featuredউত্তর সম্পাদকীয়

অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পের আজানা কাহিনি

562views

গোলাম রাশিদ


মা ও বাচ্চা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ, সদ্য বিবাহিতা নারীরা ভিড় জমিয়েছেন কোকরাঝাড় জেলা সংশোধানাগারের ভিতরে। এর মধ্যে রহমান ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন। রহমান এখানে আসার জন্য একটি বাস, একটি ট্রেন এবং শেষে আরেকটি বাসে চেপেছেন। তিনটি ভারী ব্যাগে করে এনেছেন নানা জিনিস –কলা, আপেল, নুন, পান, সাবান, তেল, অসমের ঐতিহ্যবাহী ‘গামোচা’, এমনকী একটি শাড়িও।

সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি কোকড়াঝাড় কারাগারে আসছেন। আগে শুধু আঙুলের ছাপ কিংবা একটি নামসই যথেষ্ট ছিল কারও সঙ্গে দেখা করার জন্য। এখন রীতিমতো দরখাস্ত লিখতে হয়, জানাচ্ছেন রহমান।

ভিড় থেকে কয়েকফুট দূরে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর আবেদন লেখার জন্য একটি কলম বের করেন। রহমান শিক্ষিত, কিন্তু তাঁর চারপাশে যারা আছে, তারা অধিকাংশই নিরক্ষর। তাদের মধ্যে অনেকে নীরবে কাঁদছে। যাদের সঙ্গে তারা দেখা করতে এসেছে, তারা হল ‘ডি’ ভোটার। অসমে ‘ডি’ মানে ডাউটফুল ভোটার বা সন্দেহজনক ভোটার। তাদের জায়গা ডিটেনশন ক্যাম্প। যেমন আছে আলির বোন, রহমানের শাশুড়ি।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তার শাশুড়ি রিজিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পায় রহমান। ৫৬ বছর বয়সি মহিলা তাকে দেখে ভেঙে পড়েন। তিনি তাঁর পিতা কাফিরউদ্দিনের ভোটার লিস্টের কথা বলেন তাঁর জামাইকে। তাঁর আশা, ওটাই হতে পারে মুক্তির টিকিট। ২০১৫ সালে একটি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাঁকে, তাঁর স্বামী আইয়ুবকে ও তাঁদের দুই মেয়েকে বিদেশি ঘোষণা করেছিল। মামলাটি গুয়াহাটি হাইকোর্টে গিয়েছিল। শেষ নাগাদ সু্প্রিম কোর্টে তাঁদের আবেদন খারিজ হয়। রিজিয়াকে এখানে পাঠানো হয়। আর তাঁর স্বামী আইইয়ুবকে পাঠানো হয় তেজপুর জেলের ডিটেনশন ক্যাম্পে। অন্যদিকে, দুই মেয়ে এখন দিন গুনছে কবে তাদের তুলে আনা হয়।

রহমানের স্ত্রী-মা-আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসতে ভয় পান। গত তিন বছরে তিনি একবারই তাঁর আব্বাকে দেখেছেন যখন তাঁকে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

কারাগারের ভিতরে ডিএফএন (ডিক্লেয়ার্ড ফরেন ন্যাশনালস)-রা থাকে আলাদা কোয়ার্টারে। এই ঘরগুলো উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে, শত শত নারী একটি ছোট জায়গায় খালি মেঝেতে ঘুমোয়। ২৭ বছর বয়সি মরজিনা বিবির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, আমি জীবনে কখনও এই খাবারের কথা ভুলতে পারব না৷ সকালে এক কাপ লাল চা আর পাতলা রুটি। তারপর সাড়ে দশটা ও সাড়ে চারটেয় দু’বেলা খাবার। আমি প্রায় এক মাস না খেয়ে কাটিয়ে। সবজির তরকারি থেকে আমি আলু বেছে ভর্তা করে খেতাম। ওরা যা দেয়, তা খাওয়া যায় না।

বিমল বৈদ্যকে ১৩ মাস গোয়ালপাড়া জেলে রাখা হয়েছিল দাগি আসামিদের সঙ্গে। ওরা খুব খারাপ ব্যবহার করত। সিকিউরিটি গার্ডরা বলত, তোরা বাংলাদেশি, এখান থেকে চলে যা। এরপর ২০১৭-এর ডিসেম্বরে কোর্টের রায়ে বিমল জানতে পারল সে ‘ভারতীয়’! সে মুক্ত হয়ে বাড়ি এল। সেই বাড়িতে যেখানে তার স্ত্রী মারা গেছে কয়েকমাস আগে।

এক অফিসিয়াল রেকর্ড অনুসারে ২০১৮-এর ৪ ফেব্রুয়ারি নাগাদ রাজ্যের ছ’টি ডিটেনশন সেন্টারে মোট ৮৯৯ জন আটক আছেন। গোয়ালপাড়ায় ৩,০০০ লোক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন একটি সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। তেজপুরে, যেখানে রহমানের শ্বশুর আছেন, সেখানে সবচেয়ে বেশি লোক আটক করে রাখা হয়েছে। ২৬৮ জনের দিন গুজরান হচ্ছে এই কারাগারে।
রহমান কোকরাঝাড় জেলে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করার দু’দিন পর তেজপুরে আসে একইরকমভাবে ফলমূল ভর্তি তিনটি ব্যাগ নিয়ে তার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক ভারতীয় পিতা, তার দুই শিশুকে নিয়ে তাদের ‘বাংলাদেশি’ মায়ের সঙ্গে দেখা করাবে বলে। যখন মহিলা জানালার কাছে আসলেন, লোকটি কান্না লুকানোর জন্য মুখ আড়াল করে ফেললেন।

এ দিকে রহমানের শ্বশুর বললেন, ‘তুমি আমার হাইস্কুল শিক্ষক রূপরাম স্যারের সঙ্গে দেখা কর। সে হয়তো আমার স্কুল সার্টিফিকেট দিতে পারবে। ভুলো না স্যারের নামটা, রূপরাম। এই সার্টিফিকেট হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।’ এইভাবে বুকে আশা নিয়ে বেঁচে আছেন অসমের শত শত মানুষ। তাঁরা ঠিক একদিন প্রমাণ করে দেবেন, তাঁরা বিদেশি নন, তাঁরা ভারতীয়!

২০১২ সালে কোকরাঝাড় ও শিলচরের বন্দি শিবির তৈরি হয়। পরে গোয়ালপাড়া, তেজপুর, ডিব্রুগড় ও জোরহাটে এমন বন্দি শিবির গড়ে ওঠে। এর শেষ কবে হবে ? কেউ জানে না।

Leave a Response