History

দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী-জিন্না বার্তালাপ, ৪য় পর্ব

556views

মইনুল হাসান

তারপর

গান্ধীকে জিন্না

১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪

প্রিয় মিস্টার গান্ধী,

৯ই সেপ্টেম্বরের আলোচনামত আমার যা মনে হয়েছে তা হলো আপনি হিন্দু-মুসলমান মীমাংসা প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে যে আলোচনায় বসতে চান তা কংগ্রেস, হিন্দু অথবা অন্য কারুর প্রতিনিধি হিসাবে নয়, একজন ব্যক্তি হিসেবেই। তাই আমার প্রশ্ন – এ আলোচনায় আমার বিপরিতে যিনি থাকবেন তার বৈধ প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থান যদি থাকে শুধু তাহলেই হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে কোন মীমাংসাসূত্র পাওয়া গেলে তাকে বৈধরূপ দেওয়া সহজ হবে। কিন্তু আপনি যে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন তাতে আমার পক্ষে বিষয়টি খুবই অসুবিধাজনক হয়ে দাড়িয়েছে এবং বলা বাহুল্য একরকমভাবে আলোচনায় অংশ নেওয়ার কোন পূর্ব নজীরও আমি দেখতে পাচ্ছি না।

আপনি এটা ভাল করেই জানেন যে আমি কেবলমাত্র ভারতীয় মুসলিমদেরর পক্ষ হয়ে অথবা সারা ভার মুসলিম লিগের সভাপতি হিসাবেই কথা বলতে পারি। আমি আমার সংগঠনের সংবিধান এবং নিয়মাবলী মানতে বাধ্য। আশাকরি আপনি এটা বুঝতে পারবেন যে হিন্দু মুসলমান প্রশ্নটি এখন খুবই জটিল এক বিষয় এবং দু’জাতির (Two nations) প্রতিনিধিদের একসঙ্গে বসে আলোচনা ব্যতিরেকে কোন মীমাংসা ফলপ্রসু হবে না।

বলা বাহুল্য ১৯৪০, মার্চের লাহোর প্রস্তাব’ আমি আপনার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং এই প্রস্তাবের মূল ভিত্তি এবং নীতিগুলি আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আপনি শুধু যে এই প্রস্তাবের সারবত্তার বিরোধিতা করেছেন তাই নয়, উপরন্তু মন্তব্য করে বলেছেন যে আমাদের দুজনের মধ্যে যেন সমুদ্রের ব্যবধান। (an ocean between you and me) এর উত্ত্রে আমার  মন্তব্য ছিল – তাহলে বিকল্প প্রস্তাব আপনি আমার কাছে রাখুন। আপনি রাখলেন মিঃ রাজাগোপালাচারির সূত্রটি (Rajaji formula)  আমরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আলোচনা করছি। এর মধ্যে অনেক কিছুই আমাদের ভাসাভাসা এবং অবাস্তব বলে মনে হয়েছে, কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের মনে হয়েছে আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। আমি এ ব্যাপারে একটা পরিষ্কার ধারণা পেতে চাই। আমি জানতে চাই। আমি জানতে চাই এর প্রয়োগ কিভাবে সম্ভব।

আলোচনার পরেই আপনার অনুরোধ ছিল আমার জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো যেন আমি লিখিতভাবে আপনার কাছে জানাই। এবং তা যেন অবশ্যই আমাদের পরবর্তী সাক্ষাতের দিন অর্থাৎ আগামী সোমবার ১১ই সেপ্টেম্বরের আগে হওয়া চাই। তাই আমি রাজাজী সূত্র সম্পর্কে আমার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলি এক এক করে রাখছি।

প্রস্তাবনা –

১)  প্রস্তাবনা সম্পর্কিত – যদি আমার এবং আপনার মধ্যে কোন চুক্তি সত্যি সত্যি স্বাক্ষরিত হয় তাহলে আপনার প্রতিনিধিত্বের বৈধ রূপ কি হবে?

২)  অনুচ্ছেদ ১ : ‘স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান সম্পর্কিত যা এই অনুচ্ছেদে আছে সে ব্যাপারে আমার জানার বিষয় হলো – কোন সংবিধানের বিষয়ে আপনি কথা বলছেন। কে এটা তৈরি করবে আর কবে এটা কার্যকরী হবে?

পরবর্তী বিষয় হলো রাজাজী সূত্রে উল্লিখিত “মুসলিম লিগ ভারতের স্বাধীনতার জন্য দাবী জানাচ্ছে” বলার অর্থ কি কংগ্রেসের এই সম্পর্কিত দাবী যা ১৯৪২ সালের অগাষ্ট প্রস্তাবে আগে উল্লেখ করা হয়েছে আর তা যদি না হয় তাহলে একথা বলার তাৎপর্য কি বিশেষ করে এটা আপনি ভালমতই জানেন যে মুসলিম লিগ পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে তার প্রস্তাব মারফত যে তারা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা চায় যা প্রযোজ্য হবে পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা মধ্য দিয়ে।

তারপর এতে বলা হয়েছে যে “মুসলিম লিগ অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করবে”। আমি জানতে চাই এটা কিসের ভিত্তিতে হবে? এ ব্যাপারে যদি আপনার নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব থাকে তাহলে তা আমাকে জানালে ভাল হয়।

৩) অনুচ্ছেদ ২ : এই অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কমিশনকে নিয়োগ করবে কে? এবং অনুসন্ধানের ফলকে কার্যকরী করবেই বা কে? “নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা” বলতে কি বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। গনভোটার যে প্রসঙ্গ এখানে তোলা হয়েছে তা কি জেলা-ভিত্তিক হবে আর তা যদি না হয় তাহলে কি হবে তার ভিত্তি? এই গণভোট প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে হবে, না অন্য কোন প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে আর তা ঠিক করবেই বা কে? এই গণভোট যে রায় দেবে তাকে কার্যকরী করবেই বা কে? শুধুমাত্র সীমান্তের জেলাগুলির ক্ষেত্রেই কি এই ধরণের রায় নেওয়া হবে (To choose to join either state) অথবা সীমান্ত থেকে যে অঞ্চলগুলি খুব প্রত্যন্ত সেখানেও এই ব্যবস্থা কার্যকরী হবে।

৪)  সব দল (All parties) যা এই অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বলতে কি বোঝায়?

৫)  অনুচ্ছে ৪ : পারস্পরিক চুক্তি (mutual agreement) কাদের মাধ্যমে এবং কিভাবে রূপায়িত হবে? প্রতিরক্ষা বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত বলতে কি বোঝাতে চাইছেন আপনি? বিরুদ্ধবাধী তাহলে কারা?

৬) অনুচ্ছেদ ৬ : এই শর্তগুলি নিয়ে ভাবা যেতে পারে তখনই যখন বৃটেন ভারতের সরকার চালাবার ক্ষমতা পুরোপুরি হস্তান্তর করে দিতে রাজি হবে। তারপরেও প্রশ্ন আছে। ক্ষমতা হস্তান্তর কাকে করা হবে এবং কিসের মাধ্যমে?

এই মুহুর্তে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমি যথেষ্ট ছিলাম যার উত্তর এবং বিস্তৃত ব্যাখ্যার আমি প্রত্যাশী। আমি মনে করি আমার মনে উঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি দেবেন এবং এতে ব্যাপারটাকে একটা ফয়সালার জায়গা নিয়ে যাওয়া সহজ হবে।

আপনার একান্ত

এম. এ. জিন্না

চলবে…

Leave a Response