সেক খালিদ আলি
শতকের পর শতক ধরে কঠোর হিন্দু বর্ণ প্রথাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভারতের সমাজ কাঠামো। ১৯৫০ সালে সাংবিধানিক ভাবে বর্ণ ব্যবস্থাকে বিলোপ করা হলেও সমসাময়িক ভারতীয় সমাজের রেশ এখনও বহাল আছে। ব্রাহ্মণী বর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণ চারটি, যে ব্যবস্থাকে আমরা বর্তমানে বর্ণ প্রথা হিসেবে জানি তা হিন্দুধর্মের আদি গ্রন্থে বর্ণাশ্রম ধর্ম বা চতুবর্ণ নামে পরিচিত, চার ধরনের বর্ণ ব্যবস্থা। হিন্দু সমাজের প্রায় ৪০০০ স্ববর্ণবিবাহ সিদ্ধ হিন্দু বর্ণ ও উপবর্ণ রয়েছে। এদের প্রত্যেকের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পেশার উপর ভিত্তি করে ৪টি বর্ণে বিভক্ত ১. ব্রাহ্মণ (যাজক) ২. ক্ষত্রিয় (সৈন্য) ৩. বৈশ্য (বণিক) ৪. শূদ্র (দাস)। এছাড়াও আছে বর্ণ বাহ্য অতিশুদ্র, উপমানুষ, তাদের নিজস্ব শ্রেণিক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত। যাদের এক সময় বলা হত অস্পৃশ্য যারা অদৃশ্য, অনভিগম্য যাদের উপস্থিতি, যাদের ছায়া। যাদের ছোঁয়া উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের কলুষিত করে দেয় বলে মানা হয়।
জন্মের প্রথম দিনটি থেকে একরকম নরকে বসবাস করতে শুরু করে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। নিচু শ্রেণিতে জন্মানোটা তাদের ভুল নয়, কিন্তু তার পরও নিচু বর্ণে জন্মানোর মাশুল তাদের গুণতে হয় সারাটা জীবন। নিচু বর্ণে জন্মালে খারাপতর দাসত্ব বরণ করে নেওয়া যেন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেবল অন্য সম্প্রদায়ের নয়, নিজ সম্প্রদায়ে নানা কুসংস্কার আর বৈষম্যের শিকার হয় দলিতরা। দরিদ্র আর বর্ণ বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার আশায় বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম, শিখ ধর্মে কিংবা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হযে পড়েন দলিতদের অনেকে। কিন্তু এতেও তাদের জীবন যাপন দুরহ হয়ে ওঠে। তাদের উপর মানসিক পীড়ন শুরু হয়ে যায় ও সংরক্ষণের আওতার বাইরে করে দেওয়া হয়।
মহাত্মা গান্ধী দলিতদের হরিজন বা ঈশ্বরের সন্তান বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু তাতেও এদের অবস্থার বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। আজও এরা অচ্ছুত। এদের মন্দিরে যাবার অধিকার নেই। উচু জাতের সাথে এক কুয়ো থেকে জল নেবার অধিকার নেই। এমন কী একই শ্মশানে দাহ করার অধিকার নেই। এখনও দলিতদের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, রাস্ত-ঘাট ঝাড় দেওয়া, গাড়িতে করে ময়লা তুলে দেওয়া এই কাজ গুলো তাদের জন্ম সূত্রে পাওয়া বলে অনেকে অনেকে মনে করেন। শুধু মুম্বাই শহরেই প্রাতিদিন জমা হয় ৭ হাজার টন ময়লা। যার পরিস্কারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয় দলিতদের।
দলিত সমাজের এই নিষ্পেষিত, ‘অস্পৃশ্য’ মানুষদের উপর সামাজিক নিষ্পেষনতো আরো ভয়ানক। ১৩ জুন ২০১৫ সালে দুত্তরপুর (মধ্যপ্রদেশ) গ্রামে উচ্চবর্ণের এক পরিবারের পালোয়ানের গায়ে ছায়া পড়ায় দলিত সম্প্রদায়ের শিশুকন্যাকে নির্মম প্রহার করা হয়। সে বছরই উত্তরপ্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগরের বৃহত্তর নইদা এলাকার এক দম্পতি থানায় গিয়েছিলেন ডাকাতির মামলা করতে। মামলা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টে পুলিশের মারখেতে হয়েছে হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের এই দম্পতিকে। শুধু তাই নয় পুলিশ তাদের বাজারে রাস্তার মধ্যে কাপড় খুলে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখে। ২০১৫ সালের মে মাসে শাহজানপুর জেলায় জালালবাদে ৫ অথবা ১৫ জন নারীকে দিনের বেলায় নগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘুরিয়ে তাদের শরীরে মারা হয়েছিল বেত। রাজধানী নয়া দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সাম্পে গ্রামে ২ দলিত শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৯২ সালে তামিলনাড়ু রাজ্যে সরকারি বাহিনীর কর্মকর্তার দ্বারা ১৮ দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ১০০-র বেশি দলিতকে মারধর করা হয়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র মতে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন দলিতের সাথে আরেক জন অদলিত অপরাধ করে, প্রতিদিন ৪ জনেরও বেশি অস্পৃশ্য নারী স্পৃশ্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। প্রতি সপ্তাহে ১১ জন দলিত খুন হয়। এবং ৬ জন দলিত অপহৃত হয়। শুধুমাত্র ২০১২ সালেই ১৫৭৪ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয় এবং ৬৫১ জন দলিতকে হত্যা করা হয়। (বৃদ্ধঙ্গুলির শাসানির জেরে) অপরাধের মাত্র ১০ ভাগ প্রাকাশিত হয়)। ধর্ষণ ও বর্বরতা লুন্ঠণ আর নগ্ন হতে বাধ্য করাই নয়, জোর পূর্বক মানুষের মল খাওয়ানো, জমি দখল, সমাজ চ্যুত করা, খাওয়ার পানি আনতে বাধা দেয়া। এ পরিসংখ্যানে পাঞ্জবের বান্ত সিং-র কথা উল্লেখ করা হয়নি, যিনি ছিলেন একজন মাযাহাবি দলিত শিখ। ২০০৫ সালে যার দুই হাত এবং একটি পা কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেওয়া হয়, কারণ সে তার মেয়ের গণধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দুঃসাহস দেখিয়ে ছিল বলে।
সমীক্ষা বলছে ২০১৩ সালে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে মোট ৪.২ লক্ষ মানুষ বন্দি ছিলেন। তাতে কারাবন্দিদের ২২ শতাংশ দলিত অথচ আদমসুমারির (২০০১) রিপোর্ট যেখানে বলছে জনসংখ্যার মাত্র ১৭ শতাংশ দলিত। পুরো বন্দিদের ৫৩ শতাংশ সংখ্যালঘু। তবে কি এই সম্প্রদাযভুক্ত মানুষরা বেশি অপরাধ করেন? এই যুক্তি সম্পূর্ণ উড়িযে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী কলিন গোনজালভেস বলেন, এই সম্প্রদায়ের মধ্যে দারিদ্রতা খুবই প্রকট। তার ওপর ভারতীয় সমাজের ধর্মীয় ও জাতপাতের ভেদাভেদ অত্যন্ত প্রকট হওয়ার কারণে আইনের চোখেও তারা অবহেলার পাত্র। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের গণমাধ্যমগুলোও এই অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে অস্পৃশ্যই রেখে দিয়েছে। কর্পোরেট মিডিয়ায় রূপান্তকারি গণমাধ্যমগুলোও যেভাবে উচ্চবর্ণের মানুষদের প্রমোট করে, বর্তমান ভারতবর্ষে এক্ষেত্রে সামান্যতম যদি দলিতদের ব্যাপারে যত্নবান হত তাহলে এদের চিত্র অনেকটাই পরিবর্তন হত বলে আমি মনে করি।
১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। তাতে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক নাগরিকের সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে।
১৯৫৭ সালে এসে সংবিধানের শুরুতেই বলা হল ভারত হবে সার্বভৌম, সমাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। বলার অপেক্ষা রাখেনা সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যে জওহরলাল নেহেরুর রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ চিন্তার প্রতিফলন পড়েছিল।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-এ তিনটি আদর্শের লক্ষ মহৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতীয জনগণ আদর্শ তিনটির আশীর্বাদের কোনোটিও সমান ভাবে পেয়েছে, এমন কথা জোর গলায় বলা যাবে না।
তাই তো গবেষক ছাত্র রোহিত ভেমুলার নিজের জীবন দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন দলিত তথা সংখ্যালঘুরা কতটা অসহায়।