Artical

বিষবাষ্পে জর্জরিত ভারত-দায়িত্ব কি শুধু সংখ্যালঘুর?

421views

মাহ্ফুজা তারান্নুম

ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের নিয়তি তাদের মাতৃভূমির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।এই সম্প্রদায়ের এক উদ্দীপনাময় আকাঙ্খা হচ্ছে সংখ্যাসূচক প্রধান হিন্দুসহসঙ্গী নাগরিকদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতায় বসবাস করা।উল্লেখ্য, হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে গণতান্ত্রিক প্রথার অধীনে দেশের ভাগ্য তাদের হাতের মুঠোয় দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। মুসলিমরা বৈধভাবে এদেশে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাসের ইচ্ছা পোষণ করে থাকে এবং তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে দেশের বিভিন্ন বিষয়ে ন্যায্য অংশগ্রহণের সুযোগ প্রার্থী।

ভুলে গেলে হবে না যে,সংখ্যাসূচক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ  এই সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে স্বাধীনতার পর প্রচন্ড দুঃখজনক বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে।সাংবিধানিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সত্ত্বেও দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকে মুসলমানদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার মতো হতাশাজনক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে!

তথাপি তারা পরিস্থিতির উন্নয়নে আপ্রাণ প্রয়াস চালাতে থাকে যাতে করে শান্তি,সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করে দেশের অগ্রগতি ও বিকাশে কার্যকর অবদান রাখতে পারে। আর্থিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে  ধারাবাহিক ভাবে ক্রমাবনতি এই সম্প্রদায়কে কোনঠাসা করে রাখে প্রতিমুহূর্ত!

 

অথচ, আমরা যদি প্রাক্ ঔপনিবেশিক ভারত দেখি,সেখানে বরাবরই আমরা সম্প্রীতি  খুঁজে পায়।ভারতীয় হিন্দু রাজাদের অসাম্প্রদায়িকতা ও  ইসলামপ্রীতির অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। বলহারা,আসীফান, মালাবারের রাজাদের কীর্তিকলাপ তারই উজ্জ্বল নিদর্শন। আবার যদি ভারতে মুসলিম  সুলতানদের সম্প্রীতি  খুঁজি তবে মাহমুদ গযনবী থেকে শুরু করে আলাউদ্দিন খলজী পেরিয়ে মোগল যুগে বাবর, আওরঙ্গজেব,  টীপু সুলতানের  ইতিহাস আমাদের এক সুস্থ সম্প্রীতির সমাজ উপহার দেয়।এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,ইতিহাসবিদ  কে. এম. পানিকর, এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির ভূতপূর্ব অধ্যাপক ডঃ বেনীপ্রসাদ, প্র‍য়াত রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রফেসর বি. এন. পান্ডে প্রমুখ ব্যাক্তির মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনের মূল্যায়নে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা ইতিহাস  লিখনের  নীতিমালা ও মৌলিক সত্য অস্বীকার  করে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। স্যার উইলিয়াম রবার্টসন,চালর্স গ্র্যান্ট,জি. আর. গ্লেগ,জেমস মিলস,থমাস মরিস,আলফ্রেড লিয়ল,উইলসন প্রমুখ ব্যক্তিরা বুদ্ধিজীবী মঞ্চ থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিরামহীন কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত ছিলেন।এদেশের বিপুল সংখ্যক মুসলমান যে এদেশীয় মানুষ  সে সত্য ভুলে গিয়ে তাঁরা মুসলমানদের এদেশে বিদেশি বলে উল্লেখ্য করে হিন্দুদের দেশীয় বলে চিত্রিত করেন।তাঁদের সাম্রাজ্য রক্ষা ও শক্তিশালী করার গভীর ও স্থায়ী স্বার্থে ইতিহাস লিখনে তাঁরা সব নীতিমালা বিসর্জন দিয়ে  নির্লজ্জভাবে জঘন্যতম বিদ্বেষমূলক, মিথ্যাচারিতা ও জালিয়াতিকে প্রশয় দিয়েছেন , যা অনেকটা যুদ্ধকালীন সময়ে উদ্দেশ্য সাধনে প্রচারণা চালানোর সামিল।এসব ডিঙিয়ে তবুও শান্তি ছিল,১৮৫৭  সালের সিপাহী বিদ্রোহ তারই প্রমাণ। থমাস লো ১৮৬০ সালে প্রকাশিত  তার লেখা ‘সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ডিউরিং দি রেবেলিয়ন অব ১৮৫৭-১৮৫৮’  গ্রন্থে  ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যারপরনাই সকল ভারতীয়দের গালমন্দ করেছেন।কিন্তু যে ব্যাপারটা ভারতীয় মুসলমানদের নিরুৎসাহিত করে তা হচ্ছে, সেইসব চরদের প্রয়াস যারা ভারতের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী (!) ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বকে ঔপনিবেশিক শাসনকে বৈধ শাসন বলে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছিল এবং তা ফলপ্রসূও হয়েছিল।বর্তমান ভারতের সেই বিশেষ শ্রেণীর পণ্ডিতগণ(?) স্বাধীনতা প্রাক্ কালে নিজেদের অবস্থান বেমালুম ভুলে গিয়ে এখন অন্যদের থেকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের থেকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট যাচাই করতে তৎপর!

 

স্বাধীনতার ৭২ বছর পেরিয়ে এসেও আজ ভারতীয় সংখ্যালঘুরা পরাধীন!যে বিষবৃক্ষ রোপন করেছিল ব্রিটিশরা তা আজ ফুলেফেঁপে উঠেছে,তাদের ছেড়ে যাওয়া চরদের দ্বারা। এই হিংসা কেবল মুখে মুখে নয়,এ হিংসা স্বাধীনতা প্রাক্ কাল যাবত ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছিল,যা আজ প্রকট হয়েছে আমাদের শিক্ষা,সাহিত্য, বিজ্ঞান,রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই শিক্ষাই যদি বিষাক্ত হয়?ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার হালও তাই,যার কুফল জীবনের অন্যান্য বিভাগেও ছড়িয়ে পড়েছে।

 

ধর্মীয় সম্প্রদায় যখন নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে রক্ষা করার জন্য সংগঠিত হয়ে রাজনীতি অনুশীলন করে তখন তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে।ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা যখন এই সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায় তখন তাকে শুধু সাম্প্রদায়িকতা বললে তার অভিপ্রায়, কর্মসূচী ও কাজকর্মকে সঠিক ভাবে বোঝানো যাবে না,তাকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বললেই যথার্থ হয়।কারণ, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য হল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা অধিকার করা।রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্য ধর্মকে  শর্ত করে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহারকে ইংরেজি ভাষায় ফান্ডামেন্টালিজম বলার প্রথা চলে আসছে প্রায় দেড়শো বছর ধরে, আর ধর্মকে  মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার প্রথাও সেকিউলারিজম বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে প্রায় দেড়শ বছর ধরে।

ভারতের সংবিধানের ১৯৭৬ সালে ৪২তম  সংশোধনে ভারত চিহ্নিত হয়েছে একটি সেকিউলার দেশ হিসাবে।কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগে ভারতে কেউ কখনো, এমনকি মহাত্মা গান্ধীও কোথাও সেকিউলার শব্দটা  ব্যবহার করেছেন কিনা তেমন কোনো তথ্য নেই।সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে শান্তিতে বসবাস করবে এবং দেশের ঐতিহ্য ও মাটিতে, স্মৃতি সম্পদে ও নির্সগ সম্পদে সমস্ত ধর্মালম্বীদের সমান অধিকার থাকবে এমন আদর্শকে গান্ধী-নেহেরু উচ্চারণ করলেও তাকে সেকুউলারিজম নামে উল্লেখ্য করার প্রয়োজনীয়তা সংবিধান প্রণেতাগণও উপলব্ধি করেননি। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫১ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে ১৯৬২ সালে জব্বলপুরের দাঙ্গা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ছিল।কিন্তু ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু ও তার কয়েক মাস পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠা ক্রমশ ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশকে ঘোলাটে করেছে,যা আজও বিদ্যমান!

ভারত আজ ফান্ডামেন্টালিজমে আক্রান্ত। এ রোগ হঠাৎই  ছেয়ে যায়নি,বরং এরোগ আগে থেকেই ছিল,বর্তমান সরকার শুধু আগুনে ঘি ঢেলেছে।

 

আমাদের সাহিত্য গুলোতে প্রথম সাম্প্রদায়িক বিষ এনেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কবির লেখনীতে মুসলমানরা হয় ‘যবন’, নয় ‘ নেড়ে’।হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রচার করেছিলেন তা ‘ উদার মধ্যপন্থী ‘ সাংবাদিকের পরিচয় নয়।

এই বিষবাষ্প ক্রমশ ঘনীভূত হতে লাগলো দ্বিজেন্দ্রলাল,  বঙ্কিমচন্দ্র, কৃষ্ণকমল, শরৎচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে।

উত্তরপ্রদেশ,বিহার,ঝাড়খণ্ড, গুজরাট,রাজস্থান ছাড়িয়ে বাংলার আকাশেও ব্রাহ্মণ্যবাদের চোখরাঙানি!

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রথম আওয়াজ উঠেছিল বাংলা থেকে,যাতে মুসলিমরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।কিন্তু আজও বাংলার মুসলমানদের ‘বাঙালি’ লেবেল দিতে কেমন যেন কন্ঠ শুকিয়ে যায়!

হাওড়ার উলুবেড়িয়ার ঘটনা, ডাঃ মুর্তজা বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে অপমানিত হলেন কেবল মাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য!

মুর্শিদাবাদের মাদ্রাসা ছাত্র রাজিবুলকে জয় শ্রীরামের নামে প্রহার,শিক্ষক শাহরুককে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া…হিংসা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

বিরোধিরা রাজ্য সরকারকে ‘মমতাজ’ বলে যতই তোষনের টিকিট দিকনা কেন,একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আপনার জেনে রাখা উচিৎ গত ১৩ বছরে রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের  উন্নতির মান অনেক  কমেছে।মোট ২৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট লেকচারার মিলিয়ে মাত্র ৩৭৩ জন অধ্যাপক রয়েছেন।সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ সালে মুসলমানদের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে  অবস্থান ছিল মাত্র ২%,যা এখন আরও কমে ১.১% হয়েছে।তাজ্জবের বিষয় হল,অন্যান্য সংখ্যালঘু উপজাতির জন্য এবিষয়ে মনিটরিং সেল থাকলেও মুসলমানদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই!এই একটা রিপোর্টই যথেষ্ট রাজ্যে মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য।

 

মোট কথা, রাজ্য-দেশ জুড়ে মুসলমানদের অবস্থা খুবই করুণ! জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানরা চাইলেও এই অন্যায় জুলুমকে প্রতিরোধ করতে পারবে না।তাই আম্বেদকরের ভারত গড়তে, শান্তি সাম্যের ভারত গড়তে সমস্ত সংখ্যালঘুদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।এটা মাথায় রাখতে হবে যে,দেশে শুধু মুসলমান নয়,ব্রাহ্মণ্যবাদ শক্তির শিকার দলিত আদিবাসীরাও।

পরিশেষে উদার মধ্যপন্থী হিন্দু ভাইদের বলতে হয়,আপনি যদি সত্যিই ভারতীয় হোন,আপনি যদি শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ হোন,যদি শান্তির সাম্যের ভারত গড়তে চান তবে অবশ্যই এই অন্যায় প্রতিরোধ করতে আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে।

আর তা যদি না হয়,তবে কেউ একজন সত্যিই বলেছেন – ” অসহিষ্ণুতা আর ঘৃঘৃণার দৌলতে আমার দেশ,শহর ভেঙে চুরমার হচ্ছে,আমি অসহায় বাঙালি প্রাণ বাঁচিয়ে দেখে চলেছি!”

 

 

 

Leave a Response