তাসনিম হক
গোমাংস পরিবহনের অভিযোগে গোরক্ষকদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে প্রহৃত হয়েছেন লুকমান৷ আতঙ্কে ছেয়ে গেছে গুরুগ্রামের বাদশাহপুরের সদর বাজার এলাকা৷ এমন ঘটনা সেখানে আগেও ঘটেছে৷ বিজেপির গত ছয় বছরের শাসনামলে ক্রমাগত হুমকির মুখেই রয়েছেন মুসলিম মাংস ব্যবসায়ীরা৷ রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এই গোরক্ষকদের আর কোনও ভাবেই থামানো সম্ভব নয়, বলছেন গুরুগ্রামের মুসলিমরা৷
ছয় বছর আগে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে দেশে গোমাংস ভক্ষণ বা বহনকারী সন্দেহে মুসলিমদেরকে পিটিয়ে মারা এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷ গত শুক্রবার গুরুগ্রামে এমনই একটি নৃশংস ঘটনার সাক্ষী থাকল দেশ৷ গুরুগ্রামের বাদশাহপুরের ফখরুদ্দিন তাঁর পরিচিত লুকমান খানকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন৷ আট থেকে দশজন লোকের একটি দল তাকে হাতুড়ি দিয়ে মারধর করছিল ২০ মিনিট ধরে৷ গুরুগ্রামের বাদশাহপুর এলাকার সদর বাজারে ঈদ উল আযহার প্রাক্কালে লুকমানকে পিটিয়ে প্রায় মেরেই ফেলেছিল ওই উন্মত্তরা। ফখরুদ্দিন সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু দলটির এক গুন্ডা তাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল যে সে যদি আরও কাছাকাছি আসতে সাহস করে তবে তাকে গুলি করা হবে। ‘আমি জানি না তাদের কাছে বন্দুক ছিল কি না, তবে এই পরিস্থিতিতে কে এগিয়ে আসবে?’, জানাচ্ছেন ফখরুদ্দিন৷ ফখরুদ্দিন, যিনি কেবল তাঁর মূল নামটিই ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, তিনি তার পুরো জীবনের ২৬ বছর ধরে এই অঞ্চলে বাস করছেন। তিনি বাজারের একটি মাংসের দোকানে কাজ করেন, যা একটি মসজিদ ও মন্দিরের মাঝখানে ছোট্ট একটি গলিতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলছিলেন, গত ছয় বছর ধরে স্থানীয় গোরক্ষকদের হুমকি ও আক্রমণের মুখে ঈদ পালিত হচ্ছে না ঠিকঠাকমতো৷ সবাই ভীত হয়ে থাকে৷ এই বুঝি তাদের উপর গোরক্ষকদের খাঁড়া নেমে এল৷
ফখরুদ্দিন আরও বলছিলেন, এই প্রথম কেউ এত মারাত্মকভাবে আহত হল৷ তবে আমরা ওদের কাছ থেকে এমন হুমকি ও গালিগালাজ শুনতে অভ্যস্ত। বছরের এই সময়ে কেউ কেউ এসে আমাদের হুমকি দেয় যে তারা বাজার বন্ধ করে দেবে এবং আমাদের উপর গোমাংস ব্যবসার অভিযোগ আনবে। ২০১৬ সালে একটি ঘটনা ঘটেছিল৷ এই বাজারে পিতার মাংসের দোকানে কাজ করা ইজহার কুরাইশি মাংস পরিবহন করছিলেন৷ তাকে একদল হিংস্র গোরক্ষক মারধর করে এবং গুলি করে। ‘আমি বুলেটটি এড়িয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। তারা আমাকে গরুর মাংস পরিবহনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল, যখন প্রত্যেকে জানে যে আমরা কোনও ‘অবৈধ’ বিষয় নিয়ে ব্যবসা করি না। আমি আহত না হবার কারণে আমরা মামলা দায়ের করিনি৷ তবে এমন কিছু করা হলেও ওদের কিছুই হত না। আইন তাদের হাতে রয়েছে, কেউ ওদের বাধা দেবে না,’ আক্ষেপ করে বলছিলেন ইজহার।
আক্রমণ ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া
——————————–
শুক্রবার সকালে লুকমান তা-ই করছিলেন যা গত দু’বছর ধরে তিনি করে আসছেন৷ হোমটাউন নুহ থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তিনটি মহিষের মাংস সদর বাজারে নিয়ে আসছিলেন। তিনি সোহনা রোড থেকে আসছিলেন যখন গোরক্ষক দল তাকে থামতে বলে। পরিবর্তে, তিনি বাজারের দিকে পালিয়ে যেতে থাকেন প্রাণভয়ে৷ বাদশাহপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর দেবেন্দ্র কুমার জানাচ্ছেন, তারা সেখানে তাকে ধরে ফেলে ও মারধর করে৷ বাজারের প্রধান ও প্রত্যক্ষদর্শী তাহির কুরাইশি জানান, তিনি পুলিশকে পাঁচ থেকে ছয়বার ফোন করে ডাকার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। অবশেষে তারা যখন পৌঁছল, তখন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজই তাদের ছিল না৷ কোনও পদক্ষেপই পুলিশ নেয়নি৷
হামলার একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, একদল হামলাকারী লুকমানকে লাথি মারছে এবং তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ সহিংসতা বন্ধ করার চেষ্টা না করে ভিড়ের মধ্যে থেকে ঘটনা দেখছিলেন। জনতার দাবিতে শনিবার বাদশাহপুর স্টেশন হাউস অফিসার দীপক কুমারকে বদলি করা হয়েছে৷ তাহির কুরাইশি বলেছিলেন, ততক্ষণে প্রায় একশ লোক জড়ো হয়েছিল। মারধর করার পরে তারা তাকে তার নিজের গাড়িতে ছুড়ে ফেলে এবং চালিয়ে নিয়ে যায়। ওরা পাঁচটি বাইকে প্রায় ১০জন ছিল। তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন এবং বলছিলেন যে এটা গরুর মাংস নয়, মহিষের মাংস। তার কথায় ওরা কেউ কান দিল না। তারা এমন বহুবার করেছে। তারা আমাদের গুলি করেছে, তারা আমাদের গাড়িকে ধাওয়া করেছে। এদিকে এসআই দেবেন্দ্র কুমার জানান, সোহনা রোডের দিকে ফিরে যাওয়ার পরে পুলিশি হস্তক্ষেপের আগে হামলাকারীরা আরও একবার লুকমানকে মারধর করে। এমনকি তারা পুলিশের গাড়িতে ধাক্কা মারে এবং কাচ ভেঙে দেয়। এরপর লুকমানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আর এই মামলায় একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে৷ গ্রেফতার হওয়া গোরক্ষক ২৮ বছর বয়সী প্রদীপ যাদব শীঘ্রই ছাড়া পেয়ে যাবে৷ কারণ দেবেন্দ্র কুমারের বয়ান অনুযায়ী, গোরক্ষা করতে গিয়ে হিংসাত্মক অপকর্মের উদাহরণ তার ইতিহাসে নেই এবং তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত নন। এখন প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ আগে কেন পদক্ষেপ নেয়নি? কেন তারা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে দেবেন্দ্র কুমার দাবি করছেন, তারা হামলাকারীদের ধরার চেষ্টা করছিলেন। গুরুগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রিত পাল জানান যে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, এবং অন্যান্য হামলাকারীদের সন্ধানের জন্য তদন্ত চলছে। লুকমানের ট্রাক থেকে মাংস পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে৷ দাদরির আখলাককেও ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে পিটিয়ে মেরেছিল গোরক্ষকরা৷ পরে প্রমাণিত হয়েছিল, ফ্রিজে গোমাংস ছিল না৷
বাজার হুমকির মুখে
—————————–
সদর বাজার সংলগ্ন জামে মসজিদের ৭০ বছর বয়সি ইমাম আহমেদ খান বলছেন, মূলত হিন্দু শহর বাদশাহপুরের সদর বাজারে কর্মরত মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছে৷ এবার তিনি ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ‘যখন ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক হিংসা অনুমোদিত, তখন এটি কীভাবে বন্ধ হবে? এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ কোনও কিছুই এটাকে থামাতে পারবে না এবং কেউ কিছুই করবে না। এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ আমরা যা করতে পারি তা হ’ল মাথা নিচু করে আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া,’ আক্ষেপ করে বলছিলেন দেশের প্রবীণ নাগরিক আহমেদ খান। অন্য অনেকের মতোই আহমেদ খান সারা জীবন সদর বাজারে বসবাস করেছেন এবং কীভাবে এর সামাজিক সমীকরণগুলি গত ছয় বছরে বদলে গেছে তা দেখেছেন। তিনি বলেন, যারা আমাদের সঙ্গে বাজারে কাজ করেন তারা সহায়তা করে চলেন৷ কিন্তু যখন এই জাতীয় ঘটনা ঘটে তখন কেউ নিরাপদ বোধ করেন না। মাংস ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত লোকদের মধ্যে মাংস পরিবহনের লোকেরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বাজারের অপর এক কর্মী সুলতান৷ তার মতে, এখন আমাদের মতো দীর্ঘ-প্রতিষ্ঠিত বাজারও হুমকির মুখে পড়ছে৷
ভারতে গোরক্ষকদের উত্থান
————————
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো অনেক মানবাধিকার সংগঠন বলছে, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোরক্ষা, গোভক্তি নতুন উদ্দীপনা নিয়ে জেগে উঠেছে। হরিয়ানা সরকার সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার গোরক্ষাকারী কমিটি এবং গরু পাচারকারীদের ‘ধরার’ জন্য হেল্পলাইন চালু করে ‘গরু পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই’তে যোগ দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৭ – ২০১৯ সাল পর্যন্ত গোরক্ষকরা ৪৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে, ৫২ বছর বয়সি মুহাম্মদ আখলাককে গোমাংস রাখার সন্দেহে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে পিটিয়ে মেরেছিল গোরক্ষকরা৷ ২০১৬ সালে মুহাম্মদ মাজলুম আনসারী (৩৫) এবং ইমতিয়াজ খানকে (১২) গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে ঝাড়খণ্ডে পিটিয়ে হত্যা করে গোপ্রেমীরা৷ ২০১৭ সালে রাজস্থানের আলওয়ারে গবাদি পশু পরিবহনের সময় ২০০ গোভক্ত পেহলু খানকে পিটিয়ে মারে৷ লুকমান ও পেহলু খানের বাড়ি একই জেলা নুহে৷ বাদশাহপুরের সদর বাজার এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী এবং বাসিন্দা বলছেন, লুকমানের ঘটনাটি এমন একটি ‘রিমাইন্ডার’ যা কোভিড-১৯ অতিমারি এবং ফলস্বরূপ লকডাউন কিছুদিন এটাকে আড়াল করলেও এই গোরক্ষার সংস্কার দূর হয়নি। সময় ও সুযোগ পেলেই উন্মত্ত হয়ে উঠছে তারা৷ ফখরুদ্দিন বলছিলেন, গোমাংস বিক্রির অভিযোগ তুলে তারা আমাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নিদান দেয়৷ আমাদের জীবন সবসময় হুমকির মুখে। এবার ওদের শিকার ছিল লুকমান৷ পরের বার আমাদের মধ্যকারই কেউ ওদের বর্বরতার শিকার হবে৷