মহাব্বত সেখ
ষষ্ঠাদশ শদাব্দীর দিকে ‘নাস্তিক্যবাদ’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হলেও মূলত বৈদিক ভারতে এর সূচনা হয়। উল্লেখ্য, খীষ্ট্রপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এক দার্শনিককে প্রথম নাস্তিক দার্শনিক বলে মনে করা হয়। তিনি হলেন, গ্রীক দার্শনিক ডাযাগোরাস। De Nature Deorum গ্রন্থে তিনি প্রথম পৃথিবীর সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। অনেকে আবার বলে থাকেন যে, খীষ্ট্রপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রীক দার্শনিক থিয়োডোরাস এব ল্যাম্পসকাস ও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না।
আনুমানিক খীষ্ট্রপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে নাস্তিক্যবাদের প্রতিষ্ঠা হয, বিশেষ করে তিনটি হিন্দু দর্শনের উত্পত্তির মধ্য দিযে এগুলি হল- চার্বাক, জৈন এবং বৌদ্ধ দর্শন। এই সময মূলত হিন্দু দর্শন দুটি ভাগে বিভক্ত হযে পড়ে । একটি আস্তিক দর্শন আর অন্যটি হল নাস্তিক দর্শন। আস্তিক দর্শনের মধ্যে চার্বাক, বৌদ্ধ আর জৈন দর্শন।
২০১৫ সালে প্রকাশিত ২০১১-র জনগণনায় বলা হয়েছে ভারতে ২৮৭০০০০ জন ভারতীয তাদের কোনো ধর্ম উল্লেখ করে নি। যা ভারতের জনসংখ্যার ০.২৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে করা এক সমীক্ষায় WIN Gallup Global Index of Religion and Atheist এর সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৪ শতাংশ ভারতীয় হচ্ছে নাস্তিক। একই সংস্থার করা ২০১২ সালের সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৩ শতাংশ ভারতীয কোনো ধর্মই মানে না।
যাক এতো সব রিপোর্ট দেখার আগে ফিরে যাওযা যাক মূল কথায়। নাস্তিকতার জন্ম প্রসঙ্গে কার্ল মাকর্সের দু একটা কথা বর্ণনা করা যেতে পারে। কেননা কার্ল মাকর্সকে আধুনিক নাস্তিক্যবাদের জনক বলা হয়। ১৮৪১ সালে কার্ল মাকর্স তার পিএইচডির থিসিসে ধর্ম সম্বন্ধে যেসব কথা বলেছিলেন তা হলো ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ সমূহ নিছকই অসার বা শূন্যগর্ভ পুনরুক্তি।’ ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসবাদের সার কথাটি হল- ধর্ম মানুষের তৈরী, মানুষ ধর্মের তৈরী নয়। ধর্ম হচ্ছে একধরনের ইলিউশন, মানুষ যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলে বা যে মানুষ কখনও নিজেকে খুজে পায়নি, তারা বা তাদের জীবনেই ধর্মের স্থান আছে। মার্কস লিখেছেন, ‘ধর্ম হচ্ছে সেই বিভ্রান্তির সূর্য যা মানুষের চারপাশে ঘুরতে থাকে যতক্ষন না সেই মানুষটি নিজেই নিজের চারপাশে ঘুরতে না শেখে’।
এখন দেখা যাক, নাস্তিক্যবাদের জন্মের আসল রহস্য কি? ধর্ম কি নিছক একটা আফিম জাতীয় নেশা, ঈশ্বরের কি আদৌ অস্তিত্ব আছে? না ইশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই যা নাস্তিক্যবাদের মূলমন্ত্র। এখন আমরা দেখবো নাস্তিক্যবাদের জন্মের পিছনে যেসব কারণগুলি অনুঘটকের কাজ করছিল বা আজও করছে তা হল ধর্মীয় রসম-রেওযাজের বাড়বাড়ন্ত। বা অন্য কথায় বললে বলতে হয় ধর্মীয় অনুশাসন।
সেই প্রাচীন গ্রীস হোক কিংবা ভারতবর্ষ যেখানেই নাস্তিকতার জন্ম হোক না কেন, যে সময়ে হোক না কেন, সে সুদূর অতীদের সেই খীষ্ট্রপূর্ব তৃতীয় শদাব্দী বা বর্তমান একবিংশ শদাব্দী। সবখানের সবসময়ে নাস্তিক্যবাদী মানসিকতার পেছনের অনুঘটক হচ্ছে ধর্মীয় আচরণের বাড়বাড়ন্ত। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- ভারতে বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ে ধর্মীয় অনুশাসনে মানুষ যেমন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তেমনি আবার কিছু মানুষ নিজেরাই ধর্মের প্রতি অর্থাৎ ধর্মীয় গুরুদের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে নাস্তিক্যবাদকে গ্রহণ করতে শুরু করেন। আর তাতে ইন্ধন জোগায় নাস্তিক্য দর্শনের ভাবধারা।
চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব তখন ঐ সমস্ত উৎপীড়িতদের মগজে বাসা বাঁধতে শুরু করে। অন্যদিকে ইউরোপ বা আমেরিকায় যখন চার্চের প্রধান যাজকদের অত্যাচার যখন সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে যাজকেরা যখন নিজেকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পাঠানো দূত বলে মানুষদের উপর ধর্মীয় বিধি আরোপ করতে শুরু করেন তখনই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন। কার্ল মার্কস তার থিসিসে এ কথাই বলেছেন।
ধর্ম প্রসঙ্গে লেনিনের মত হল ‘আধুনিক সমস্ত ধর্ম ও গির্জা, সর্ববিধ ও সমস্ত সংগঠনকে মার্কস সর্বদাই মনে করতেন বুর্জুয়া প্রতিক্রিয়ার সংস্থা, শ্রমিক শ্রেণীর শোষন বজায় রাখা ও তাদের ধাপ্পা দেওয়া তাদের কাজ।’