কবিতা

মওলানা রুমির পঙক্তি : প্রথম পর্ব

457views

–মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ: জাভেদ হুসেন

১.
মিষ্টি আর তিক্তের সমুদ্র একত্রে বয়ে যায়
তবু মাঝে তার দেখ ব্যবধানের চিহ্ন রয়ে যায়

২.
যদিও আলাদা তবু তার উৎস অভিন্ন
দুইই এক হয় সেই উৎসে ফিরে গেলে

৩.
পরখ করার শক্তি যার আছে
সে বিশ্বাস থেকে সন্দেহ পৃথক রাখে

৪.
পূর্ণ মানুষ সত্যের রহস্য জানে
মত্ত, আত্মহারা আপাদমস্তক বিস্ময়ে মগ্ন

৫.
এক মুখ সর্বদা ফিরে আছে প্রিয়র দিকে
এক চেহারা নিজেই হয়েছে প্রিয়র মুখ

৬.
আউলিয়ার সাথে কাটানো এক মুহূর্ত
নিষ্ঠাহীন শত বছরের উপাসনার চেয়ে ভালো

৭.
হৃদয়বানের কাছেই হৃদয় প্রশান্তি পায়
সৌভাগ্যবানের কাছেই সৌভাগ্য পাওয়া যায়

৮.
যখন ইচ্ছে বেদনাকে আনন্দ করে দাও
পায়ের শেকল মুক্তির বার্তা শোনায়

৯.
মানব বুদ্ধি যেন অস্থির সমুদ্র
যে ডুবল সে হলো সফল

১০.
বুদ্ধি আবৃত আর জগত উন্মুক্ত
আমরা যেন সমুদ্রের বহমান স্রোত

১১.
যে নজরে এলো তারই হয়ে গেলাম
নিজের মগ্নতা থেকে সরে হারিয়ে গেলাম

১২.
জীবনকে বেদনার সাথে পরিচিত করাও
যেন রক্তিম, সবুজ আর ধূসর চিনতে পারো

১৩.
কী করে চিনবে একেকটা রঙ আলাদা করে
যতক্ষণ তুমি খোদ আলোকেই না দেখছ

১৪.
চন্দ্র নক্ষত্রে এই জগত আলোয় আলো
আর গোপন যে সে সত্যের আলোয় তুর পাহাড়ের ঈর্ষা

১৫.
দেখার চোখ হৃদয়ের আলোর প্রকাশ
হৃদয়ের আলোতেই তোমার দৃষ্টির আলো

১৬.
সত্য যদি আমাদের দুঃখ বেদনা না দিতো
কী করে জানতাম আনন্দ কাকে বলে

১৭.
সত্যের আলো দেখার ধৈর্য শক্তি আছে কার
তুর আর মুসার গল্প পড়ে নাও

১৮.
বুদ্ধি থেকে যখন ভাবের স্রোত ওঠে
সে তখন মিশে যায় কথা আর শব্দে

১৯.
যখনই অরূপ থেকে এক রূপ জন্ম নিলো
তার দিকে নিবেদিত হওয়ার ছিল, তাই হলো

২০.
তোমার বিরহে নিরন্তর ঝরে অশ্রুধারা
নিরন্তর দীর্ঘশ্বাস প্রাণ ওষ্ঠাগত

২১.
আমরা বীণা তুমি তার মিজরাব
এ অঝোর বর্ষণ আমার নয়, কাঁদছ তুমি

২২.
তুমিই তো অনস্তিত্ত্বকে অস্তিত্ত্ব দিয়েছ
তারপর নিজে তাকে তোমার পাগল করেছ

২৩.
তুমি সব ছিনিয়ে নিলে অভিযোগ কেন হবে?
চিত্র তো চিত্রকরের সামনে কাঙাল হবেই

২৪.
সেই সৃষ্টি করে কখনো শয়তান কখনো মানুষ
সেই কখনো করে দুঃখী কখনো প্রফুল্ল

২৫.
মোম আর সলতে আগুনে নিজেকে বিলিয়ে
অনুজ্জ্বল ছিলো, হলো সর্বাংগ আলোকময়

২৬.
যে অনস্তিত্ত্ব হতে ক্ষণিকে নিঃসন্দেহ হতে পারে
সে তেমন শত জগত তৈরি করতে পারে

২৭.
এক দৃষ্টিতেই শত জগত নজরে পড়ে
দেখবার চোখ তাকে যখন কদর দেয়

২৮.
এই দুনিয়াতে তোমার শরীর ও প্রাণ কয়েদ হয়ে আছে
যেদিকে করুণা আছে বলে দাবী সেদিকে চলো

২৯.
অগণিত ফেরাউনের বর্শা মাথা নোয়ায়
এক মুসার যষ্ঠির সামনে

৩০.
প্রাণ আরশের দিকে নিয়ে যেতে পারে
তুমি কি না গিয়ে পড়লে মৃত্তিকার সংকীর্ণতায়

৩১.
যে তুমি আরশে ফেরেশতাদের ঈর্ষার পাত্র ছিলে
সংকীর্ণতার মাঝে সংকীর্ণতর হয়ে গেলে

৩২.
আমার পথই আমার চলার পাথেয় লুটে নিল
আমার শরীর আমার প্রাণ হরণ করতে চায়

৩৩.
প্রাণের দুশমনের সাথে যখন কারবার
ভরসা যদি থাকে সে তোমার করুণা

৩৪.
অশুভের হাত থেকে জীবন যদি রক্ষাও পায়
তোমার বাসনা না থাকলে সে জীবন বৃথা

৩৫.
প্রিয়র মিলন না হলে প্রাণ সে প্রাণহীন
আলো সে অন্ধকারতম উজ্জ্বল মুখের আলো ছাড়া

৩৬.
নারগিসের চোখ বন্ধ ছিলো তাকে খুলে দিলে
বীণা থেকে সুর কেড়ে আবার সুর ভরে দিলে

৩৭.
সেই মদিরা, সাকি সে, সেই মদিরাসেবী
আমি নিজে যখন নেই, সব তখন এক

৩৮.
যদি নমরুদ হও তবে আগুনে ঝাঁপ দিও না
ইব্রাহিম হয়েই সামনে এগোও

৩৯.
যে শব্দ একবার জিভ থেকে বের হয়ে গেল
ধনুকের থেকে তীরের মতই সে ছুটে গেল

৪০.
পিপাসার্ত যদি করে জলের সন্ধান
জলও খুঁজে ফেরে পিপাসার্তকে

৪১.
সে যদি হয় প্রেমিক তবে নীরব থাকো
শ্রবণ পেয়েছ যদি কান পেতে থাকো

৪২.
মৃত্যুতেই পাবে তুমি জীবন
হৃদয় বিলিয়েই পাবে হৃদয়

৪৩.
দুই জগতে কেন একে প্রকাশ করবো?
এই রহস্য পর্দার আড়ালে থাকাই ভালো

৪৪.
কেন সেই মহিমার তরে রক্তঅশ্রু বইয়ে
প্রেমিকের দলে শামিল হবো না আমি?

৪৫.
দিনও আমার রাতের মতো অন্ধকার হবে না কেন
যতক্ষণ না দেখি দিনকে আলো দেয়া সেই মুখ

৪৬.
কাঁদবো না কেন? সে যে কান্নায় খুশি হয়
সে জগতের অশ্রুবর্ষণে খুশি হয়

৪৭.
প্রিয়র অবিশ্বস্ততায় খুশি আমার হৃদয়
সেই হৃদয়ব্যাধির জন্য উৎসর্গ করবো প্রাণ

৪৮.
বেদনার ধুলো চোখের সুর্মা বানাও হে দৃষ্টিবান
চোখের সমুদ্র তাহলে মুক্তোতে পূর্ণ হবে

৪৯.
তাকে চেয়ে ঝরে চোখ বেয়ে যে অশ্রুধারা
অশ্রু নয় সে তো অমূল্য মুক্তো

৫০.
প্রাণের প্রাণ ! তোমার কাছে আমার যত অনুযোগ
সে তো আমার হৃদয়ের হাল শোনানোর বাহানা

চলবে…

Leave a Response