
আবু রাইহান
তারপর
আন্দালিবের তো কেউই নিকটজন আর নেই এ যুক্তিটি রোকসানার প্রধান বিবেচ্য হয়েছে।অন্যদিকে যুদ্ধোত্তর কালে রোকসানার অনুরোধ অনুযায়ী মোমেনাকে বিয়ের কথা বললেও মোমেনা কাবিল কে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত কাবিল যাকে বিয়ে করে নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ছিল সে মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ তার বন্ধু নিশার এর স্ত্রী আঞ্জুমান। জটিল মনোজগতের প্রেম আকাঙ্ক্ষা ও দ্বন্দ্বের ভাঁজগুলোকে আল মাহমুদ সুপরিকল্পিতভাবে আলো ফেলে ফেলে স্পষ্ট করেছেন। এবং দক্ষ কোথাকারের কলাকৌশলে কাবিলের বোন প্রেমের উপন্যাস হিসেবে ও একটি উল্লেখযোগ্য নাম। কিন্তু কন্যাশ্রীর বাঙালি ও বাঙালি দ্বন্দ্ব ও অধিক মনোযোগ এর দাবিদার। 5 পর্বে বিভক্ত উপন্যাসটির প্রথম পর্বে দ্বন্দ্বটি উন্মোচন। প্রথমে পারিবারিক পর্যায়ে পরে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে। মুহাজির মেয়েকে বিয়ে করার কারণে কাবিলের চাচা বড় ব্যবসায়ী হয়েও বাঙালি সমাজে আদৃত হননি। যদিও গভীর অবলোকনের স্পষ্ট হয় ব্যাক্তি পর্যায়ে দ্বন্দ্ব বিশেষ বিবেচিত হয়নি। উপন্যাসটির দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে অগ্নিদাহ 1970 দিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সক্রিয় কর্মী কাবিল ও রোকসানা দুজনে। ছয় দফা আন্দোলনের এই ইতিহাসের সময়টাকে আল মাহমুদ ধরার চেষ্টা করেছেন গল্পের প্লট ও চরিত্রের ভেতর দিয়ে। তৃতীয় পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি। শুয়ে পড়বে সামগ্রিক রাজনীতির কর্ণধার শেখ মুজিবর রহমান এবং ছাত্র আন্দোলনে তার নির্ভরযোগ্য উত্তরসূরি সৈয়দ কাবিল আহমেদ। পাকিস্তানের অস্তিত্ব সংকটের সময়ে অবাঙালিদের দুশ্চিন্তা তাদের জাতিসত্তার প্রশ্নে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা যত ত্বরান্বিত হয়েছে, বিহারিদের সংকটময় পরিস্থিতি উপন্যাসটিতে ততো বেশি করে অনুভূত হয়েছে। বাঙালি অবাঙালি দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে যে মানুষটি সে হলো রোকসানা। যার বাবা বাঙালি এবং মা ও বাঙালি আর দুর্মুখ ভাষায় শেহাব বাঙালি। জাতি দ্বন্দ্বের দোলাচলে সেই তো বড় শিকার’। কাবিলের বোন উপন্যাসের শেষ পর্বে আন্দালিব এর সাথে বাঙালি ও বাঙালি প্রসঙ্গে রোকসানা বলেছিল মানুষের চরম নিষ্ঠুরতা দেখে দেখে ঠিক করে নিয়েছি, কেবল মানব সন্তান হওয়া ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আমার বেঁচে থাকার আর অবলম্বন নেই। আল মাহমুদের কাবিলের বোন উপন্যাসটি মানবিকতার চূড়ান্ত জয়গান।আকৃতিতে ছোট হলেও নিশিন্দা নারী আল মাহমুদ এর একটি অসাধারণ উপন্যাস। আল মাহমুদ কি প্রশ্ন করা হয়েছিল নিশিন্দা নারী উপন্যাস পড়ে মনে হয় এই উপন্যাসের অসাধারণ বর্ণনা অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্ভব নয়। এরকম অভিজ্ঞতা কি আপনার আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আল মাহমুদ বলেছিলেন অভিজ্ঞতা না থাকলে এগুলো কি করে হলো? অভিজ্ঞতা আছে বলেই তো লিখেছি। অভিজ্ঞতা তো কত কিছুর মধ্য দিয়েই আসে। সব কি আমি বলব সে তো সম্ভব নয়। উপন্যাসের বিষয় তাও আমি জানি। সেখানকার বামপন্থীদের আন্দোলন ও জানি। আব্দুল্লাহ যে চরিত্র এ ধরনের চরিত্রের সঙ্গে আমার ওঠা বসা ছিল। এজন্য আমি লিখতে পেরেছি। এর মধ্যে মানবতা যতোটুকু এসেছে কিংবা সেক্স শপ টা না লিখে গেছি। একদম আটকাইনি। আমি জানি অসাধারণ লেখা এটা। কিন্তু আমি লেখার সময় এটা জটিল মনে করিনি। স্বাভাবিকভাবেই লিখে গেছি। এখন দেখি আমাদের সাহিত্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য বই। কিন্তু আমি যখন লিখি তখন এগুলো চিন্তাই করিনি।আল মাহমুদ নিশিন্দা নারী উপন্যাস বর্ণনায় প্রতীক এবং চিত্রকল্প নির্মাণের চূড়ান্ত প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। বাম রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী আবদুল্লাহ মাঝি 15 দিন যাবত উধাও হয়ে যাওয়ার পর, এক গভীর রাতে তার স্ত্রী নিশিন্দা কে দিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিতাস পাড়ের এক গ্রামে এই উপন্যাসের কাহিনী স্থাপিত। প্রথম পরিচ্ছদ এই মানব ইতিহাসের প্রধান দুই নিয়ামক যৌনতা এবং খুদার উপস্থিতি। আর এই দুই নিয়ামক এর পরিতৃপ্তির উপায় প্রথম পরিচ্ছদ এই ঘুমের ভেতরে নিশিন্দা সন্ধান পায়। জনমানবহীন চারণভূমিতে গরুর রাখালী তার উদ্দেশ্য। কেননা এখন সত্যিকারের খাওয়ার কিছু থাকলে তা আছে তিতাসের শ্যাওলা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসিন্দাদের রাধা ভাত আর ফ্যান পানি। এভাবে সকল দরিদ্র জনগণ নিশিন্দার গোত্রভুক্ত। তার স্বামী আব্দুল্লাহ মাঝি যে গোত্রের মাঝি। মানুষ গরু সবাই সেই একই কাতারের। স্বপ্নে গরু গুলোর উপস্থিতি যেন অতি বাস্তব এক আবহ তৈরি করে। যার ভেতরে নিছক এক বাস্তবতাকেই আল মাহমুদ উপস্থাপন করেছেন। বিচিত্র এবং বহুধা এতসব বোধের উপস্থিতি আল মাহমুদের অন্য কোন উপন্যাসে পাওয়া যায় না। উপন্যাসটির প্রথম অনুচ্ছেদ অতিক্রম করতেই সে জগতের রহস্য ময় তা ক্রমশ বর্ধমান। স্বপ্নে ষাঁড় গুলি যদিও নিশিন্দা ভালো করে বুঝতে পারছে এসবই স্বপ্ন। তার উঠোন নোংরা করা শুরু করতেই নিশিন্দা ক্ষুদার্থ গাড়িগুলোর সিং এর কাছাকাছি চলে এলো। এই জাবর কাটা মাগির দল আমার উঠোন নোংরা করবি না বলে দিচ্ছি। আমার তুলসী গাছের দিকে মুখ বাড়ালে পাট কাটার সেটি দিয়ে জিব কেটে ফেলবো। নিশিন্দা দত্তখোলার চামারের মেয়ে। আব্দুল্লাহ মাঝির সাথে ঘর বাধার সময় ঋষিপাড়া থেকে এসে একটি তুলসী গাছ এনে দাওয়াই পুতে সকাল সন্ধ্যা বাতি জ্বেলে মাথা নোয়ালে মাঝি তাকে যে ধমক দিয়েছি লতা মাঝির মানুষ বুঝতে সাহায্য করে। এই চামার নি তুই না মুসলমান হয়েছিস, তুই না আমার বউ। খবরদার গাছের এপির মানলে আমি তোরে দুই টুকরা করে কেটে তিতাসের মাখনা খেতে পুতে রাখবো।
চলবে…