featuredইতিহাস-ঐতিহ্যইসলাম

কাবার পথে হজের কাফেলা

737views

গোলাম রাশিদ

 

পথ প্রথমেই তৈরি হয়ে থাকে না। তৈরি করে নিতে হয়। প্রয়োজনের তাগিদে প্রচলিত হয় নতুন রাস্তা। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হজ৷ সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য মক্কা-মদিনা তীর্থযাত্রা অবশ্য কর্তব্য৷ তখনও বিমান আবিষ্কার হয়নি, হয়নি ঝকঝকে পেট্রোডলার ব্যয়িত হাই রোডও৷ তাই হজে যাবার জন্য স্থলপথের ভরসা ছিল ক্যারাভ্যান৷ দলবেঁধে উটের পিঠে কিংবা হেঁটে লম্বা জোব্বা পরে শত শত মানুষ কাবার পথ পাড়ি দিচ্ছে, এমন দৃশ্য অপ্রতুল ছিল না৷ জলপথে জাহাজে করেও হজযাত্রীরা যেতেন৷ মুঘল আমলে ভারতের সুরাট উপকূল থেকে হজযাত্রার বড় বড় জাহাজ ছাড়া হত৷ মক্কা-মদিনায় হজযাত্রার জন্য এভাবেই গড়ে ওঠে বহু নতুন নতুন রাস্তা, দীর্ঘ রুট। বিশ্বজুড়ে তীর্থযাত্রীদের কাফেলা মক্কায় যেত বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে। কিন্তু সকল পথ শেষে একটাই গন্তব্যস্থলে পৌঁছায়, যার দিকে মুখ করে নামায আদায় করে বিশ্বের মুসলিমরা, সেই পবিত্র কাবার পথ। মক্কার পথ, মদিনার পথ। কল্যাণের পথ৷ পবিত্র পথ৷

শতাব্দীকাল ধরে প্রাচীন হজযাত্রার পথগুলি বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও জ্ঞানপ্রবাহ ও ইসলামি দেশগুলির মধ্যে শান্তি ও যোগাযোগের একটি সেতু হিসাবে কাজ করেছে। রুটগুলি শুধুমাত্র হজ তীর্থযাত্রীদের দ্বারা নয়, সারা বছর ধরে বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য যাত্রীদের দ্বারাও ব্যবহৃত হত। ব্যবসা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। মহানবী মুহাম্মদ সা. নিজেও ব্যবসা করতেন এবং ছোটবেলায় এক ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া গিয়েছিলেন চাচা আবু তালিবের সঙ্গে। এছাড়া প্রাক-ইসলামি যুগে বিভিন্ন মেলা (যেমন-ওকাজ), কাবাঘর তীর্থ ( নবী মুহাম্মদ সা. -এর আগমনের পূর্বে মুশরিকদের মধ্যে যে ধরণের হজ প্রচলিত ছিল) করতে প্রচুর মানুষ মক্কায় আসত। স্বভাবতই এর প্রয়োজনে মক্কায় আসার জন্য চতুর্দিকে নানা রুট তৈরি হয়। হজ রুটের মধ্যে ইরাকি, সিরিয়ান, মিশরীয়, ইয়েমেনি ও ওমানি রুটগুলি সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেমন এই জায়গাগুলি উল্লেখযোগ্য ছিল, তেমনই ইসলামি সভ্যতার বিকাশলাভের সময় এই দেশগুলি ছিল প্রথম সারিতে। বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়া তো একসময় খিলাফতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের সময় ইরাকের বাগদাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। ইসলামি সভ্যতার কাছেই ইউরোপীয়দের রেনেসাঁসের জন্য হাত পাততে হয়েছিল৷ তখন সেখানে তারা জ্ঞানচর্চার জন্য পাড়ি দিত৷ ফলে ইউরোপীয়রা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের মতো আলখাল্লা বা জোব্বাজাতীয় বড় পোশাকের ব্যবহার শেখে এবং শিক্ষা সমাপ্ত হলে সেই পোশাক পরে নিজ দেশে ফিরত৷ পরে ইউরোপ বিদ্যায়তনিক দিক দিয়ে বিকাশলাভ করলে সেই বড় পোশাক পরার ট্রাডিশন রয়ে যায়৷ এখনও বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কনভোকেশনে বড় টুপি, গাউন পরার রীতি চালু আছে৷ এটা ইসলামি সভ্যতার অবদান৷ মুসলিম খলিফা ও সুলতানগণ হজ রুটগুলি তৈরিতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। ‘হজ আমির’ নামে আলাদা একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হজ বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা তত্ত্বাবধান করতেন। হজ আমিররা দীর্ঘ সড়কের (যাকে আমরা রুট বলছি বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে) ধারে স্টপেজ বানাতেন যাত্রীদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। এখন যেমন স্টেশন ও বাসস্টপ—তখন ছিল এইসব বিশ্রামাগার, সরাইখানা। অর্থাৎ, দীর্ঘ সড়কের ধারে স্টপেজ তথা ক্যারাভ্যান সরাই নির্মাণের এই ঐতিহ্য মুসলিম শাসকরাই প্রথম চালু করেছিলেন। একটি স্টপেজ বা স্টেশন থেকে আরেকটি স্টপেজের দূরত্বও হজ আমিররা পরিমাপ করে রাখতেন যাতে যাত্রীরা বুঝতে পারেন পরবর্তী স্টপেজ কত দূরে।

ঐতিহাসিক ও গবেষকরা মক্কা ও মদীনায় যাওয়ার সাতটি প্রধান রুট গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন। কুফা-মক্কা রুট হজ এবং বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ বলে বিবেচিত ছিল। ইরাকের বাগদাদ থেকে ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে কুফাতে পৌঁছানো যাবে। এই রুটটি ‘দারব জুবাইদাহ’ (জুবাইদাহের পথ) নামেও পরিচিত ছিল। খলিফ হারুন আল রশিদের স্ত্রীর নামে এটির নামকরণ করা হয়েছিল, যিনি পথটি প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য করেছিলেন। ইরাক ও ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী দেশগুলিতে ইসলামের প্রভাব বিস্তারের পর থেকেই এর ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। আব্বাসীয় যুগে এই রুট বাগদাদের সঙ্গে দুই পবিত্র মসজিদ মসজিদ-উল-নববী ও মসজিদ-উল-হারাম এবং বাকি আরব উপদ্বীপের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে ওঠে। রুটগুলি ছিল সুপরিকল্পিত এবং ভালোভাবে গঠিত। সড়কের ধারে সরাইখানা, বিশ্রামাগার, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল। পুকুর, কূপ থেকে পানি পানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর। আরবদেশগুলি এমনিতেই মরুভূমিময়। সেখানে পানির এই ব্যবস্থা করতে নিশ্চয় খলিফা, সুলতানদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। এ সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি তীর্থযাত্রীদের জন্য যাত্রা যেমন সহজ করতে সাহায্য করেছিল, তেমনই ব্যবসায়ীরাও এই পথ ব্যবহার করে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যেতে উৎসাহ, উদ্যম অনুভব করতেন। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফত ক্রমশ দুর্বল হলে রাস্তাটি বিদ্রোহী উপজাতি দস্যুদের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাবাজাহ স্টেশনগুলির মতো বেশ কিছু সড়ক স্টপেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধ্বংসও হয়। পরবর্তীকালে সড়কপথটির মূল কাঠামো হারিয়ে যায়, রোডম্যাপ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। দস্যুদের কব্জায় থাকায় এটি সুরক্ষিতও ছিল না। ফলে হজযাত্রীরাও এটির ব্যবহার কমিয়ে দেয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে মোঙ্গলদের বাগদাদ জয়ের পর রাস্তাটি বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং এর বেশিরভাগ স্টেশন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কুফা-মক্কা রুটের ধারে যেসব স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল, তা অনন্য ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীকে উপস্থাপন করে। উঁচু মানের শিল্পী-কারিগর দ্বারা সূক্ষ্ম নকশা– কারুকাজ– ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার করে বানানো এইসব স্থাপত্য বিশ্বের দরবারে সমীহ আদায় করে নিয়েছিল। মুসলিম স্বর্ণযুগের এক-একটি নিদর্শন ছিল এগুলি।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হজ রুট হল বসরা-মক্কা রুট। আরব উপদ্বীপের উত্তরপূর্ব দিকের ওয়াদি আলবাতিন ও বেশ কয়েকটি মরুভূমি অতিক্রম করে এই রুট উম্মে খারমন স্টেশনে পৌঁছে কুফা-মক্কা রুটের সঙ্গে যুক্ত হয়। মিলনের আগে এরা সমান্তরালভাবে চলেছিল। রুটটি ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এতে ২৭ টি প্রধান প্রধান স্টপেজ রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি এখন ইরাক এবং কুয়েতের অভ্যন্তরে রয়েছে। বাকিগুলি সৌদি আরবে অবস্থান করছে। তৃতীয় হজ রুটটি হল মিশরীয় হজ রুট। এই পথটি মিশর, মরক্কো, আন্দালুসিয়া ও আফ্রিকার হজযাত্রীদের দ্বারা ব্যবহৃত হত। মামলুক ও ওসমানি যুগে সমগ্র মিশর থেকে তীর্থযাত্রীদের কাফেলাগুলি কায়রোর কাছে বারাকাত আলহজ্বে জমায়েত হত। তারপর সুয়েজ পথ দিয়ে সিনাই উপদ্বীপ অতিক্রম করে কাবার পথে আসত। মিশর-মক্কা রুট দিয়ে হজযাত্রীদের হজ করতে আসতে এক মাসের অধিক সময় লেগে যেত। এই রুট বরাবর শত শত আরবি শিলালিপি পাওয়া যায়। কাফেলার যাত্রীরা হজ যাত্রার দীর্ঘ সময়ের পথস্মৃতিকে খোদাই করে রাখত পাথরে। এতে অন্য অনুসারী যাত্রীদেরও সুবিধা হত। মক্কার পথ এই দিকেই গিয়েছে, সেটা তারা নিশ্চিত হত। চতুর্থ উল্লেখযোগ্য হজ রুট হল শামি, যেটি লেভান্তকে মক্কা ও মদীনার সঙ্গে সংযুক্ত করে। তাবুকের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় আল তাবুকিয়া নামে এটি পরিচিত ছিল। এই রুটের সূচনাস্থল সিরিয়ার দামাস্কাস। সেখান থেকে দারার বুসরা আল শামের মধ্য দিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে যায় সড়কটি। পঞ্চম হজ রুট হল ইয়েমেনি হজ রুট। মক্কাকে যখন হেজাজ নামে ডাকা হত, অর্থাৎ প্রাচীন যুগ থেকেই এই হজ রুট ইয়েমেন ও হেজাজকে যুক্ত করেছে। উত্তর ইয়েমেনের আদেন, তায়িজ, সানা, জাবিদ ও সা’দা থেকে হজ কাফেলাগুলি যাত্রা শুরু করে মক্কার দিকে চলে যেত। ষষ্ঠ হজ রুট ওমানী হজ রুট। ওমান থেকে যাত্রা শুরু হয়ে ইয়াবরিন, বাহরাইন, ইয়ামামা, দারিহ্-এর মধ্য দিয়ে হজযাত্রীরা এগিয়ে যেত। সপ্তম উল্লেকজযোগ্য হজ রুট বাহরাইন-ইয়ামামা -মক্কা হজ রুট। এটি বসরা রুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল, যা আরব উপদ্বীপের মাঝ বরাবর মক্কার দিকে এগিয়েছে। এই রুটে দস্যুদের উৎপাত ছিল যথেষ্ট। তাই এ পথে হজযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল।

এভাবে প্রধানত সাতটি রুট ধরে হজ যাত্রার পথ তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রশস্ত হয় বাণিজ্যের পথও। ফলে যে পথ দিয়ে একসময় কাফেলাগুলি যেতে ভয় পেত, কিংবা যে পথ এড়িয়ে যেত, বা আবিষ্কারই হয়েছিল না যে পথের, হজযাত্রার প্রয়োজনে সেই পথগুলিতে মানুষ চলাচল শুরু হয়। ইসলামি সভ্যতার পরশ পৌঁছে যায় চতুর্দিকে। মক্কায় হজ করতে আসতেন বহু মানুষ। আর সঙ্গে করে নিজেদের ভূমিতে নিয়ে যেতেন অনন্য অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের বীজ, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে বহির্বিশ্বের দরবারে।

Leave a Response