হজরত মুহাম্মাদ(স:) এর সমগ্র জীবন হল ইসলামি জীবনবিধানের সমগ্র নিয়মনীতির বাস্তব অনুশীলনের এক অনুপম উদাহরণ। তিনি আমাদের সামনে জীবনাচারের এক অভিনব জীবন্ত এবং সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল পন্থা পেশ করেছেন। যাতে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানবগোষ্ঠীর প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য যতগুলো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তার সকল কিছুর শরঈʼ সমাধানের বাস্তব ও সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ মিলতে পারে। হজরত মুহাম্মাদ (স:) এমন এক সমাজে বসবাস করতেন যে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে তাঁর চাল-চলন, আচার-আচরণের সুস্পষ্ট নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর পবিত্র জীবনীতে। তাঁর সময়কার সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিল ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি অমুসলিমদের সামাজিক স্বীকৃতি, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সদাচারণ, ন্যায়পরায়নতা এবং বিশেষভাবে শত্রুনেতাদের প্রতি তাঁর মহানুভবতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে এক অতুলনীয় নমুনা পেশ করেছেন।
নবী মুহাম্মাদ(সঃ) যখন কোনও অমুসলিমের সাথে কথোপকথন করতেন তখন তিনি এক আদর্শিক পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তিনি তাদেরকে শুধুমাত্র স্বীকার করাকেই যথেষ্ট মনে করতেন না বরং তাদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মানও প্রদর্শন করতেন। আর এটা তিনি আল্লাহর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইশারায় করতেন। সেখানে ব্যক্তিগত কোনও চিন্তা ছিল না । তাঁর এই আদর্শিক পদ্ধতি হল পবিত্র কুরআনের প্রতিধ্বনি। অমুসলিমদের সাথে কথোপকথনের পদ্ধতি শিক্ষা দিতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “বল, আসমানসমূহ ও জমিন থেকে কে তোমাদের রিযিক দেন ? বল, আল্লাহ। আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা সত্যপথে প্রতিষ্ঠিত অথবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত। বল, আমরা যে অপরাধ করেছি সে ব্যাপারে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমাদেরকেও জিজ্ঞাসা করা হবে না। বল, আমাদের রব আমাদেরকে একত্র করবেন। তারপর তিনি আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফয়সালা করবেন । আর তিনি শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী ও সম্যক পরিজ্ঞাত।” ( সুরা সাবা – আয়াত ২৪-২৬)
তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে তিনিই সত্য ও হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন৷ তথাপি আল্লাহতায়ালা তাঁকে অমুসলিমদের সঙ্গে যে পদ্ধতিতে কথা বলতে আদেশ দিয়েছেন, আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত অথবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত। এটি তো কেবলমাত্র ওই দুই প্রতিপক্ষের কথোপকথনের নমুনা যাদের মধ্য হতে কোনও এক প্রতিপক্ষের সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। অথচ তাঁকে এই পদ্ধতিতে কথা বলতে আদেশ করা হয়েছে। এটি ইসলামের উন্নত চরিত্র, চূড়ান্ত সত্যতা ও কথোপকথনের সর্বোত্তম আর্দশিক পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতঃপর আল্লাহতায়ালা অমুসলিমদের প্রতি পূর্ণ ভদ্রতা বজায় রেখে সম্বোধন করার আদেশ দিয়ে বলেন, “বলো, আমরা যে অপরাধ করেছি সে ব্যাপারে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমাদেরকেও জিজ্ঞাসা করা হবে না। বলো, আমাদের রব আমাদেরকে একত্র করবেন। তারপর তিনি আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফায়সালা করবেন। আর তিনি শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী ও সম্যক পরিজ্ঞাত।”
এখানে মুসলিমদের জন্য জুরম বা অপরাধ শব্দ ও অ-মুসলিমদের জন্য আমল বা কাজ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রসুল (সঃ) হিসাব-নিকাশের পূর্ণ দায়িত্ব আল্লাহর দিকে সমর্পিত করেছেন আদর্শিক পদ্ধতি দিয়ে।
এটিই হল পারস্পারিক কথোপকথনের সর্বোৎকৃষ্ট হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতি যেখানে পক্ষপাতমূলক চিন্তা কিংবা রূঢ়তা ও কঠোরতার লেশমাত্রও নেই। যেখানে আছে প্রতিপক্ষকে যথাযথ মূল্যায়ন ও পূর্ণ ভদ্রতা প্রকাশের বাস্তব প্রতিফলন।
এ বিষয়ে একটি ঘটনা হল: রবীআহ ইবন আব্বাদ দাইলি (রাঃ) প্রথম যুগে কাফের ছিলেন, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি বর্ণনা করেন, আমি, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে , যুল-মাযাজ বাজারে রসুল (সঃ) কে স্বচক্ষে দেখেছি যে, তিনি লোকদেরকে সম্বোধন করে বলছেন,
“হে লোক সকল! তোমরা এটা মেনে নাও যে, এক আল্লাহ ব্যতীত কোনও ইলাহ নেই, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে । তিনি বাজারের প্রতিটি অলিতে গলিতে প্রবেশ করছেন এবং একই কথা বলে বেড়িয়েছেন। আর তার চতুর্পাশ্বে লোকেরা ভিড় করে জড়ো হয়ে গিয়েছিল। আমি কাউকেই কিছু বলতে শুনিনি, তবে তার পেছনে টেঁরা, স্বচ্ছ মুখাবয়ব ও মাথায় চুলের দুটি বেণীবিশিষ্ট এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, সে বলছে , এ লোকটি সাবেঈ, মিথ্যাবাদী । আমি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যক্তিটি কে ? লোকেরা বলল, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ, নবুওয়াতের দাবিদার । আমি বললাম, তার পেছনের লোকটি কে ? লোকেরা বলল, তারই চাচা আবু লাহাব।”
আবু লাহাব ও আবু জাহালদের এহেন স্পষ্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার পদ্ধতিতে কোনোরূপ পরিবর্তন করলেন না৷ বরং মানুষকে তিনি মুক্তি ও সফলতার প্রতিই আহবান করেছেন। সম্বোধনের ক্ষেত্রে নম্রতা, কোমলতা ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশই শুধু নয় বরং রসুল (সঃ) কখনও কখনও অমুসলিমদের প্রশংসাও করতেন। হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে আসা মক্কার প্রতিনিধি কাফির নেতা সুহাইল বিন আমরের প্রশংসা করতে গিয়ে রসুল (সঃ) বলেন, “( প্রতিনিধি হিসাবে সুহাইলের আগমনের ফলে) তোমাদের জন্য ব্যাপারটি সহজ হয়ে গেছে।” যেহেতু রসুল(সঃ) তাঁর স্বভাবগত নম্রতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই জানতেন। তাই তিনি আমরের প্রসঙ্গে এমন উক্তি করেছেন৷ রসুল (সঃ)নিজে কবিতা চর্চা করতেন না এবং তেমন বেশি শুনতেনও না। অথচ কবিতায় ভালো বিষয়বস্তু উপস্থাপনের জন্য তিনি একজন মুশরিক কবির প্রশংসা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
আরবের কবি লাবীদ বিন রাবীয়ার কবিতার প্রশংসায় তিনি বলেন (অথচ কবি তখনও ইসলাম গ্রহন করেননি), “কবিরা যেসব কথা বলে , তন্মধ্যে লাবীদের কথাটাই সবচেয়ে বেশি সত্য যে, ( সে বলেছে)শোন আল্লাহ ব্যতীত সব কিছুই বাতিল।”
তিনি প্রশংসা এমন সময় করলেন যখন মুসলমানদের মধ্যেও কবি হাসসান বিন সাবিত, কাআব বিন মালিক, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা প্রমুখ ভালো ভালো কবি ও সাহিত্যিকগণ বিদ্যমান আছেন।
এই সমস্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে অমুসলিমদের ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি যেটা রসুল (সঃ) করে দেখিয়েছেন। এটা আত্ম-উপলব্ধি, সম্মান এবং মর্যাদাকর দৃষ্টিভঙ্গি ও মহত্তর পন্থা যা রসুল (সঃ) মনবতার জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করেছেন। ইমাম মুসলিম রহ. তাঁর বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থে অমুসলিমদের ব্যাপারে রসুল (সঃ)-এর এক উজ্জল দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেছেন, “কায়স বিন সাদ ও সাহল বিন হুনায়িফ দুইজনই কাদেসিয়ায় অবস্থান করছিলেন৷ তাদের পাশ দিয়ে একটি মৃত ব্যক্তির দেহ নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে উভয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদেরকে বলা হল যে, এ মৃত্যুদেহ একজন কাদেসিয়াবাসীর। তাঁরা দুইজনই বললেন, রসুল (সঃ)এর পাশ দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল, তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল জানাযাটি ইহুদির৷ রসুল (সঃ) বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?”
এটাই হচ্ছে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। রসুল (সঃ)এর উপরোক্ত অবস্থান বা আচরণের দ্বারা সকল শ্রেণির মানুষের জন্য মুসলিমদের হৃদযন্ত্রে আত্ম-উপলব্ধি, এবং সম্মানের বীজ বপন করেছেন এবং এরূপ সম্মানসূচক আচরণ তিনি সাধারণভাবেই করেছেন৷ ওই ইহুদির আলাদা কোনও বৈশিষ্টের জন্য নয়। তিনি কেবল নিজে করেই ক্ষান্ত হননি বরং অন্যদেরও এরূপ করার আদেশ দিয়েছেন, একথা জানার পরও যে ওই লোকটি একজন ইহুদি ছিল।
অমুসলিমদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে রসুল (সঃ) এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে, তিনি অমুসলিমদের জন্যে তাদের ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন। অথচ তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, এটি মূল আসমানী গ্রন্থ নয়। এতে বিকৃতি সাধন করা হয়েছে এবং নবী-রসুলগণের ব্যাপারে অযৌক্তিক ও মনগড়া অনেক কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি তাদের ধর্মীয় বই সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন। খায়বার দূর্গ বিজয়ের পর সেখানে কতগুলো ধর্মগ্রন্থ পাওয়া গিয়েছিল। তন্মধ্যে তাওরাতও ছিল। রসুল (সঃ) সবগুলোকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখলেন। ইহুদিরা তাদের তাওরাত চাইতে আসলে রসুল (সঃ) সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত তাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন । আজ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সঃ) ব্যতীত বিরোধীদের সঙ্গে এ ধরনের উন্নত আচরণ-বিধি মেনে চলার মতো কোনও মহামানবের সন্ধান দিতে পারেনি৷ রসুল (সঃ)এর এই সমস্ত আচরণগুলো লক্ষ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গেই চারিত্রিক মাহাত্ম্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। তিনি এই চারিত্রিক মাহাত্ম্য পরিচয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা-ই নয়, আদেশ-নির্দেশ-অনুরোধ করেছেন তার সঙ্গী ও পরবর্তী অনুসরণকারীদেরকেও৷
লেখক: মো. আমানুল্লাহ
শিক্ষক, রাজাপুর হাইস্কুল ও গবেষক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়