
বিশেষ প্রতিবেদন: নারী সমাজকে নিয়ে আজ কেউবা ব্যস্ত অতিমাত্রায়,আবার কেউবা নারী সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কেউ তাদেরকে নির্দিষ্ট গন্ডি থেকে টেনে বাইরে আনতে চায়,কেউবা চায় তাদেরকে সম্পূর্ণ অবরোধ করতে।মুক্তি মানুষের সহজাত কাম্য।প্রত্যেক মানুষই চায় স্বাধীন সত্তা নিয়ে বাঁচতে।এই পথে বাধা হয়ে কেউ কাউকে ঠকিয়ে রাখতে পারবে না।কিন্তু নারীর সত্যিকার মুক্তি কোন পথে?
পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে বাইরের জগতে পুরুষের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলার মাধ্যমেই কি তার প্রকৃত মুক্তির পথ নিহিত?
অথবা, আর্থিক স্বাধীনতা লাভ করলেই কি সে পাবে সঠিক মুক্তি?
আসুন,ফিরে তাকাই।
আমি আমার আগের লেখা ” ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস সন্ধান”-এ নারী স্বাধীনতা আসলে কি তা ব্যাখ্যা করেছি।আবারো বলছি — বিপ্লবী ধ্যান ধারণার কেন্দ্রস্থল ফ্রান্স,সেখানে সাহিত্য ও কাব্যের রোমান্টিক লেখকগণ নারী সাম্যের আদর্শকে জনপ্রিয় করার এক সংগঠিত প্রয়াস চালায়।এবং এই আন্দোলনের নেতা-নেত্রীগণের ব্যক্তিচরিত্র খুবই জঘণ্য, অনুসরণের অযোগ্য।
যাইহোক, এই আন্দোলনের অন্যতম লেখক মিল,তিনি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তার ‘Subjection of Women ‘ গ্রন্থে বলেন,” নারী জাতির পরাধীনতা দীর্ঘ যুগব্যাপী প্রথার ফলশ্রুতি এবং এই পরাধীনতা নারীজাতির অন্তর্নিহিত কোনো দূর্বলতার জন্য নয়।”
একদম তাই,লেখক মিল যথার্থ বলেছেন।প্রাক্ ইসলামী কাল পর্যন্ত নারীরা যুগে যুগে অপমানিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত হয়ে এসেছে।এবং ফলিফাতন্ত্রের পতনের পর আমরা আবার সেই জাহেলিয়াত ঘটনার পুনঃ আবির্ভাব দেখতে পাই।
যেহেতু ততদিনে মুসলিম সমাজসহ অন্যান্য কোনো দলই মেয়েদের নিয়ে ভাবার সময় পায়নি,ঠিক তখনই ইউরোপে আঠারো শতকে পূর্বে উল্লেখিত নারী-দরদী (?) লেখক গুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মেয়েরাই সামিল হয় এই আন্দোলনে।এবং শুরু হয় ‘সাম্যবাদের ‘সূচনা লগ্ন।
রাশিয়ার কমিউনিষ্ট নেতা V.I.Lenin তার স্ত্রী ক্রাপসকায়ার দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত। এই দম্পতি বেশ ভালো করে জানতেন,নারীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া কমিউনিষ্ট আন্দোলন কখনোই সাফল্য লাভ করতে পারবে না।তাই নারী সমর্থনের আশায় কমিউনিষ্ট শাসনে নারীর অংশগ্রহণের ফরমান জারি হয়।
এখান থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে,নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, ক্ষমতা-পদের লোভে তথাকথিত নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুনে পেট্রোল দিয়েছিল।অথচ তারা নিজেরাও জানতো এই আন্দোলনের নেতা-নেত্রীগণ সবাই নারী সম্ভ্রম পিপাসী, নারীহন্তা।
বিপুল চাহিদা থাকায় আন্দোলন সফল হল।
নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের ফল স্বরূপ দেখতে পাবেন যুদ্ধেক্ষেত্রে নারীর আগমণ।১৯৪১খ্রিঃ আমেরিকা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করে তখন আমেরিকান নারীদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়েছিল।নৌবাহিনী ও সামরিক বিভাগের কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ নারী অফিসারদের দ্বারা শৃঙ্খলা রক্ষার ট্রেনিং দেওয়া হত।সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন সাজসজ্জা ও সম্মানে ভূষিত করা হত।
যুদ্ধের অবসান হলে আমেরিকান নর-নারী সাধারণত অসামরিক জীবন ফিরে পাওয়ার আশা পোষণ করতো।এর ফলে নিয়োগ বিতরণের ক্ষেত্রে,অর্থনৈতিক জগতে,সমাজে স্থানাধিকার ও পুরস্কার পাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম অধিকার প্রসঙ্গে গৃহীত সরকারি নীতি সমূহের উপর উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়।সমাধান করতে ১৯৪৪ খ্রীঃ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমর বিভাগ গোলটেবিল মঞ্চে সৈনিকদের শিক্ষার জন্য পুস্তিকা প্রকাশ করে,যার মধ্যে শানিত যুক্তির আহ্বান করে একটি প্রশ্নের অবতারণা করা হয়।প্রশ্নটি হল: ‘যুদ্ধ শেষে আপনি কি চান যে আপনার স্ত্রী অন্য কোথাও নিয়োগ পান?’
কিছু বুঝতে পারলেন??
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় আমরা বিষয়ের গভীরে না ঢুকে,পশ্চিমাদের ফেলা দেওয়া পচা নীতিকে আজও গিলছি।
যদি খেয়াল করেন,আজও পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নারীদেহ প্রদর্শন, অভ্যর্থনাকারিণী হিসাবে নারী, দেশী বিদেশী, সরকারি বেসরকারি অফিসারদের ব্যক্তিগত সহকারিণী হিসাবে নারী,হোটেল ব্যবসায়ীদের কবলে নারী,সিনেমা ব্যবসায়ীদের কবলে নারী ……. নানা ভাবে নারী আজ তথাকথিত স্বাধীনতার বেড়াজালে বন্দী।
এই আন্দোলন আমাদের কিছুই দিতে পারেনি,আমাদের সুস্থ মনকে পুরুষবিদ্বেষী করে বিষাক্ত করেছে শুধু।
তাই সমাধানের জন্য প্রথমেই উচিৎ হবে, পুরুষদের প্রতিপক্ষ না ভেবে পরিপূরক ভাবা।
যারা স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চিৎকার করে, যারা বলে নারীরা পুরুষের থেকে কোনো অংশে কম নয় কিংবা মানসিক -শারীরিক গঠনগত পার্থক্য থাকলেও তা বিবেচ্য বিষয় নয়,সেই সব নারী-দরদী সাহিত্যিকদের সপাটে চড় কষলেন,আজকের বিক্ষুব্ধ লেখকগণ।
ফরাসি নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী Dr Alexis Carrel, তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Man The Unknown ‘তে লিখেছেন,” পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে পার্থক্য সমূহ রয়েছে তা একেবারে মৌলিক প্রকৃতির। এই পার্থক্য গুলো দেহকোষের গঠন ও ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত বিশেষ বিশেষ রাসায়নিক ধাতু -অনুপ্রবিষ্ট সমগ্র জৈব সংগঠনের দ্বারা সংগঠিত হয়।এই মৌলিক তথ্যসমূহের বিস্মৃতিতথাকথিত নারী-প্রগতিবাদীদের এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করেছে যে নারী পুরুষ উভয়ের একইরকম দায়-দায়িত্ব থাকা উচিৎ। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষের থেকে নারীর গভীর পার্থক্য রয়েছে।নারীদেহের প্রত্যেকটি অনুকোষ তার লিঙ্গের নিদর্শন বহন করে।তার অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও তার স্নায়ু মণ্ডলী ও একই সত্যের পরিচয় দেয়।নারীদের উচিৎ পুরুষদের প্রতি তাদের প্রবণতা বৃদ্ধি করা।সভ্যতার অগ্রগতিতে তাদের ভূমিকা পুরুষদের থেকে অধিকতর।তাই তাদের বিশেষ দায়িত্ব -কর্তব্য পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়।”
আমরা এখন বিপুল সংখ্যক নারী -পুরুষ সাম্যের অত্যুৎসাহী ব্যক্তিকে দেখতে পাই যারা নারী পুরুষদের এই মৌলিক পার্থক্য গুলোকে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান লেখিকা Margaret Mead তার ‘ Male and Female ‘ গ্রন্থে বলেছেন,” বর্তমানে আমাদের প্রবণতা হল শিক্ষায়,কন্ঠস্বরের ছন্দে,পুরস্কারের নমুনায় ও সময় নির্ধারণে এই পার্থক্য গুলোকে কমিয়ে আনা এবং নারী পুরুষের কোন এক শ্রেনীর উপর প্রতিবন্ধকতা হিসাবে থাকা বিশেষ পার্থক্য অপসারণ করার সাধ্যমত চেষ্টা করা।বালকদের থেকে বালিকারা দ্রুত বেড়ে ওঠে তাই তাদের পৃথক করতে হবে।তাহলে বালকদের ক্ষতি হবে না । পুরুষদের থেকে নারীদের শক্তি সামর্থ্য একটু কম,তাই এমন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে হবে যাতে নারীরা পুরুষদের মতো একই কাজ করতে পারে।তবে কোনো অবস্থাতেই তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেবে না।পার্থক্য সমূহের সহজভাবে ক্ষতিপূরণ করার অর্থ হল পরিণামে পার্থক্য সমূহকে অস্বীকার করা। ”
এছাড়াও বহু নিরপেক্ষ আলোচনা,বিবেচনা করে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক সংস্থা,সাহিত্যিক,বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,” পুরুষ ও নারীর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক,নৈতিক,এমনকি খাদ্যগ্রহণের রুচি একে অপরের থেকে আলাদা।”
Mary B. Beard তার ‘Women as Force in History ‘ গ্রন্থে নারী পুরুষের পার্থক্যের এক অত্যন্ত মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছেন।
Palo Alto মনস্তাত্ত্বিক সংস্থা নারী পুরুষের পার্থক্য আছে এবং সেই তথ্য আবিষ্কার এবং মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
Havelock Ellis আধুনিক শ্রেষ্ঠ যৌন মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ।তিনি তার ‘Man and Woman ‘ গ্রন্থে নারী পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও অন্যান্য শক্তি সামর্থ্য বিষয়ে তথ্য নিরপেক্ষ বিবেচনা করেছেন।তিনি তার বলেন, “আধুনিক কালের বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা খ্যাতময়ী মহিলা Madame Curie,
একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মনীষীর স্ত্রী ছিলেন। যিনি স্ত্রীর অনুসন্ধান কাজের অংশীদার ছিলেন।
মিসেস ব্রাউনিং স্বামী রবার্ট ব্রাউনিংয়ের সাথে পরিচিত হয়ে সুন্দরতম কবিতাগুচ্ছ লিখেছিলেন।George Eliot সাহিত্যে ও বিজ্ঞানে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন J.H.Lewis এর সাহচর্যে এসে।”
সামগ্রিক বিচার করে এই ধারণা করা যায় যে, পুরুষ ও নারীর বুদ্ধিবৃত্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ অভিন্ন চরিত্রের নয়,কিন্তু তাতে কারোর শ্রেষ্ঠতা বা নিকৃষ্টতার কোনো প্রশ্ন উঠে না।তাদের বৈশিষ্ট্য পরস্পরের যথাযথ ভারসাম্য আনে।
এগুলো বাদে, আপনি যদি বাংলা সাহিত্যের দিকে দেখেন,দেখতে পাবেন স্বাধীনতায়(?) বন্দী মহিলাদের হাহাকার।
বাংলাদেশের মহিলাদের সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় প্রতিষ্ঠিত লেখিকাদের কলমে উঠে আসে নানা নারীকথা।
স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা,উলঙ্গপনা এবং নারী পুরুষের অবাধ মেলা মেশার ব্যাপারে মনের অজান্তে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মহিলারা,যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের লেখা গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে।
‘জীবন যেমন’ গল্পে দেখতে পায়, বেশিরভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কিভাবে তথাকথিত স্বাধীনতায় গা ভাসিয়ে দেয়,এবং পরিণতিতে অবসাদগ্রস্ত, ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আমাদের সমাজের পুরুষরা অন্যমেয়েদের প্রতারণা করে তাদের সতীত্ব সম্ভ্রম লুট করে,অশালীন উক্তি করে তাদের সম্বন্ধে।কিন্তু তারা তাদের বোন বা আপনজনের সাথে এ রকম হোক,এটা সহ্য করতে পারে না।
‘জীবন যেমন ‘ গল্পে আমরা সেই চিত্র দেখতে পায়।
এরকম বহু গল্প,প্রবন্ধ, উপন্যাস রয়েছে যা নতুন মুক্তির পথ খুঁজতে ইশারা করে।
‘নক্ষত্রের প্রপাত ‘ গল্পে মেয়েদের মাঝে থাকা ‘বিয়ে মানেই জীবন ধ্বংস ‘এই ভুল ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে।
এখন,এই বিংশ শতকে এসে আমরা বুঝতে পেরেছি যে,স্বাধীনতার নামে আমরা কিছুই লাভ করতে পারিনি।সবাই আজ আর্তনাদ করছি।মুক্তির পথ খুঁজছি।
এই সমস্যার সমাধান তবে কোথায়?
মুক্তির পথ কি?
উত্তর একমাত্র ইসলাম।ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবায়ের জন্য মুক্তির পথ হল ইসলাম।সেদিন, আঠারো শতকে যেভাবে অজান্তে সবাই গা ভাসিয়েছিল, তেমনি আজ সময় সবায়ের এই প্লাবন থেকে নিজেকে হেফাজত করা।
নারীকে তার মানবাধিকার, ধর্মীয় মর্যাদা, সামাজিক,অর্থনৈতিক, ভোটাধিকার, সামরিক, বিবিধ ক্ষেত্রে যোগ্য সম্মান কেবল ইসলাম দিয়েছে,তাও আবার ১৫০০বছরেরও আগে।
আমরা পথহারা পথিক।সমাধান আমাদের কাছেই ছিল,শুধু খেয়াল করিনি।আসুন আজ খেয়াল করে দেখি।আমাদের সত্যিই কোনো স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
#মানবাধিকার :- “মোমেন পুরুষ ও মোমেন নারী, এরা একে অন্যের বন্ধু,তারা সততার আদেশ দেয় এবং মন্দের প্রতিরোধ করে।”
(তাওবা-৭১)
আমরা ইতিমধ্যে বলেছি যে অতীতের অনেক সভ্য সমাজেও তা ধর্মভিত্তিক হোক বা ধর্মহীন নির্বিশেষে, নারীকে মানুষ বলে স্বীকার করা হবে কিনা তা রীতিমতো তর্কের বিষয় ছিল।শুধু একটি ব্যাপারে তারা মতৈক্য ছিল যে,’নারী হচ্ছে এক অপবিত্র জীব।’
এইরকম এক অবস্থায় ইসলাম ছিল নারী জাতির জন্য ন্যায়ের জ্যোতি। শতাব্দীর নিষ্ঠুর শোষণ থেকে ইসলাম নারীকে মুক্তি দিল।ইসলাম নারীকে সব দিক ও সব বিভাগে পুরুষের সমমানে উন্নীত করে।বলাবাহুল্য,নারীর অধিকার ও মর্যাদার পুনর্বহালের সাথে সাথে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যও পুরুষদের বরাবর করে দেওয়া হয়।পূর্বে উল্লেখিত আয়াতেই তা স্পষ্ট।
সুরা নিসার ১নং আয়াত থেকে ৩টি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
১) মানবিকতার ভিত্তিতে পুরুষের মতোই নারী সমমানের মানুষ।
এই আয়াতে আল্লাহ্ সকল মানবজাতিকে অর্থাৎ পুরুষ -নারী সবায়কে নিজ প্রতিপালককে ভয় করার তাগিদ দিয়েছেন।অর্থাৎ আল্লাহ্ভীরুতা প্রসঙ্গে সচেতন করেছেন।
২) ‘একসত্তা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ বাক্যে ঔরসজাত সম্পর্কের থেকে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের অর্থই বেশি প্রকাশ পায়।কেননা,ঔরসজার সম্পর্কের জন্য নর-নারী দুটি সত্তার প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ্ একসত্তা *শব্দ প্রয়োগ করলেন,অর্থাৎ তিনি ঘোষণা করলেন, মানবমন্ডলী সৃষ্টি হয়েছে আদম(আঃ) থেকে।
৩)’সেই সত্তা থেকে তার জোড়া বানিয়েছি ‘ বাক্যে সুস্পষ্ট ভাবে বিবি হাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বলাবাহুল্য যে সন্তানদের মতো মাও মহা মানবতার বিকাশ ও মানব ঐক্যের বরাবরের অংশীদার। দীর্ঘ এই বিশ্লেষণের সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে,ইসলামে সব বুনিয়াদী ব্যাপারে নারী ও পুরুষ সমগুরুত্ব ও সমমর্যাদার অধিকারী।
#ধর্মীয় মর্যাদা :- ‘হে নবী,যখন তোমার কাছে মোমেন নারী বাইয়াত করার জন্য আসে এবং এ কথার শপথ নেয় যে…..কোনো সৎকর্মের আদেশে তোমার অবাধ্যতা করবে না— তাহলে তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো।
(মুমতাহিনা- ১২)
মনীষী মহম্মদ সাতুত তাঁর গ্রন্থ “নারী ও কোরয়ান”-এ এই আয়াত সম্পর্কে বলেন “নারীদের কাছ থেকে আলাদা ভাবে বাইয়াত গ্রহণের অর্থ হচ্ছে ইসলাম নারীদেরকে পুরুষদের চেয়ে পৃথক এক স্থায়ী মর্যাদা দান করেছেন এবং তাদের নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ্র দরবারে নিজেদেরকেই জবাবদিহি করতে হবে।
#অর্থনৈতিক স্বাধীনতা :- ” পুরুষদের জন্য সেই ধনসম্পদে অংশ রয়েছে যা মাতাপিতা ও নিকটাত্মীয়রা রেখে গেছে এবং নারীদের জন্যেও বসেই ধনসম্পদে অংশ রয়েছে যা পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়রা রেখে গেছে—কম হোক বা বেশি, আর এই অংশ আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই নির্দ্ধারিত রয়েছে।”
(সুরা নিসা-৭)
শুধু তাই নয়,মোহরানা ব্যাতিরেকে স্ত্রী ভোগ করা ইসলামে হারাম।
“নারীদেরকে তাদের মোহর–যা তাদের অধিকার, দিয়ে দাও।”(সুরা নিসা-৪)
স্থাবর অস্থাবর সব সম্পদে,এমনকি ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় উপার্জনের অধিকার রয়েছে।
ইসলাম নারীর ওপর পরিচালিত অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘোটায় এবং তাকে তার ন্যায্য অধিকারে প্রতিষ্ঠা করে।
#সামাজিক অধিকার :- “এরপর যখন তাদের ইদ্দত পুরো হয়ে যায় তখন ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রকাশ্য পন্থায় যা মর্জি তা করার স্বাধীনতা তাদের রয়েছে।” (সুরা বাকারা,২৩৪)
মেয়েদের বিবাহ,তালাক, পছন্দ-অপছন্দ,মতপ্রকাশের অধিকার ইসলামে বিদ্যমান।
বিবাহ প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,” কোন অলীর (দায়িত্বশীল) পক্ষে মেয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।”(আবু দাউদ)
মতপ্রকাশে উজ্জ্বল উদাহরণ ইসলাম।হাদীসে উল্লেখ আছে,মক্কা বিজয়ের পর,আবু তালেবের মেয়ে ও আলীর সহোদরা বোন উম্মেহানি একমুশরিক ব্যক্তিকে নিজ গৃহে আশ্রয়দান করেন।আলী (রাঃ) মুশরিককে আশ্রয় দেওয়া অপছন্দ করলে,উম্মেহানি মোহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে বিচার দিলেন। তখন নবী বললেন,” উম্মেহানি! আমরাও তাকে আশ্রয় দিচ্ছি,যাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছো।”(বুখারী)
আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন,” যদি কোনো মহিলা মুসলিমদের পক্ষ থেকে শত্রুকে আশ্রয় দিতে চায়,তাহলে দিতে পারে।”
এই অনুমতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,ইসলামী সমাজে নারীর কাজকে সম্মানের,শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়,এবং যেকোনো মুসলিম মহিলা এই অধিকার ব্যবহার করতে পারেন।কোনো ব্যক্তি এই অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না।
এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে, যেখানে অসতর্কতার কারণে ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে,সেখানেও নারীকে তার অধিকার দিতে ইসলাম অক্ষুণ্ণ। নারীকে মর্যাদা দেওয়া এবং বিশ্বস্ত দায়িত্বশীল কেবল ইসলামই মনে করে।
#সামরিক অধিকার :- ইসলামী শরীয়ত রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও হিফাজতের দায়িত্ব নারীর কাঁধে অর্পন করেনি।কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বীনকে বুলন্দ ও উন্নতশির করার আকাঙ্ক্ষা তাকে যুদ্ধের ময়দানে এনে দিতউম্মে আমারা,উম্মে সুলাইম,আসমা বিনতে ইয়াজিদ, উম্মে হারেস প্রমুখ মহিলারা যুদ্ধের ময়দানে যথারীতি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন,”উহুদের যুদ্ধে ডানে ও বায়ে সেদিকে আমি তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই দেখছিলাম উম্মে আমারা আমাকে রক্ষার জন্য প্রাণপণে লড়াই করছে।”
#শিক্ষায় অধিকার :-সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত থেকে জানা যায় শুধু পুরুষ নয় বরং মহিলাদের জন্যও শিক্ষালাভ করা ফরজ। নারীর ইসমালের নীতিমালা ও মৌলিক বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া,শুধু এতোটুকু বিষয়কে নবী (সাঃ) যথেষ্ট মনে করেন নি।বরং তিনি তাদের জন্য পুঁথিগত শিক্ষাও আবশ্যিক মনে করেছেন।
শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ বলেন,একদা তিনি হাফসা (রাঃ) কাছে গেয়েছিলেন,তখন নবী (সাঃ) বলেছিলেন,” তুমি একে যেমন লিখতে শিখিয়েছ তেমনি বিভিন্ন রোগের দোয়াও শিখিয়ে দাওনা কেন?”
এ থেকে জানা যায় যে,হাবসা (রাঃ) ইতিপূর্বে লিখতে শিখেছিলেন।
উপরিউক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে কেবল ইসলাম যে নারী স্বাধীনতা, মুক্তির পথ তা ব্যাখা করেছি।
এখন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সেই অধিকার আদায় করতে হলে কিছু দায়িত্ব নিতে হয়।
১* আল্লাহ্ প্রদত্ত যে মর্যাদা, যে অধিকারের কথা এতোক্ষন আলোচনা করলাম এগুলো প্রতিষ্ঠা করা ও সংরক্ষণ করার মধ্যেই রয়েছে নারী সমাজের প্রকৃত মুক্তি, সত্যিকারের কল্যাণ।
২* বর্তমানে তথাকথিত প্রগতিপন্থী মহিলাদের ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে কোনো সম্পর্ক ও সংহতি নেই।সুতরাং, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনে,মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক-বাহক মেয়েদের সাথে একাত্ম হতে হবে।
৩* মুক্তি ও কল্যান প্রচেষ্টায় শিক্ষার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাই আন্দোলনকে সফল ও স্বার্থক রূপ দিতে হলে নারী শিক্ষাকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করতে হবে।
৪* শান্তিপূর্ণ ও আদর্শ পরিবার যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের পূর্বশর্ত এই সত্য উপলব্ধি করে কোরয়ান-হাদীস শিক্ষাকে আদর্শিক ভিত্তি মেনে,আধুনিক বিজ্ঞানের রূপ দিয়ে আন্দোলনকে ব্যাপকতর করতে হবে।
৫* নারী সমাজের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপক কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে।তাদেরকে অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করা,তার সাথে সাথে নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬*শিক্ষিতা বোনেদের যোগ্যতা, প্রতিভাকে কাজে লাগানোর বাস্তব পদক্ষেপ নিতে গঠনমূলক কাজে নিযুক্ত করতে হবে।যাতে করে অশিক্ষিত অনুন্নত মেয়েদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে তারা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
৭*মান-সম্ভ্রমই নারীর প্রধান পুঁজি। তাই মুক্তি ও কল্যাণ প্রচেষ্টার প্রধান কর্মসূচী হবে মান-সম্ভ্রম সংরক্ষণ।এর প্রাথমিক শর্ত হল,সমাজের উপরতলা থেকে শুরু করে সব অলিগলি নিম্নস্তরের নিষিদ্ধ পল্লির বিলুপ্তি ঘোটাতে হবে।
পরিশেষে, আবারো প্রশ্ন করি।
পুরুষ ও নারীরা কি একই লিঙ্গ? না তারা আলাদা যৌনসত্তা?
তাদের জীবনধারা কি অভিন্ন?তাদের কি স্বাতন্ত্র্যতা নেই?
জীবন চারণায় এখানেই সমস্যার গোড়া।
যদি কেউ নারী পুরুষের সত্তা আলাদা,উভয়ের জীবনধারায় একটা পার্থক্য আছে বলে মেনে নেয়,তা হলে তাকে ইসলামের বিধানকে মেনে নিতেই হবে।