ইমানুল হক
তারপর
১০
বাঙ্গালি ‘মুসলমানে’র সমস্যা ছিল আরেকটু বেশি।
ক।। অভিজাতরা মনে করতেন বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়। উর্দু। শিক্ষার ভাষা ফার্সি না হলে হবে উর্দু।
খ।। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক গোষ্ঠী রচিত সংস্কৃত ঘেঁষা পাঠ্যপুস্তক তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। রামরাম বসুরা আরবি-ফার্সিতে লেখা শুরু করলেও উইলিয়াম কেরির চাপে ঝুঁক্তে বাধ্য হলেন সংস্কৃত রীতিতে।
গ।। এছাড়া য়ার্থিক সমস্যা তো ছিলই। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের পর কোন বড় চাকরি ‘মুসলিম’দের দেওয়া হয়নি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার শুরু থেকেই শুরু হয়ে যায় হাতে এবং ভাতে মারার নীতি। ‘মুসলিম’দের একটা বড় অংশ ছিল তাঁতি। ইংল্যান্ড থেকে তাঁত বস্ত্র আমদানিতে তারা সমস্যায় পড়েন। চাষ বাস ছাড়া পথ থাকল না। সেখানেও নীল চাষের জন্য জোরাজুরি। উনিশ শতকে ‘মুসলিম’ সমাজ কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় ধ্বংসে মুখে পড়ে। ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু তা নগ্ণ্য।
শিক্ষায় ‘মুসলিম’দের পিছিয়ে পড়ার কারণ ছিল আরো। একই সঙ্গে দুটি ভাষা তাঁরা শখতে ব্যররথ হচ্ছিলেন। যিনি আরবি-ফার্সি শিখছেন, তিনি ইংরেজি আয়ত্তে আনতে পারছেন না। আর যিনি ইংরেজি ভাল শিখলেন, তাঁর কাছে আরবি ফার্সি বা বাংলা গেল দূরে। ( রিপোর্ট অফ দ্য প্রেসিডেন্সি অফ দি ফোর্ট উইলিয়াম ইন বেঙ্গল, ১৮৩৫-৩৬ পৃ-২৮-২৯।। উদ্ধৃত মো আঃ আল মাসুম পৃ-১১৪)
এই সমস্যা সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক ও লেখক আনিসুজ্জামান ‘মুসলিম বাংলা সাময়িক পত্র’তে উদ্ধৃত করেছেন ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় সৈয়দ আবদুল আগফারের লেখা—
ক।। রাজভাষা (ইংরেজি)কে ধর্মবিরুদ্ধ বলে মনে করা হয়
খ।। অভিভাবকদের দূরদৃষ্টির অভাব
গ।। অর্থাভাব
ঘ।। অংরেজি শিক্ষিত ‘মুসলমান’দের ধর্মের প্রতি অনাগ্রহ
ঙ ।। “হিন্দু’দের শ্ত্রুতা
চ।। কঠোর পরিশ্রমে অনাসক্তি
জ।। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘মুসলিম’ অফিসার স্বল্পতা
ঝ।। ‘মুসলিম’ জমিদারদের ভোগবিলাসে অর্থব্যয় প্রবণতা
এছাড়াও ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বেতনপ্রথা প্রবর্তন , (সুলতানি নবাবি আমলে বেতন দিয়ে পড়তে হতো না), ‘মুসলিম’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ সাহায্য বন্ধ করা, অ-‘মুসলিম’ শিক্ষকের কাছে ‘মুসলিম’দের শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করা এবং ইংরেজি শিক্ষাপ্রথায় ধর্মনাশের আশংকা।
১১
উনিশ শতক সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি ‘হিন্দু’ কৌলিন্যবাদী যে উচ্ছ্বাস সে সম্পর্কে একটি তেতো কথা উচ্চারণ করা যেতে পারে–ও আমার সর্বস্ব ও আমার সর্বনাশ।
নবজাগরণ, আধুনিকতা, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নাট্য আন্দোলন বহু চর্চিত বিষয়। এ নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার সময় একথাও স্মরণ রাখতে হবে—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা, মুক্তি ও স্বাতন্ত্র্যলাভের যে সশস্ত্র সংগ্রামগুলি হয়েছে তার নেতৃত্ব কোন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ দেয়নি। তার প্রধান কারিগর চোয়াড়, সাঁওতাল, মুন্ডা, তফসিলি জাতির মানুষ আর ‘মুসলিম’রা‘।
আর ‘মুসলিম’ সমাজ সশস্ত্র লড়াই লড়েছে শুধু শস্ত্রের জোরে নয় শিক্ষা বা শাত্রের জোরেও। আব্দুল আজিজের শিষ্য সশস্ত্র সংগ্রামের নায়ক সৈয়দ আহমদের (১৭৮৬-১৮৩১) শিষ্যরা বহু শিক্ষা লয় গড়ে তোলেন, তাতে ইংরেজি না শেখালেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতো—শুধু ধর্ম নয়।
চলবে…