
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই যুগে যুগে বিশ্বমানবতার কল্যাণার্থে নবী রসূল কিংবা পয়গম্বরগণের আগমনে এই ধরনী সুশোভিত হয়েছে বারে বারে । হযরত ঈসা আঃ এর আগমনের কয়েক শতাব্দী পরে অন্ধকারে নিমজ্জিত সারা পৃথিবী অপেক্ষায় ছিল একজন মানবতার বন্ধুর জন্য, ঠিক সেই সময় হযরত মুহাম্মদ সাঃ বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ পৃথিবীতে আগমন করেন। ভূপৃষ্ঠে প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব যিনি পরিবর্তন করেছিলেন পৃথিবীর গতিধারা, তাঁর ছোঁয়ায় উষ্ণ আরব মরুভূমি উর্বর মানবতার চারণভূমিতে পরিনত হয়েছিল, ঐশী পথ নির্দেশিত বিপ্লবের ঢেউয়ে পৃথিবীর পটপরিবর্তন করে আদর্শিক জোয়ার এনেছিল দিগন্ত থেকে দিগন্তের দিকে।
মানবতার করুণ অবস্থা ও বিশ্বনবীর আগমন:
প্রাক ইসলামী যুগ অর্থাৎ জাহেলিয়াতের যুগে আরবসহ সমগ্র বিশ্বে মানবতার চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল । হানাহানি, চুরি, ব্যাভিচার, গোত্র যুদ্ধ, ক্রীতদাস নির্যাতনে বুঁদ ছিল সমগ্র আরব সমাজ। সমাজের অসহায় মানুষেরা নিপীড়িত হত শক্তিশালী মানুষদের হাতে, ক্রীতদাস প্রথা রমরমিয়ে চলত। নারীর মর্যাদা বলে কিছু ছিল না, এমনকি কন্যা শিশুদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হত। এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করা হত, এমনকি কাবা শরিফে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল।
এহেন জটিল সমস্যায় জর্জরিত মানবতাকে আল্লাহ প্রদত্ত সঠিক দিশা দেখাতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর আগমন ঘটে। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার মূর্ত প্রতীক।
মহামানবের জীবনাদর্শ:
সৃষ্টকর্তার শিল্পশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বগুনে সমন্বিত একজন কিংবদন্তি। তিনি একজন আদর্শ পিতা, আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্বামী, আদর্শ বন্ধু, আদর্শ অভিভাবক, আদর্শ সুনাগরিক, আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ সেনানায়ক, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অনন্য উচ্চতায় । গরীবের সঙ্গী, অসহায়দের সহায়, ঋণগ্রস্তদের ত্রাণকর্তা, মজলুমের কন্ঠ হিসেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। সমাজসংস্কারের পাশাপাশি নৈতিকতা, একেশ্বরবাদ, ভাতৃত্বের বন্ধনে জুড়ে দিয়েছিলেন সমগ্র আরব জাতিকে। লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের মাঝামাঝি আরব উপদ্বীপে যে আদর্শিক বিপ্লবের জোয়ার এসেছিল, ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে সেই বিপ্লব সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, সৃষ্টি হয় এক উম্মাহর।
ব্যক্তিগত জীবনে মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী এবং করুনার আধার। তিনি মানুষকে ক্ষমা করতে ভালোবাসতেন, তায়েফবাসী এবং মক্কা বিজয় কালীন কোরাইশদের ক্ষমা করে হৃদয় জয় করেছিলেন; ক্ষমার এই সর্বোচ্চ নিদর্শন আর কোনো মহামানব দেখাতে পারেননি। তিনি ছিলেন নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, সত্যবাদী ও সুবিচারক । তাঁর কাছে শত্রুরাও নিজেদের আমানত গচ্ছিত রাখতেন নির্দ্বিধায়, ছোটবেলা থেকেই সত্যবাদীতার জন্য তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয় আল আমিন উপাধি। হাস্যোজ্জ্বল মুহাম্মদ সাঃ সকলের আব্দার রক্ষা করতেন, অযথা বাক্যালাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন; পরিমিত ও মার্জিত কথা বলতেন এবং সবার ভূলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতেন। সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেও মুহাম্মদ সাঃ সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন, বিলাসিতার রং মুহাম্মদ সাঃ কে স্পর্শ করেনি। কৃতদাসদের সঙ্গে সর্বদা সুন্দর আচরণ করতেন। তাঁর মহান আদর্শ মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই চরিত্রের প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা কুরআন শরীফে বর্ননা করেছেন—
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ। ( আল কুরআন ৩৩:২১)
মানবতার পুনর্গঠনে মুহাম্মদ (সাঃ):
হযরত মুহাম্মদ সাঃ কেবলমাত্র ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, ক্রমেই তিনি সামাজিক ও জাতীয় নেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নৈরাজ্যপূর্ন বিশাল আরব ভূমিতে মানবাধিকার রক্ষার্থে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা বিশ্বের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
১. মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা:
তৎকালীন সময়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বলে কিছু ছিল না। অসহায় ও গরীব সম্প্রদায় সর্বদা নিপীড়িত হত, ক্রীতদাসদের কোনো প্রকার অধিকার ছিল না। মানবতার ফেরিওয়ালা হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ) প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা করলেন ইসলামের দৃষ্টিতে নারীপুরুষ, অভিজাত-নীচু , ধনী- দরিদ্র আরব-অনারব প্রত্যেকেই সমান মর্যাদার অধিকারী ।
২. শ্রমিক অধিকার:
শ্রমের প্রতি উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে মহানবী সাঃ শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করেন। মুহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং নিজেই ছিলেন শ্রমিক, তাই তিনি শ্রমিকদের কষ্ঠলাঘবের জন্য অত্যাধিক শ্রম নিষিদ্ধ করেন এবং ঘোষণা করেন—
শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তোমরা তাদের পারিশ্রমিক আদায় করো। -আল হাদীস।
৩. নারী অধিকার:
মহানবী সাঃ এর গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি। অবহেলিত ও অত্যাচারিত, অধিকারহীন নারী জাতীকে মরুভূমির কোল থেকে গৌরবের আসনে সমাসীন করেন মুহাম্মদ সাঃ। মহান আল্লাহর সাম্যের বাণী প্রচার করে বলেন—
পুরুষের নারীর উপর যতটা অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের উপর ঠিক ততোটাই অধিকার রয়েছে। তিনি নিজে একজন বিধবা নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিধবা বিবাহে উৎসাহ প্রদান করেন। তালাক, সম্পত্তির অধিকারে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। স্ত্রীদের প্রতি সৎ ব্যবহার, কন্যাদের প্রতি পরম ভালোবাসা ও মাতৃত্বের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ। তিনি বলেন— মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত। — আল হাদীস।
৪. অমুসলিমদের অধিকার:
মহানবী সাঃ অমুসলিম নাগরিকদের জান-মাল, মান-সম্মান এবং নিজস্ব ধর্মাচার পালনের পূর্ণ অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সকলের জন্য রাষ্ট্রীয় মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেন। পরধর্মে সহিষ্ণুতার উদাহরণ হিসেবে নিজেকে বিশ্ববাসীর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ রেখে গেছেন। তাঁরই দেখানো পথ অনুসারী হওয়ায় অমুসলিম অধুষ্যিত অঞ্চলের মুসলিম শাসনকর্তা থাকা সত্ত্বেও জন বিন্যাসের কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
৫. অশ্লীলতা দূরীকরণ ও নৈতিকতার প্রতিফলন:
মহানবী সাঃ সমাজবিধংসী যাবতীয় অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, ব্যাভিচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, ব্যাভিচার, প্রতারনা, লুটতরাজ, কালোবাজারি, অপচয় উচ্ছেদ করে এক সুস্থ মূল্যবোধভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটান।
৬. সাম্য ও সম্প্রীতির বার্তা:
ইসলামের সাম্যের বানী চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাঃ। হোদায়বিয়ার সন্ধি হোক কিংবা মক্কা বিজয়; তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির মূর্ত প্রতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সমস্ত নির্যাতন ভুলে গিয়ে সমস্ত আরববাসীদের তিনি সম্প্রীতির চাদরে আবদ্ধ করেছিলেন।
৭. আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার ধারণা:
বিশ্বনবী ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ভৌগোলিক সীমারেখা, দেশ, বর্ণ, ভাষা, গোত্র তথা সকলপ্রকার আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের গন্ডি পেরিয়ে এক বিশ্বজনীন মুসলিম জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবদেরকে সংকীর্ণ গোত্রপ্রীতি পরিহারে এবং মানবতাবোধের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁরই হাত ধরে মানবতাবাদের জয়যাত্রা শুরু হয় যা বিশ্বব্যাপী এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
৮. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
মহানবী সাঃ শরীয়তের আলোকে কুরআন ভিত্তিক দন্ডবিধি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। ইহুদি কিংবা মুসলিম, নারী কিংবা পুরুষ, স্বজন কিংবা পরআত্মীয় কারো পক্ষে ন্যায়বিচারের দাড়িপাল্লায় কোনোরকম সহানুভূতি প্রদর্শন করা হত না।
৯. বিশ্বের প্রথম সংবিধান প্রণেতা :
মহানবী সাঃ আল কুরআনের নীতিমালার উপর ভিত্তি করে একটি লিখিত শাসনতন্ত্র প্রনয়ণ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে পরিচিত পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মদিনার ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক অমুসলিম জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে সকলের অধিকার সম্বলিত এই সংবিধান পরবর্তীকালে সকল সংবিধানের অগ্রদূত ছিল।
১০. আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণ:
মহানবীর আগমনের পূর্বে আরবদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। গোত্র ও বংশতন্ত্রে বিশ্বাসী আরব সমাজে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। হিজরতের পর মহানবী সাঃ মদিনার সকল জাতি ও গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর করেন। তিনি সেই রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হয়ে ঐশী পথনির্দেশ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সকল প্রকার নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করে আদর্শিক রাষ্ট্র সোনার মদিনা বিশ্বব্যাপী মডেল হয়ে ওঠে। আদর্শ রাষ্ট্রের কারিগর মুহাম্মদ সাঃ নির্মিত এই রাষ্ট্র অন্যতম পরাশক্তি হয়ে ওঠে। ক্রমেই এই সাম্রাজ্যের গণ্ডি ককেশাস থেকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং ভূমধ্যসাগর থেকে জাভা দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তারিত হয়।
মুহাম্মদ সাঃ আলোকবর্তিকা স্বরূপ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার উচ্চ শিখরে অবস্থান করেছেন। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করলে অশান্ত এই পৃথিবী আবারও শান্তি ফিরে পাবে। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে নবীজির অনুসারীদের সংখ্যা বিলিয়নের অধিক হলেও তারা সমগ্র পৃথিবীবাসীদের কাছে নবীজী সাঃ এর আদর্শ তুলে ধরতে অপারগ।
লেখক: মুসান্না মুত্তাকি