দিল্লি দাঙ্গার মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কেন্দ্র সরকার বেছে নিতে চাচ্ছে পছন্দসই আইনজীবীদের৷ গুজরাত দাঙ্গার বিচারকার্যের সময়েও এটা ঘটেছিল৷ ভিএইচপি ও আরএসএসের সদস্য-সমর্থক আইনজীবীরা পাবলিক প্রসিকিউটর হয়ে ন্যায়বিচারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন৷ দিল্লির ক্ষেত্রেও কি ঘটবে একই ঘটনা? লিখছেন আশিস খেতান
ফেব্রুয়ারিতে ঘটা নৃশংস দিল্লি দাঙ্গা ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী প্রতিবাদ নিয়ে মামলাগুলিতে কেন্দ্র সরকার পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিজেদের পছন্দসই আইনজীবী নিয়োগ করতে উৎসুক৷ ব্যাপারটি খুবই কৌতূহল উদ্দীপক৷ কেন্দ্র কি নিরপেক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবে? এটা আশা করা যায় না৷ কারণ, নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন পাবলিক প্রসিকিউটরদের অপব্যবহার করেছিলেন দাঙ্গার মামলাগুলিতে ন্যায়বিচার চাপা দেবার জন্য৷ ২০০৭ সালে গুজরাত দাঙ্গার সুরতহাল করতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম৷ আমি গোপনে দাঙ্গাকারীদের বয়ান রেকর্ড করেছিলাম৷ তারা স্বীকার করেছিল, কীভাবে ওরা মানুষকে খুন করে, পিটায়, পুড়িয়ে দেয়৷ তারা আরও স্বীকার করে যে, আমরা এত বিপুল সংখ্যক মানুষ মারতে পেরেছি শুধুমাত্র পুলিশের সাহায্যেই৷ এই ৬০ ঘণ্টার স্টিং টেপটিকে সিবিআই যাচাই করে ও ট্রায়াল কোর্টে পেশ করে৷ নারোদা পাটিয়া কেসে আদালত এটিকে ‘নির্ভরযোগ্য’ প্রমাণ হিসেবে মেনে নেয়৷ কিন্তু বিশেষ তদন্তকারী দল সিট এটাকে মেনে নেয়নি৷ গুজরাতের তৎকালীন মোদি সরকারের নিযুক্ত সরকারি আইনজীবীরা আরও বিস্তারিত ছকের কথা বলে মামলাগুলিকে দুর্বল করে দেয়৷ এরা কেউ ছিল সংঘ পরিবারের সদস্য, কেউ বা সমর্থক৷ তিনজন শীর্ষ প্রসিকিউটর অরবিন্দ পান্ডে, দিলীপ ত্রিবেদী, ভারত ভাট– এদের মধ্যে অন্যতম৷ তারা এসবের স্বীকারও করেছেন টেপে৷ দিলীপ ত্রিবেদী সেই সময় গুজরাত ভিএইচপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ তার স্বীকারোক্তি ছিল, রাজ্য পুলিশের বহু দল, ডিফেন্স দাঙ্গাবাজদের নিরাপত্তা দিতে একসঙ্গে কাজ করে৷ সেই স্টিং অপারেশনে তিনি সমস্ত গোপন ছক স্বীকার করেন৷ আমি (আশিস খেতান) তাকে জিজ্ঞাসা করি মেহসানাতে কতগুলো কেস নিবন্ধন হয়েছে? ত্রিবেদী উত্তর দেন, ১৮২ টি অভিযোগ জম পড়েছিল৷ এর মধ্যে ৮০ টির চার্জশিট তৈরি করা হয়৷ এর মধ্যে তিন-চারটি কেস পেন্ডিং৷ বাকি ৭৬টি মামলা শেষ৷
খেতান: এর সবগুলিই কি হিন্দুদের পক্ষে?
ত্রিবেদী: মাত্র দুটি কেসে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে৷ বাকি ৭৪টি মামলায় সমস্ত অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পায়৷ অপরাধ প্রমাণিত হবার পরেও আমরা আবেদন করে একজনকে ছাড়িয়ে নিয়েছি৷ দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে আমরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হই৷ অভিযুক্ত জামিন পেয়ে গিয়েছেন৷ ৩০০০-এর বেশি হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয়েছিল৷ মাত্র ১০০-১৫০ জন জামিন পায়নি৷
এরপর কথায় কথায় বিজাপুরের প্রসঙ্গ আসলে ত্রিবেদী বলেন, বিজাপুরে সরদারপুর নামে একটি গ্রাম আছে৷ সেখানে মুসলিমদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ ১৪ জন অভিযুক্ত হয়৷ এটি বড় মামলা ছিল৷ সুপ্রিম কোর্ট এটিতে স্টে অর্ডার দেয়৷ আমি এখন আর এটা নিয়ে উদবিগ্ন নই, কারণ এই মামলার সমস্ত অভিযুক্ত জামিন পেয়ে গেছে৷ ত্রিবেদী নিজেই মামলা লড়ত শুধু তাই নয়৷ দাঙ্গাকারীদের আইনজীবী খুঁজে দিতেও তিনি সাহায্য করতেন৷ তার চেম্বারে বসে থাকার সময়েই বেশ কয়েকজন এ ব্যাপারে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল৷ সাবারকাথা জেলার দুই আরএসএস সদস্য নরেন্দ্র প্যাটেল ও মোহন প্যাটেল আমাকে বলেছিল, গুজরাত দাঙ্গাকারীদের আইনি সহায়তা দেবার জন্য দাঙ্গার পরপরই সংকলন নামে একটি লিগ্যাল সেল গঠন করা হয়৷ ভিএইচপির আইনজীবীরা এ কাজে এগিয়ে আসে ও পাবলিক প্রসিকিউটর হয়ে যায়৷ আরাবল্লী জেলায় আমি পাবলিক প্রসিকিউটর ভারত ভাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি৷ তিনিও ভিএইচপির জেলা সভাপতি ছিলেন৷ ভাট জানান, মোট ১৪০০ টি মামলা ছিল৷ এর মধ্যে ৫৫০-৬০০ টি মামলা শুরুতেই বাতিল হয়ে যায়৷ পরবর্তীতে বাকিগুলো আবার সুপ্রিম কোর্টে খোলা হয়৷ এর ফলে অনেকে ভীত৷ এক ভিকটিমকে ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে কেস তুলে নিতেও তিনি বাধ্য করেছেন৷ অর্থ জোগাড় করার জন্য অভিযুক্তদের কাছেও তিনি হাত পেতেছেন৷ কাশ্মীর, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের ধনী হিন্দুদের উসকে টাকা আনেন এই আইনজীবী৷ ভাট স্বীকার করেছেন, আমি বলতাম, নিজের সম্প্রদায়ের কল্যাণের কাজেই যদি টাকাপয়সা খরচ করতে না পারেন তবে লাভ কী৷ কেউ ৫০০০, কেউ ১০০০০, কেউ এক লক্ষ টাকাও দিয়ে দিত৷ এভাবে ৫-৭ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন ভাট যেগুলো দিনের আলোয় ঘটা খুনের মামলাগুলো সেটল করতে ব্যবহার করা হয়৷ এই টাকা দিয়ে তিনি তরবারিও কেনেন মানুষকে টুকরো টুকরো করার জন্য৷
নানাবতী-শাহ কমিশনে গুজরাত সরকারের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন অরবিন্দ পান্ডে৷ তিনি আমার কাছে স্বীকার করেন, কমিশনের কাজকারবারেও নাক গলিয়ে দাঙ্গাবাজদের নিরাপদ করতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন৷ পান্ডে বলেন, গুজরাতে সেই সময় (২০০২) যদি অবিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকত, তবে এই মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালানো সম্ভব হত না৷ গোধরা কাণ্ডের পর মুখ্যমন্ত্রী মোদিও প্রচণ্ড চটে গিয়েছিলেন৷ মুসলিম হত্যার এই যজ্ঞকে প্রতি বছর ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করার কথা বলেন পান্ডে৷ ২০১০-এর ১৭ মে সিটের প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয় যে, গুজরাত দাঙ্গায় পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে ভিএইচপি ও আরএসএস সমর্থক-সদস্য এমন আইনজীবীদের সরকার নিয়োগ দেয়৷ এর সঙ্গে গভীর রাজনৈতিক যোগও রয়েছে বলে জানান সিটের চেয়ারম্যান আর কে রাঘবন৷ তবুও সিট মুখ্যমন্ত্রী মোদিসহ রাজ্যের বড় বড় পদাধিকারীদের দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ খারিজ করে দেয়৷ তারা বিশ্বাস করত, এদেরকে অভিযুক্ত প্রমাণ করার জন্য নাকি যথেষ্ট প্রমাণ নেই৷ এটাকেই ‘ক্লিনচিট’ বলে বিজেপি উদযাপন করে থাকে৷ দিল্লির দাঙ্গাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলেছে কেন্দ্র সরকার৷ এখানেও ক্ষমতায় সেই ব্যক্তি৷ গুজরাত দাঙ্গায় ইনসাফকে গলা টিপে মেরেছিল সরকারের পছন্দসই আইনজীবীরা৷ এখানেও কি এর পুনরাবৃত্তি হবে?
তরজমা-গোলাম রাশিদ