আমার একবার জানতে ইচ্ছে হলো— এই যে সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরে আমাদের এই নেশা, এই উন্মত্ত উন্মাদনা, দিন-রাত এক করে এখানে বুঁদ হয়ে থাকা, আমাদের অবস্থাই যদি এমন হয়, এসব মিডিয়া যাদের হাতে গড়া, তাদের অবস্থা না জানি কী হবে!
এমন কৌতূহল থেকেই আমি টেক-জায়ান্টদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে এসবের ভূমিকা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। ফলাফল হিশেবে যা পেলাম তাতে আমি একেবারে থঁ!
প্রযুক্তি-দুনিয়ায় যাকে প্রথম সারির একজন ধরা হয়, সেই অ্যাপল ব্র্যাণ্ডের সাবেক সিইও স্টিভ জবসের বরাতে জানা যায়, তার বাচ্চারা আই-প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কখনোই স্বাধীন ছিলো না। অর্থাৎ— ইচ্ছে হলেই বাচ্চারা আই-প্যাড নিয়ে বসে যেতো পারতো না বা সারাদিনমান আই-প্যাডে বুঁদ হয়ে থাকতে পারতো না।
প্রতিদিন কতো সময় তারা আই-প্যাড ব্যবহার করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিলো। এমনকি, রাতে খাওয়ার টেবিলে কোন প্রকার ডিভাইস যাতে পরিবারের কারো হাতে না থাকে, সেদিকে থাকতো স্টিভ জবসের সজাগ দৃষ্টি। ওই সময়টায় এই টেক-বস বাচ্চা এবং পরিবারের সকলের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে পছন্দ করতেন। আলাপ করতেন বিভিন্ন বই নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই-ও জানাচ্ছেন একই কথা। তার ঘরে বাচ্চাদের জন্য ডিভাইস এবং টেলিভিশন উন্মুক্ত নয়। কোন রাগঢাক না রেখেই এই টেক-জায়ান্ট জানাচ্ছেন, এই কাজ তিনি তার বাচ্চাদের ভালোর জন্যেই করে থাকেন।
অ্যাপলের স্টিভ জবস বা গুগলের সুন্দর পিচাই কেবল নয়, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের ব্যাপারেও একই কথা। তার বাচ্চাদের জন্যও স্ক্রীন-টাইম ছিলো যথেষ্টই সীমিত।
ইউটিউবের সিইও এবং রেড্ডিটের প্রতিষ্ঠাতারাও তাদের বাচ্চাদের স্ক্রীন-টাইম নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক। স্ন্যাপ-চ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইভান স্পাইগেল তো তার শৈশব-কৈশোরে মোবাইল ফোন-ই হাতে পাননি এবং তার আজকের সফলতার পেছনে ছোটবেলার ডিভাইস-ফ্রি লাইফের যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি নির্ধারণ করেছেন— তার বাচ্চা সপ্তাহে সব মিলিয়ে কেবল দেড় ঘন্টা স্মার্ট-ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
আমি আশ্চর্য বনে যাই— যেসব লোকেরা তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষকে স্ক্রীনে বুঁদ করে রাখছে, তারা কেনো নিজেদের এবং তাদের বাচ্চাদের স্ক্রীন-টাইম নিয়ে এতোখানি সতর্ক? এর পেছনের রহস্যটা কী?
স্ক্রীনের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়ে যারা ভাবছি যে অনেককিছুই আমরা শিখে ফেলছি, আমাদের মতো করে কেনো ভাবতে পারেন না এসব স্ক্রীন কারিগরেরা? কেনো স্টিভ জবস তার বাচ্চাকে আইপ্যাডের সামনে অবাধে ছেঁড়ে দিতে রাজি হোন না? কেনো ইউটিউবের সিইও তার বাচ্চাদের ইউটিউবের সামনে বুঁদ হয়ে থাকতে বলেন না? কেনো গুগলের সিইও তার বাচ্চাদের ডুবে যেতে দেন না গুগলের সীমানাহীন তথ্য ভান্ডারে?
সচেতন পাঠক, এর একটাই কারণ— এখানে আপনি যতোখানি না শেখার জন্যে সময় ব্যয় করেন, তারচে বেশি সময় ব্যয় করেন আসক্তির কারণে। এসব সোশ্যাল মিডিয়ার এলগরিদম এমনভাবেই সাজানো যাতে আপনি অনেকবেশি সময় এখানে কাটাতে বাধ্য হোন।
[ ‘বেলা ফুরাবার আগে-২’ এ সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি এবং এর প্রতিকার নিয়ে যে অধ্যায়টা থাকছে, সেখান থেকে এক টুকরো। বইটি প্রকাশিত হবে ২০২২ বইমেলায়, ইন শা আল্লাহ। ]