অনুবাদ গল্প
অনুবাদক-মুরসালিম শেখ
(গল্পের উৎস:-ডক্টর দয়ানন্দন ফ্রান্সিস চলতি সময়ের তামিল সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কলমযোদ্ধা।বর্তমান গল্পটি “গারীব কা খুন” শিরোনামে তামিল থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন ডক্টর পি.কে. বালসুব্রাহ্মন্যন।ডক্টর এ.ভবানী সম্পাদিত “তামিল কী লোকপ্রিয় কাহানিয়াঁ” গ্রন্থে এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।এই বঙ্গানুবাদটি সেখান থেকেই করা হল।)
—–“কী ব্যাপার?আজ ফিরতে এত দেরি হল কেন?মালিক রুদ্রজী কি কাজ করাতে করাতে তোমার কোমর ভেঙে দিয়েছেন?”
—–“কী হয়েছে?পাংশুটে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?তোমার শরীর কেমন আছে?সুস্থ আছো,না?যাহোক, ছাড়ো, একটু জল দাও।”
আলোহীন ঘরে দৌড়ে গেল মুনিয়া।কাল্লু দরজার চৌকাঠে বসল।দৃষ্টি তার আকাশের দিকে।সে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে চিন্তিত ছিল না।শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দুর করবার জন্য আকাশের গায়ে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রদের দিকে তাকাচ্ছিল।এটা মন্দ নয় যে, প্রকৃতির রসাস্বাদন করার জন্য গরিবদের ভাগ্যে এরকম সুন্দর অবসর জোটে।
বলা হয়ে থাকে, আকাশ এমন এক উপলব্ধির জিনিস, যেন হীরেখচিত এক নীলপাত্র।তবে যাদের কপালে দু-বেলা ভরপেট খাবার জোটে না,তাদের মনে এ কবিত্ব আসে না!লেখক এরকম দৃশ্যের যথেচ্ছা বর্ননা করতে পারেন।তাঁর প্রকাশ নৈপুণ্যে নির্বাধে তিনি লিখতে পারেন,”সেই সময় আমি জেলা প্রশাসক ছিলাম।তখন ছিল দুপুর বেলা।আমি নিশ্চিন্ত অবসর যাপনের আশায় সোফায় আরাম করে বসে পানামা সিগারেট টানছিলাম,ইত্যাদি ইত্যাদি।”
আমি এমন লেখক দলের অন্তর্ভুক্ত নই, যিনি তাঁর লেখায় সোনা-চাঁদির বর্ননা করে মেধার মিথ্যে বাহাদুরি জাহির করেন।
অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে চাঁদ মেঘেদের আড়ালে নিজেকে আড়াল করছিল।এই দৃশ্য দেখে কাল্লুর মনে হচ্ছিল যেন তার মালিক প্রতিবাদমুখর শ্রমিক দলের থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সকলের দৃষ্টি বাঁচিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন!
সে টেরটিও পেল না যে, তার ছোট্ট ছেলেটি তার জামার পকেট হাতড়াচ্ছে।একদৃষ্টে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আশপাশের প্রতি তার কোনো খেয়ালই ছিল না, এতটাই ভাবমগ্ন সে!
—–“কিগো?মুন্নার হাতে পঞ্চাশ টাকার নোটটি দিয়েছো কেন?ও কাগজ ভেবে টাকাটা ছিঁড়ে ফেলবে না?এই নোটটি কি মালিক দিয়েছেন?
—–“কেন দেবেন না?যদি তাকে আমি একশো টাকা ধার দিতাম তাহলে হয়তো তিনি আমাকে আজ পঞ্চাশ টাকা ফিরিয়ে দিতেন।কত দয়ালু তিনি,তুমি জানো না!” তার কথায় ঘৃণা ঝরে পড়ল।
—–“তাহলে এটা কিভাবে পেলে?”
—–“মানে?যাও তো তুমি, মুদির দোকান থেকে আদা কিনে আনো।আমার শিরা-উপশিরা যেন জ্বলে যাচ্ছে!আদা দিয়ে চা বানিয়ে দাও।”
মুনিয়া দোকান বেরুলো।বাচ্চাটিও তার সঙ্গ নিলো।মুনিয়ার মনে শুধু একটি জিজ্ঞাসাই ঘুরপাক খাচ্ছিল,”মুন্নার বাপ এই টাকা পেল কোত্থেকে?চুরিদারি করেনি তো?” ভেবে ভেবে তার মন অস্থির হয়ে উঠছিল।
কাল্লু না করেছিল চুরি,না মেরেছিল পকেট।গরিবদের পেটে তার মালিকের মতো লাথি মেরে প্রকাশ্য দিবালোকে কাউকে সে নিঃস্ব করে নিংড়ে নিতো না।বড় সততার সঙ্গে, সত্যপরায়ণতার সঙ্গে পঞ্চাশটি টাকা সে কামাই করে এনেছে।মালিকের জবানের সে কী মূল্য!যদি মুখ থেকে “না” শব্দটি একবার বেরিয়ে যায়, তাহলে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি আর “হ্যাঁ” বলবেন না!দোকানের মালের দামের ব্যাপারেই শুধু নয়,তার অধীনে কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গেও নির্মম আচরণ করতেন তিনি।
কাল্লু বিগত দশ বছর যাবৎ মহেশ রুদ্রজীর দোকানে কাজ করে।এই দশ বছরে মালিকের মালিকানার ভারি উন্নতি হয়েছে।তাঁর ভুঁড়ির মেদবাহুল্যই তাঁর উন্নতির যথেষ্ট প্রমাণদায়ক।তাঁর ধনরাশি,জাঁকজমকপূর্ণ বাড়ি প্রভৃতি, সব কিছুই তাঁর পরিপূর্ণতার বার্তাই জানান দেয়।দশ বছর আগে তাঁর মধ্যে যে উদারতা ছিল,বর্তমানে তা নেই।ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
কাল্লু তাঁর পায়ে পড়ে অনুনয়-বিনয় করেছে।সে কোনো ভিক্ষা চায়নি।সে তাঁকে বলেছে,”আমার ছোট্ট ছেলেটি দু-দিন থেকে অভুক্ত!বেতনটা শুধু অগ্রিম দিয়ে দিন।সেটাও সপ্তাহ শেষে যত মজুরি হবে,তার সামান্য কিছু।”
কিন্তু দলিল-দস্তাবেজেও যাঁর মন ভরসা করতে পারে না, সেই তিনি নগণ্য এক নিঃস্ব মজুরের কথায় আস্থা রাখবেন কিভাবে!সুতরাং কাল্লুর রোদন অরণ্যেই করা হল!যদি মালিক জীবনে ভুল করে হলেও গরিবদের অশ্রু-ঘাম দেখে একটুও গলতেন তাহলে কি লাখপতি হতে পারতেন?
—–“শোন, ঠেলাভ্যানে করে তিরিশ বস্তা চাল নিয়ে গিয়ে আমাদের বড় হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আয়।” জ্যৈষ্ঠ মাসের চিনচিনে রৌদ্রে,তাও আবার দুপুর দুটো বাজে,সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস এবং ঠান্ডা পেপসি খেতে খেতে রুদ্রজী আদেশ দিলেন।
তাঁর মোটর গাড়ি তথা লরিটি মাঝে-মধ্যেই খারাপ হয়ে পড়ে থাকত।কিন্তু তাঁর দোকানের শ্রমিকরা কখনোই অজুহাত খুঁজত না বা অকেজোর আচরণ করত না।সর্বক্ষণ আদেশ পালনে তৎপর থাকত তারা।এটা খুব অত্যাবশ্যক ছিল না যে, শ্রমিকদের পেটে সব সময় খাবার বা শরীর-মন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতেই হবে।যদি এই মানবযন্ত্রগুলো কখনো বলে যে,সে অসুস্থ বা ক্ষুধিত তবে নির্দ্বিধায় শীঘ্রই সেই মানবযন্ত্রগুলোকে কর্মস্থল থেকে ফেলে দেওয়া হবে।সুতরাং…..
কাল্লুসহ চারজন মিলে সেই ভারবাহী ঠেলাগাড়িতে ত্রিশ বস্তা চাল চাপিয়ে পিঠ বাধিয়ে টানা শুরু করল।দুজন শ্রমিক সামনে থেকে টানছে এবং দুজন পিছন থেকে ঠেলা দিচ্ছে।এভাবেই তারা টেনে নিয়ে চলেছে ভারবাহী ঠেলাভ্যানটি।
“কাহাঁ হ্যায় সুখ নির্ধন কো?নির্ধন হো তো হ্যায় দুখময় সানসার…” অর্থাৎ ধনহীনের সুখ কোথায়?যদি ধনহীন হও তবে দুঃখময় সংসার!—–কী গান বাজছিল!বেচারা রেডিও কি জানে,সে কোন অসময়ে এই গান গাইছে?ঠিক এমনই সময় চলচ্চিত্রের মতো এক ভিখারি তাঁর সামনে উপস্থিত হল।বেচারা মালিক রেডিওটির কী করেন এখন?তিনি রেডিওটি বন্ধ করে দিলেন।যদি এই গান ভিখারিটিই গাইতো তাহলে দু-চার থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিতেন নিশ্চিত।কিন্তু রেডিওটাকে…
হাসপাতালে একটি বিজ্ঞাপন লাগানো ছিল,যার উপর কাল্লুর দৃষ্টি পড়ল।সে পড়তে পারত।তার মালিকের মতোই লেখাপড়া জানে সে।দেবি লক্ষ্মীর প্রসন্নতার দৃষ্টি দু-জনের উপর ভিন্ন-ভিন্ন।দুজনের মধ্যে জমিন-আশমানের প্রভেদ।কিন্তু সরস্বতীর দয়াদৃষ্টি দুজনের উপরেই সমান সমান।দুজনেই পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ।সে বিজ্ঞাপনটি পড়ল—–“ত্যাগী হও।রক্ত দাও।আমরা চাই রক্ত,তোমার চায় অর্থ।দেশহিতে রক্ত দাও,পঞ্চাশ টাকা জিতে নাও।”
কাল্লু বারবার সেটা পড়ল।সে হাসপাতাল থেকে ফিরবার সময় ঠেলা ভ্যানটিতে চেপে বসল।বাকি তিন বন্ধু তথা সহকর্মীরা সেটি ঠেলে নিয়ে এল।কাল্লু তার ভাবনারাশির মধ্যে নিমগ্ন ছিল সারাটা পথ।পঞ্চাশ টাকা,পঞ্চাশ টাকা,মনে মনে ভাবছিল আর হাসছিল সে।অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে।
সেই দিন সন্ধ্যা ছ’টার সময়েই ছুটি পেয়ে গেল কাল্লু।তার পদদ্বয় আপনাআপনি হাসপাতালের দিকে চলতে শুরু করল।এতদিন ধরে সে রক্ত-ঘাম অশ্রুর মতো ঝরিয়ে এসেছে।আজ স্বেচ্ছায় রক্ত নিঃশেষ করে দিল।পঞ্চাশ টাকার নোটটি পকেটে পুরলো।খুশিতে গদগদ হয়ে সে বাড়ি ফিরল।
দিন দশেক পর।মাঝ রাস্তায় মানুষের বিশাল এক জটলা।জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর বেলা চিনচিনে রোদ্দুরে কাল্লু বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল।ক্লান্তি আর ক্ষুধায় নাচার হয়ে সে মধ্য রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে!ঠিক তখনই অসুর বেগে ছুটে আসা একটি ট্রাক তাকে থেঁতলে দিয়ে চলে যায়!যেখানে সে ঘাম ঝরাত, সেখানেই আজ তার শরীরের সমস্ত রক্ত ঝরে পড়ে সমগ্র স্থানটি লাল হয়ে যায়!রক্ত,ধুলোমাটি আর থেঁতলানো হাড়-মাংসে জায়গাটি বীভৎসতায় রাঙা হয়ে ওঠে!
—–“হায় অসহায়!কত রক্ত ঝরে গেছে!” একজন হৃদয়বান পথচারী দুঃখ প্রকাশ করেন।ঘাম আর অশ্রুর মতো অভাগার রক্ত তো হাসপাতালেই ত্যাগের প্রতীক হয়ে বয়ে গিয়েছে!শেষ রক্তটুকুও ওখানে পড়ে রইল!তার করুণ অবস্থার কথা না জানতেন তার মালিক,না জানত অন্য কেউ…