ইতিহাস-ঐতিহ্য

দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী-জিন্না বার্তালাপ, ১ম পর্ব

725views

মইনুল হাসান

(১)

মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী ও মহম্মদ আলি জিন্না ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম দুই প্রধান পুরুষ। জিন্না কে পাকিস্তানের সৃষ্টা বলে অভিহিত করা হয়। সেটা তাঁর জন্য সুনাম বা দুর্নাম দুটোই। আর গান্ধীজী আমাদের জাতির পিতা। জিন্না জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৬ সালের ২৫শে ডিসেম্বর করাচির এক মুসলমান পরিবারে। পিতা ঝিনাকাই পুঞ্জু ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। তাঁদের আদি বাসস্থান গুজরাতের কাথিয়াওয়াড়ে। সে কারণে জিন্নাসাহেব একজন গুজরাটি। জিন্নার চাইতে গান্ধী ৭ বছরের বড়। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর। দেশীয় রাজ্য পোরবন্দরের অধিবাসী। সেই অর্থে তিনিও গুজরাটি।

দু’জনেই বিদেশে লেখাপড়া করেছেন। জিন্না কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েন। তারপর পাদরিদের মিশন স্কুলে। সুতরাং ভালো করে তাঁর উর্দু বা আরবি শেখা হয়নি। আরবিতে কোরানও পড়েননি। এরপর বিলেতে যান এবং ব্যারিষ্টার হন। বিলেতে যাবার আগে এক বালিকার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিলেতে থাকাকালীন তিনি পাশ্চাত্য আদব-কায়দায় বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। খাবার ব্যাপারেও কোন শুচিবাই ছিল না। পরবর্তী জীবনে এসব কারণে তাঁকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। বিলেত থাকার সময়েই তার কাছে দু’টি দুঃসংবাদ খুবই মর্মান্তিক ছিল। তাঁর আম্মা এবং স্ত্রী’র মৃত্যু। বিলেতে থাকাকালীন তিনি প্রধানমন্ত্রী গ্লাডষ্টোনের উদারনীতির সমর্থক হন। এই সময় ভারতের রাজনীতি’র খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। ব্রিটিশ সংসদের সদস্য হওয়ার জন্য দাদাভাই নৌরজী প্রার্থী হোলে তিনি তার সপক্ষে জোরদার প্রচার চালান। ১৮৯৬ সালে করাচি ফিরলেন। পিতার ব্যবসায় মন্দা চলছিল। আইন ব্যবসায় যুক্ত হতে যাচ্ছেন। ফলে করাচি থেকে মুম্বাই চলে এলেন। প্রায় ১০ বছর তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ব্যারিষ্টার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করেন ‘জিন্না হাউস’। এইবার মুখ ঘোরালেন ভারতীয় রাজনীতির দিকে।

মহাত্মা গান্ধীর বিয়েও হয়েছিল মাত্র ২৩ বছর বয়সে কস্তুরার সঙ্গে। যদিও গান্ধীজী বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী’তেই তিনি সেটা লিখেছেন। বিলেতে ব্যারিষ্টার পাশ করে মুম্বাইতে প্রাকটিস শুরু করেন। পসার জমাতে পারেননি। সেই সময় হঠাৎ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমান মেনন সম্প্রদায়ভূক্ত দাদা আবদুল্লার কাছ থেকে তাঁর ব্যবসায়ে আইনি পরামর্শদাতা হওয়ার আহ্বান পান। গান্ধীজী ১৮৯৩ সালের মে মাসে জাহাজে রওনা দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। সেখানে গিয়েছিলেন মামলা লড়তে কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস এটাই হলো যে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে অহিংসার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লেন। বাকিটা ইতিহাস।

(২)

দুই মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কোনরকম তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে যে অনেক বিষয়ে মিল আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গান্ধীজীর কর্মধারা সম্পর্কে জিন্না ওয়াকিবহাল ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রকাশ্যে প্রশংসা করেছেন জিন্না। ১৯১৪ সালে গান্ধীজী লালা লাজপত রাই, ভূপেন্দ্রনাথ বসুদের সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিলেন শাসন সংস্কারের দাবি জানাতে। ৮ আগষ্ট সিসিল হোটেলে প্রবাসী ভারতীয়রা গান্ধীজীকে সম্বর্ধনা দেন। জিন্না সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং গান্ধীজী’র ভূয়সী প্রশংসা করেন।

একথা হয়ত অনেকের জানা নেই যে, মুসলিম লীগ গঠিত হবার পরও জিন্না তার সদস্য হননি। বরং লীগের কর্মধারার বিরোধিতা করেছিলেন। বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল লীগের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবি। পরের ঘটনা অবশ্য অন্য। তাঁর ইতিহাস বিখ্যাত চোদ্দ দফা দাবিতে(১৯২৯ সালের ২৮ মার্চ)তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের কথা নয়া বললেও কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম হওয়া চলবে না বলেছিলেন। সেই সঙ্গে সব প্রদেশের আইনসভাতে মুসলমানদের আইনসভা ও নির্বাচিত সংস্থাগুলিতে পর্যাপ্ত ও কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করার দাবি করেছিলেন।

১৯১৪ সালে এক বিশেষ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং নেতা হন। তারপরও কিছুদিন কংগ্রেসের সদস্যপদ রাখেন। ১৯১৫ সালে মুম্বাইতে কংগ্রেসের অধিবেশন হবে। জিন্না উদ্যোগ নিলেন লীগের অধিবেশনও সেখানে হবে। প্রধান কারণ হলো দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক আলোচনা করা সম্ভব হবে। ১৯১৫ সাল পুরো বছর জিন্না হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বন্ধনকে দৃঢ়ভিত্তি দেওয়ার জন্য তিলকের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কাটালেন।

১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিখ্যাত লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, যা কংগ্রেস-লীগ পরিকল্পনা বলেও পরিচিত। দুটি দলই একে অপরকে কিছুটা ছাড় দিয়েছিলেন। কংগ্রেস কোন শর্ত ছাড়া মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের নীতিকে মেনে নিল। অন্যদিকে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, যেসব প্রদেশে হিন্দু অথবা মুসলমান সংখ্যালঘু, সেখানে তাদের প্রতিনিধিদের সংখ্যাবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিমধ্যে জিন্না লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরই সভাপতিত্বে কংগ্রেসে-লীগ চুক্তিতে সাক্ষর দেওয়া হলো। লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের কথা বলা হলেও, জিন্না বললেন এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র।  ১৯১৭ সালে হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর পরিবেশে জিন্না সব মানুষকে আশ্বাস দেন যে, যদি ভারত হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত না হয়। তাহলে আমি একই সঙ্গে বলছি মুসলমানদের দ্বারাও পরিচালিত হবে না, ইংরেজ দ্বারা তো নয়ই। এই দেশ পরিচালিত হবে জনগণের দ্বারা। সরোজিনী নাইডু এসব ঘটনার সার সংক্ষেপ করেই বলেছিলেন, জিন্না হিন্দু মুসলমান মৈত্রীর অগ্রদূত।

ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীর প্রবেশ পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। সেই সূত্র ধরে কংগ্রেস-লীগ আঁতাত বা জিন্না-তিলকের বোঝাবুঝিও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল। গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ ও অহিংসা’র নীতি কংগ্রেসের সামনে তখন অগ্রাধিকার হয়ে গেছে। এরমধ্যে দিয়ে গান্ধীজী কংগ্রেস দলে গুরুত্বপূর্ণ আসন নিলেন। মানসিক দিক দিয়ে জিন্না এসব খুব ভালো মনে নেননি। তবে প্রকাশ্য এসব নিয়ে কোন মন্তব্য তিনি করেন নি। ১৯১৮ নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলো। জার্মানি এর তার সহযোগী তুরস্কের সুলতানের পরাজয় হলো। তুরস্কের সুলতান তখন সমগ্র মুসলমান দুনিয়ায় খলিফা’র মর্যাদা পাচ্ছেন। ভারতের মুসলমানরা বেশিরভাগই সুন্নি এবং খলিফা’র ভক্ত। তুরস্কের সুলতানের প্রতি যেন কোন অবিচার না হয় সেদিকে নজর রাখছিলেন জিন্না। এই উদ্দেশ্যে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগের এক প্রতিনিধিদল স্মারকলিপি নিয়ে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের কাছে যায়। জিন্না সেই দলে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কোন প্রতিশ্রুতি দেননি। ঠিক তারপরই গান্ধীজী মহম্মদ আলি ও শওকাত আলিকে নেতা করে মুসলমানদের একাংশকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। যারা খলিফার সম্মান রক্ষার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এঁরাই খিলাফত পন্থী। গান্ধীজীর এই একক উদ্যোগ জিন্না পছন্দ করেননি। গান্ধী এ ব্যাপারে জিন্না’র সঙ্গে কোন কথা বলেননি। তবে সৌজন্য বজায় রেখেছেন।

দেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো। গান্ধীজী ‘খিলাফতের দাবি’, ‘রাওলাট আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার’ এবং ‘জেনারেল ডায়ারের শাস্তি’ দাবি করে অহিংসা আন্দোলনকে হাতিয়ার করে ইংরেজের সঙ্গে পুর্ণমাত্রায় অসহযোগিতার পথে নামলেন। জিন্না এই কর্মসূচী মানতে পারেন নি। তাঁর যুক্তি ছিল আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে, দেশে চরম বিশৃংখলা দেখা দেবে। মিসেস অ্যানি বেশান্ত ও মহারাষ্ট্রের রাজনীতি করা তাঁর পক্ষে ছিলেন। এই সময় তিলক মারা যান। তারপর গান্ধী পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, মুম্বাই ও বাংলার নেতাদের সমর্থন লাভ করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতায় কংগ্রেসে অধিবেশন। বোঝা যাচ্ছিল গান্ধীজী তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছেন। তাঁর প্রস্তাবিত অসহযোগ আন্দোলন গৃহীত হতে চলেছে। সভাকক্ষে জিন্না ও আর কয়েকজন নেতা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। অসাংবিধানিক বলেন। আলিভ্রাতৃদ্বয় চিৎকার করে জিন্নাকে বক্তব্য রাখতে বাধা দেন। জিন্না কেবল সভাকক্ষ ত্যাগ করলেন না, কংগ্রেসের সঙ্গে বিগত পনের বছরের সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। গান্ধীজী ও জিন্না সাহেবের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল।

চলবে…

 

Leave a Response