
তৈমুর খান
স্বাধীনতা মানে মুক্ত আকাশ, যেখানে নির্ভয়ে নিজের মতোই বাঁচতে পারি। নিজের ভাষায় কথা বলতে পারি। নিজের ঈশ্বরকে ডাকতে পারি। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে পারি। নিজের পছন্দ মতো প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে পারি। স্বাধীনতা মানে তো তাই-ই হবে —“মায়ের জায়নামাজের পাটি” থেকে “মক্তবের চুলখোলা আয়েশা আক্তার”।
কিন্তু আজ আমরা কি সেই স্বাধীনতা পেয়েছি?
বহু রক্ত ক্ষয় আর প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এল তাকে কি স্বাধীনতা বলে? না, স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। স্বাধীন বলে একটা দেশকে ঘোষণা করা হয়েছে, একটা নিরপেক্ষ সর্বময় সংবিধানও রচিত হয়েছে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঠিকই, এসবের কোনো ত্রুটি ঘটেনি। কিন্তু পক্ষান্তরে স্বাধীনতার মোড়কে এসেছে গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। জনগণের মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েও তাঁরা সংবিধানকে নিজের মতোই পাল্টে নিয়েছেন। সংবিধান পাল্টানোর ধারাবাহিকতায় কখনো ছেদ পড়েনি। জনগণের ইচ্ছার মর্যাদা না দিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থান্বেষী বর্বরতা কায়েম করেছেন। যদিও তা সর্বদা প্রকট হয়েছে এমন নয়। কিন্তু বর্তমানে এর নগ্নরূপ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এবং উঠছে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু মতাদর্শের বৈচিত্র্যময় একটি দেশ ভারতবর্ষ। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঈশ্বর বিশ্বাস বহুবর্ণময় ভিন্নতায় বহুধা বিস্তৃত । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সবাই তারা ভারতীয়। ভারতীয় ঐক্যমন্ত্রে তারা দীক্ষিত। দেশের জন্য সবাই নিবেদিত প্রাণ। মূলত দুটি সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে দেশ ভাগ হলেও ভারত কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাস করেনি। সুতরাং সহমর্মিতায় সহানুভূতিতে হিন্দু-মুসলিম দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। কোনোকিছুই তাদের অন্তরায় হয়ে ওঠেনি।
বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই সুসম্পর্ক ও ঐতিহ্যকে ভেঙে দেবার যে হীন কৌশল অবলম্বন করেছেন তা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে সংখ্যালঘুদের শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করে তুলতে সব রকম চেষ্টা এমনকী সংবিধান ও আইন প্রয়োগেও পিছপা হচ্ছেন না। সাংবিধানিক উচ্চপদে অবস্থান করে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রতিনিয়ত বিষোদ্গার করা তাঁদের নিত্যনৈমিত্তিক একটি প্ররোচনামূলক কাজ হয়ে উঠেছে। উস্কানিমূলক বিবৃতি এবং একদল উগ্র সাম্প্রদায়িক সেনাদল সৃষ্টি করে গোরক্ষার নামে, চোর অপবাদ দিয়ে, দেশদ্রোহী অপবাদ দিয়ে মব-লিঞ্চিংএর মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থান ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া এমনকী তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েও দোষারোপ করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। এঁরা জননেতা ও জননেত্রী হয়ে যে হীনন্মন্যতার পরিচয়ে সংবিধান উল্লঙ্ঘন করে চলেছেন এবং আইনের শাসনকে পাত্তা না দিয়ে সারাদেশে আতঙ্ক ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করছেন তাতে স্বাধীনতা রক্ষার লেশমাত্র পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। “কোরান ছাড়ো না-হলে ভারত ছাড়ো ।” “ঘর ঘর হাম ফাগুয়া ঝন্ডা ল্যাহারেঙ্গে ।” “মসজিদমে মসজিদমে রামকা পূজন হোগা ।” “মুসলমানকো পাকিস্তান ভেজ দো।” ইত্যাদি শ্লোগানগুলি আজ মুখে মুখে ঘুরছে।
মুসলিম সম্প্রদায় টুপি পরলে, ঢিলেঢালা জামা পরলে, গোড়ালির উপরে কাপড় পরলে এবং দাড়ি রাখলে নেমে আসছে তার উপর অত্যাচার। জোর করে তাকে “জয় শ্রীরাম” বলানো এবং হত্যা করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। “জো না ক্যাহে জয় শ্রীরাম
উসকো ভেজ দো কবরস্থান ।”
বলে গানও রচিত হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম প্রেমের বিবাহকে “লাভ জেহাদ” নাম দিয়ে এবং হিন্দু এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের গৃহ নির্মাণে “ল্যান্ড জেহাদ” নাম দিয়ে দুই ক্ষেত্রেই লাঞ্ছনা ও খুনের ঘটনাও বিরল নয়। এন আর সি বা নাগরিক পঞ্জীকরণ নীতি নির্ধারণ করে ইচ্ছেমতো সন্দেহভাজন নাগরিক তৈরি করে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো এবং আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারটাও খুব সহজ করে নিয়েছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। ফলে ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস শুধু পতাকা তুলে, কুচকাওয়াজ প্রদর্শনে, ভাষণে ও স্যালুটে প্রদর্শিত হয়। যে মানবিক উচ্ছ্বাসে জাতি জাতীয়তাবোধে স্নাত ও বিস্তৃত হতে চায়, যে প্রত্যয় ও ঐক্যমন্ত্রে একাত্ম বোধ করে সে আদর্শ কি কোথাও আছে?
তিন তালাকের মতো অমানবিক বিল পাশ করে একজন স্বৈরিণী অথবা ব্যাভিচারিণী নারীর স্বামীকেও ক্রাইম করার মতো জেল-খাটার সাজা ভোগ করতে হবে। তেমনি সরকার ইচ্ছে করলে যে কোনও ব্যক্তিকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন বন্দি রাখতে পারবে। যাকে যখন ইচ্ছা দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া যাবে। এ সবই যে স্বাধীনতার পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয় তা আমরা সবাই জানি। প্রকাশ্য ধর্মাচরণ করা, গো-মাংস খাওয়া ও বহন করা এবং কিছু কিছু বিদ্যালয়ে হিন্দু – মুসলিম আলাদা আলাদাভাবে ক্লাস করা ও মিড ডে মিল খাওয়ার ব্যবস্থা করা প্রকৃত স্বাধীনতায় কখনো কাম্য ছিল না।
বর্তমানের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন পদ্ধতিতেও মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে। সর্বক্ষেত্রেই স্বচ্ছতার বদলে এক ধোঁয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে। একপক্ষের বিপুল জয়জয়াকার, বিরোধীশূন্য গণতন্ত্র এবং মৃত্যুমিছিল ও দল বদলের হিড়িক গণতন্ত্রের প্রকৃত মর্যাদা পদে পদে ক্ষুণ্ণ করছে। দেশে যেমন আইনের শাসন নেই, তেমনি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও চূড়ান্তভাবে দেখা দিয়েছে। পরকীয়া ও সমকামীকে আদালতের সমর্থন পরোক্ষে যৌনস্বাধীনতাকেই আশকারা দেওয়ার সামিল। সমাজে এর কুপ্রভাব যেমন আছে, তেমনি পারিবারিক জীবনও বিষময় হয়ে উঠতে পারে। স্বাধীনতা ভোগ করতে গেলে যে কিছু কর্তব্য আছে, অন্যের ক্ষতি না করা ব্যাপারটায় তেমন কেহই সচেতন নয়। সুতরাং সুস্বাধীনতা নয়, কুস্বাধীনতাই আমরা বেশি ভোগ করতে এগিয়ে চলেছি। স্বাধীনতা যেমন মানুষের অর্থনীতিতে, তেমনি শিক্ষাতেও। ক্ষুধা-দারিদ্র, বেকারত্ব দূর করার নব নব পন্থায়। মানুষকে বিভাজনে নয়, ভালবাসায়। বিশ্বাস ফিরিয়ে আনায়। নিরাপত্তা প্রদানে। কিন্তু তা হচ্ছে কই? আমরা দেখছি :একদিকে মানুষ মারার স্বাধীনতা, অন্যদিকে সংসার ও পরিবারকে ভাঙার স্বাধীনতা। আজ আমাদের চোখের জল ফেলেই উপভোগ করতে হয় এই ১৫ অগাস্ট। প্রকৃত অর্থে মানবিক স্বাধীনতার অপেক্ষা করতে হয়।