ফারুক আব্দুল্লাহ
দিল্লীর মুঘল বাদশাহদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে প্রাদেশিক শাসকদের খাদ্যাভ্যাসের তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য ছিলনা।তবে সেই সময় প্রাদেশিক শাসকদের খাদ্যাভ্যাসে কিছু আঞ্চলিক স্বাদ যোগ হত।বাংলার নবাবদের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ছিল না।তবে বাংলার নবাবরা খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অওধের নবাবদের মতো বিলাসিতা কখনই দেখাননি।বাংলার নবাবরা যেহেতু মুঘল খাবারে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই নবাবদের অধিকাংশ পছন্দের পদ গুলি ছিল আমিষ জাতীয়।তারা নিরামিষ খাবার তেমন খেতেন না বললেই চলে।নবাবদের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় থাকত কয়েক রকমের পোলাও,বিরিয়ানি।এছাড়াও থাকত কোফতা,কোর্মা,কালিয়া,মুর্গ মাসাল্লাম,নিম্বু গোশত,এছাড়া বিভিন্ন রকমের কাবাব যেমন,শিক কাবাব, বটি কাবাব, শামি কাবাব, হাণ্ডি কাবাব, খিড়ি কাবাব প্রভৃতি।এছাড়া বিভিন্ন ধরেনের রুটি যেমন, রোগ্নি রুটি, মিঠা রুটি,রুমালি রুটি,ও বাকরখানি।এছাড়াও ছিল মাংসের নানান পদ।ছিল বিভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি নানান ধরনের বিরিয়ানি। বাংলার নবাবদের বিরিয়ানি ছিল মুঘল ঘরানার।বিরিয়ানি তৈরি হত কামিনীভোগ,বা গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে।কেওড়া জলের বদলে বিরিয়ানিতে দেওয়া হত গোলাপ জল,বিরিয়ানির জন্য মশলা আসত ইরাণ থেকে।এছাড়াও নবাবের শাহী বাবুর্চিরা মাছের পোলাও এর উদ্ভব করেন যা মাহি পোলাও নামে পরিচিত।এছাড়াও ছিল বিভিন্ন স্বাদের পোলাও(মুর্গ পোলাও,জর্দা পোলাও,আনাস পোলাও,জিঙ্গা পোলাও,মাছলি পোলাও বা মাহী পোলাও,আম পোলাও)।অথচ আজ এইসব খাবারের অধিকাংশই বিলুপ্ত হতে চলেছে।নবাবী শাহী পদ গুলির যে কয়েকটি বর্তমানে রয়েছে সেগুলিও সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে অওধ,হায়দ্রাবাদ ও রামপুরে নবাবী খাবারের স্বতন্ত্র ঘরানা থাকলেও মুর্শিদাবাদে নবাবী খাবারের কোন ঘরানা গড়ে ওঠেনি কেন?
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, মুর্শিদাবাদের নবাব ওয়াসিফ আলি মীর্জা নানান অর্থনৈতিক জটিলতায় মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস করতে বাধ্য হলে তিনি তার শাহী বাবুর্চিদেরও সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে যান। তার মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র ওয়ারিশ আলি মির্জা নবাব হলে তাকেও কলকাতাতে বসবাস করতে হয়। ফলে নবাবদের শাহী বাবুর্চিদের অধিকাংশই তখন থেকেই কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করে এবং তারা পরবর্তীতে আর কখনই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেনি।নবাবদের মৃত্যুর পর নবাবদের বংশধররা অর্থাভাবে তাদের কাজ থেকে বরখাস্ত করলে তারা কলকাতার স্থানীয় বহু রেস্তোরাঁয় কাজে যোগ দেয়।অন্যদিকে ১৯৬৯ সালের ২০শে নভেম্বর নবাব ওয়ারিস আলি মির্জার মৃত্যুর পর থেকে ২০১৪ সালের ১২ই আগস্ট পর্যন্ত যোগ্য নবাবের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে মুর্শিদাবাদের মসনদ খালি পড়েছিল। নবাব না থাকায় বাবুর্চিদের কদর করার মতো তেমন কেউই ছিল না মুর্শিদাবাদে।অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারে যেসব সদস্যরা বসবাস করতেন তাদের আর্থিক সচ্ছলতাও তেমন না থাকায় তাদের রসুইখানায় বাবুর্চি রাখার বিলাসিতা তারা দেখাতে পারেননি।ফলে কর্মচ্যুত হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে শাহী বাবুর্চিরা কাজের খোঁজে শহরমুখী হয়।কারণ ততদিনে মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব অস্তমিত হয়ে পড়েছিল।যে সব অল্প কিছু বাবুর্চি মুর্শিদাবাদে স্থায়ী ভাবে রয়েগেছিল তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকদের অভাবে পূর্বপুরুষদের পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় নিয়োজিত পড়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদ থেকে শাহী নবাবী বাবুর্চিরা বিলুপ্ত হয়ে গেলে মুর্শিদাবাদে নবাবী খাবারের ঘরানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তবুও আশার আলো এই যে, মুর্শিদাবাদ থেকে শাহী বাবুর্চিরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও নবাবী খাবার কিন্তু এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।নিজামত পরিবারের মহিলাদের কাছে আজও নবাবী আমলের নানান শাহী খাবারের রেসিপি রয়েগেছে বংশ পরম্পরায়। কিন্তু সেই সব শাহী খাবারের রন্ধন পদ্ধতি গুলি অতিশীঘ্রই লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা না গেলে বাংলার নবাবী ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহনকারী এই সব শাহী খাবার গুলি হয়ত একদিন সবার অজান্তেই চীরতরে হারিয়ে যাবে।