আমি খুবই ব্যস্ত ছিলার তবুও তাড়াতাড়ি উত্তর দেওয়ার সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনি। আমার চিঠিতে আমি বলেছিলাম যে প্রকাশ্যভাবেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি যে আপনাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবেই আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমার জীবনের লক্ষ্য হলো হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন কিন্তু বৃটিশদের তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এটা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। সেইজন্য আত্মনিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপই হবে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করা এবং এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে ভারতের প্রত্যেকটা দল এবং সমষ্টিবদ্ধ মানুষ। এই যুক্তি প্রচেষ্টা যদি দুভার্গজনভাবে কার্যকরী না হয় তবুও আমি একবার সকলকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একত্রিত করার চেষ্টার জন্য সংগ্রাম করে যাবো।

আমি খুশি যে আমার কোনরকম প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থান না থাকা সত্ত্বেও আপনি আলোচনা ভেস্তে দেননি। যদিও আমি আগেই বলেছি যে কংগ্রেসের উপর এ ব্যাপারে আমি সবরকমের প্রভাবই খাটানোর চেষ্টা করবো। আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে রাজাজী সূত্র প্রথমেই তুলে দেওয়া হয়েছিল আপনার বিবেচনার জন্য এবং তারপর লিগকে। এটা সত্যি যে আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম আপনাকে যে একটা বিশাল সমুদ্র মাঝপথে থেকে যেন আমাকে ও আপনাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে কিন্তু এ ব্যাপারের সঙ্গে লিগের লাহোর প্রস্তাবের কোন সম্পর্ক আছে এরকম ভাববেন না। লাহোর প্রস্তাব এখনও অনির্দিষ্ট। (indefinite ) রাজাজী এর থেকে নিয়েই একটা রূপ দিয়েছেন। এখন আপনার তোলা বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার বক্তব্য –

  • আগেই এর উত্তর আমি দিয়েছি।
  • বৃটিশ শক্তি চলে যাওয়ার পর অন্তবর্তীকালীন সরকার অথবা এর দ্বারা নির্ধারিত কোন কমিটির উপর এই সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হবে। এটা পরিষ্কার যে স্বাধীনতা বলতে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতাই বোঝাচ্ছে। কিভাবে এই অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে তা ঠিক করবে লিগ এবং কংগ্রেস।
  • কমিশন গঠিত হবে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকার দ্বারাই। নিরুঙ্কুশ গরিষ্ঠতা (Absolute majority) বলতে বোঝায় সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান অথবা সীমান্ত প্রদেশ অমুসলিমদের উপর নিরুঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। গণভোট এবং নির্বাচন বিষয়ক পদ্ধতি নিয়ে অবশ্য আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
  • সব দল (all parties) বলতে যারা এই বিষয়ে আগ্রহী তাদেরকেই বোঝাচ্ছে।
  • পারস্পরিক ঐক্যমত বলতে এই ব্যাপারে যারা সক্রিয় তাদের ঐক্যমত বোঝাচ্ছে। প্রতিরক্ষাকে বাঁচানোর অর্থ যারা একে ধ্বংস করে দিতে পারে তাদের হাত থেকে বাঁচানো বোঝাচ্ছে।
  •  ক্ষমতা হস্তন্তরিত করতে হবে জাতির ওপর। অথবা অন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতেই। সূত্র অনুযায়ী বৃটিশ সরকারেরই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তরিত করা উচিৎ। আমার মত হল এব্যাপারে আর দেরি করা উচিৎ নয়।

আপনার বিশ্বস্ত

এম. কে. গান্ধী

 

গান্ধীকে জিন্না

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪

প্রিয় মিস্টার গান্ধী,

আমি আপনার ১১ই সেপ্টেম্বরের পাঠানো চিঠি আজ বিকেল পাঁচটার সময় পেলাম। আমি জানি যে আপনি একজন ব্যক্তিগত উদ্যোগকারী হিসেবেই আমাকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তার উত্তর আমিও আমার মত আপনাকে ব্যক্ত করেছি। দয়া করে আপনি কখনই ভাববেন না যে এ ব্যাপারে আপনার এইরকম ভূমিকার যেহেতু কোন পূর্ব নজীর নেই তাই আপনার বিরুদ্ধে আমি কোন অভিযোগ করছি। আমি যুক্তি দিয়েছিলাম যে ১৯৪০ এর মার্চের লাহোর প্রস্তাবের সংক্ষিপ্তসার অনুযায়ী ভারতবর্ষের সমস্যা সমাধানের মূল বিষয়টি হলো ভারতকে ভাগ করে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠন করা এবং এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আপনার বক্তব্য ছিল – লাহোর প্রস্তাব কোন সুনির্দিষ্ট কিছু নয়। ঐ প্রস্তাব সম্পর্কে বিস্তৃত কোন ব্যাখ্যা আপনি আমার কাছে জানতে চাননি। আপনি কিন্তু এই প্রস্তাবের সারবস্তু ও নীতিসমূহের নিরন্তর বিরোধিতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেজন্যই আমি জানতে চাই কেমন করে লাহোর প্রস্তাব এক অনির্দিষ্ট (‘Indefinite’) ব্যাপারে পর্যবসিত হলো। আমি এ বিষয়ে কখনও একমত পোষণ করতে পারিনা যে লাহোর প্রস্তাব থেকেই নিয়েই রাজাজী তার সূত্র তৈরি করেছেন এবং তাকে রূপ দিয়েছেন। উপরন্তু আমার মনে হয় এর (লাহোর প্রস্তাব) থেকে তিনি কিছু নেওয়া তো দূরের কথা বরং একে একেবারে নাস্যাৎ করে দিয়েছেন। এই বক্তব্যই আমি রেখেছিলাম সারা ভারতে মুসলিম লিগের ৩০শে জুলাই, ১৯৪৪ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের এক সভায়। আপনি বললেন, – “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রথম ধাপই হবে স্বাধীনতা অর্জন করা এবং তা হবে সব দল এবং উপদলের যৌথ সংগ্রামের মাধ্যমেই। যদি এই যৌথ সংগ্রাম দূর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তাহলে আমি অবশ্যই যাদের যাদের নিয়ে সম্ভব তাঁদের নিয়েই লড়াই চালিয়ে যাবো।” এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য যদি আপনি জানতে চান তাহলে বলবো, – যা আগেও অনেকবার বলেছি যে এ যেন ঘোড়ার আগেই গাড়িকে জুড়ে দেওয়ার সমান। এবং এটা নিঃসন্দেহে সারা ভারত মুসলিম লিগের ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করা। কিন্ত আপনি ১৯৪২ এর অগাষ্ট প্রস্তাবকে আঁকড়ে ধরেই আছেন। ভারতবর্ষের মানুষদের জন্য যদি স্বাধীনতা আনতেই হয় তাহলে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের বিষয়টার আগে ফয়সালা করতে হবে।

নিশ্চয় আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে আপনি বলেছেন আমাদের মধ্যে মীমাংসা সূত্রের সন্ধান মিললে সেটাকে আপনি কংগ্রেস যাতে স্বীকৃতি দেয় তার ব্যবস্থা করবেন। আমার বিচারে যদিও এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় তবুও আমাকে এটুকু সাহায্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আমি আর একবার আপনার কাছে জানতে চাই যে প্রস্তুতিমূলক অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করার ভিত্তি সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? এটা নিঃসন্দেহে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতেই হবে কিন্তু এর একটা রূপরেখার ধারণা আপনি দিলে এটা আমাদের জানতে সুবিধে হবে যে আপনি ঠিক এ ব্যাপারে কি ভাবছেন?

আপনি বোধহয় আমার একথার উত্তর দিতে ভুলে গিয়েছেন যে কমিশনের সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার ভার কার উপর পড়বে। এবং এটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয় যে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন। আপনি বলছেন – অমুসলিমদের উপর সিন্ধুপ্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং সীমন্তপ্রদেশে মুসলিমদের পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আপনি আমার এ প্রশ্নেরও জবাব দেননি যে এই সূত্রকে কার্যকরী করবে কে?

আমার চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরেও এটা পরিষ্কার হয় না যে সব দলের (All parties) অর্থ আগ্রহী দলসমূহকেই (parties interested) বোঝাচ্ছে।

আপনি বলেছেন – পারস্পরিক সমঝোতা (mutual agreement) বলতে চুক্তিবদ্ধ দলগুলির মধ্যেই সমঝোতা বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ দলগুলির নাম কি যারা কিনা আপনার ধারণায় প্রস্তুতিমূলক অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনে উদ্যোগী হবে। যৌথ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে নিয়োগ করবে কে যারা প্রতিরক্ষা (defence) ইত্যাদি ব্যাপারগুলো দেখবে?

আপনি আরও বলেছেন “ক্ষমতা জাতিগুলির কাছে হস্তান্তরিত হবে অর্থাৎ অন্তবর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে আপনার ধারণা কি।

আপনার একান্ত

এম. এ. জিন্না

গান্ধীকে জিন্না

১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪

প্রিয় মিস্টার গান্ধী,

১২ই সেপ্টেম্বর সকালে আপনি যখন আবার আলোচনার জন্য উপস্থিত হলেন তখন আপনি স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন নি যে আপনি আমার ১১ই সেপ্টেম্বর ১০-৩০ মিনিটে পাওয়া চিঠি খুলে দেখার সুযোগ পান নি। আপনার সঙ্গে আবার আলোচনায় বসলাম ঐ চিঠির উত্তরটি পাওয়ার আগেই। আমি সেই চিঠি পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে এখনও বসে আছি। সুতরাং দয়া করে আপনি আমার চিঠির উত্তরটি তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন।

আপনার একান্ত

এম. এ. জিন্না

 

Leave a Response