লিটন রাকিব
বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সেই ছবি। সুন্দর এবং শান্ত। সমস্তটা যেন ভোরের আলপনা আঁকা। মুহূর্তেই আমি এবং আমার ছোটবেলারা ছুটে ছুটে চলে যায় নবিননগরে…
নোনা মাটির সোঁদা গন্ধ অনুভব করি কিন্তু স্পর্শ পাই না আর কিছুতেই।
আমি হাঁটি, ভয় পাই আবার শান্ত হই কিন্তু স্পর্শ পাই না কিছুতেই। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি অচিনপুরে কিন্তু কিছুতেই যেন পৌঁছাতে পারছিনা কাঙ্খিত স্বপ্ন ভোরে। চুপচাপ কাটে সময়। সকাল দেখি তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ডানামেলে সন্ধ্যে নামে এভাবেই যেন চলতেই থাকে। যার কোন ভাষা নেই, নেই শব্দ, নেই কোন গতিও। শুধুই কুঁকড়ে থাকা !
নিঃস্ব লাগছে। নিজের হাত- পা, শরীরের কলকব্জা; যারা কত আপন ছিল ক্রমশ অযান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। ভয় কিসের? মৃত্যুর পরোয়ানা!
সারাটাদিন চেয়ে আছি আকাশ পানে শূন্যতা যেন সবখানেই।
অথচ প্রকৃতি যেন তার মৃত যৌবন ফিরে পেয়েছে। গাছে গাছে কত নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির। শত শত বছর পর যেন প্রকৃতি খুঁজে পেয়েছে নতুন করে তার নিজস্ব ছন্দ ; নিজস্ব নিস্তব্ধতা।
রাজনীতি যখন দুর্বল হয় তখন ধর্মের হাত ধরে আর ধর্ম দুর্বল হলে রাজনীতির কিন্তু অসহায় মানুষগুলোর হাত কেউ ধরে না কখনো। তাই ভালো করে বাঁচতে চাইলে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হই একমাত্র প্রকৃতিই পারে। তাই প্রকৃতির হাত ধরি।এক পৃথিবীর একশো রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য রয়েছে, হ্যাঁ; একমাত্র তারই।
# # #
গত কয়েকদিন ধরেই চোখে ভাসছে সারা দেশজুড়ে লক্ষ্য লক্ষ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায় বিধ্বস্ত মুখগুলো। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।বোধ, বুদ্ধি-বিবেক সব মাথা কুটে কুটে মরছে নিজের মধ্যেই! বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ওরা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
ওরাই আমার স্বজন। লকডাউনকে উপেক্ষা করে কাতারে কাতারে মানুষ দিল্লি মুম্বাই জড়ো হয়েছে। বাচ্চাকে ঘাড়ে নিয়ে, অসুস্থ মাকে কিংবা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর হাত ধরে পোঁটলাপুটলি সমেত শত শত মাইল পায়ে হেঁটে কেউবা আবার সাইকেলে রওনা দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। এরা সকলেই আমার চেনা মানুষ; কাছের মানুষ। ছোটবেলার খেলার সাথী, কেউবা আবার সহপাঠী গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের, আবার কেউ কেউ আমাকে মানুষ করেছে, কেউবা আবার আমাদের বাড়িতে চাষের কাজও করেছে।
কবে যেন এরা সব গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে লাগলো। জীবন জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিল ভিনরাজ্যে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিল্লি, মুম্বাই, কেরল, হরিয়ানায় পাড়ি দিল।
আগুন তো আমারই আবিষ্কার। আমার কোনো আঙুল যদি সে আগুনে কারো ঘর পোড়ায়, সে দায় আমারও। আমার কোন হাত তোমার মত কাউকে আঘাত করে বটে ;আবার সেই ক্ষত সারিয়েও দেয়। তুমি কি দেখোনি পারমাণবিক শক্তি দিয়ে মরুভূমির বুকে সবুজ পতাকার উড়ান। কালাজ্বর, জলাতঙ্ক, ম্যালেরিয়া, পোলিও, ক্যান্সার, কলেরা,বসন্তের মতো আতঙ্ককেও রুখেছে মানুষ। করোনাকেও রুখবে মানুষ।
দেখছোনা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রান দিয়েও মানুষের পাশে রয়েছে। মনে রেখো, মায়া-মিশর,হরপ্পা-মহেঞ্জদারো গড়েছি আমরা আবার ত্যাগও করেছি। আমি তো মানুষ নিত্য নতুন গড়ে তোলাই আমাদের কাজ। আর এই পথ চলাতেই আমাদের এগিয়ে চলা গোটা ভারতবর্ষকে সঙ্গে নিয়েই…
জীবন অতি সামান্যই! হাজার হাজার বছরের আমিত্ব আর উত্তরাধিকার বহন করি মাত্র। আমি শুরু, আমি শেষ ;আমিই গোধূলি, আমিই বজ্রপাত…
এ কিছু নয়.. কিছুই না।
আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন ঠিক পৌঁছে যাবো আমাদের নিরন্ন গ্রামে। একদিন তো ঠিক খুঁজেই পাবো সেই সোনালী সম্ভারে ভরা আমাদের উঠোন। তাই এই চিরকালীন আলপথ ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা…