Artical

এই গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মানুসারী নাগরিকরা প্রার্থনার জন্য একটুকরো জমিন পাবেন না! – গোলাম রশিদ

332views

_________________________

মুসলিমদের নামায পড়তে বাধা, গির্জায় হামলা৷ এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ৷ সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে একশ্রেণির মানুষ কী বার্তা দিতে চাইছে? নামায পড়তে দেব না, গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা বন্ধ করে দেব, এমন প্রবণতাও ভালো লক্ষণ নয়৷ পপুলিস্ট রাজনীতির হাত ধরে দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছে, সেটা স্পষ্ট৷ তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের এমন মানসিকতা যোগ হলে তা সমূহ বিপজ্জনক৷ লিখছেন গোলাম রাশিদ

_____________
ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় শ্লাঘা বোধ করেন৷ এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রতিপক্ষ চিন৷ চিন জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে প্রথম৷ কিন্তু সে-দেশে গণতন্ত্র আছে, এমন কথা তার পরম বন্ধুও বোধহয় বলবে না৷ তবে তারা নিজেকে ‘পিপল’স রিপাবলিক’ হিসেবে দাবি করে৷ সেখানকার ইউঘুর মুসলিমদের উপর যে দমন-পীড়ন হয়, ধর্মাচরণে রাষ্ট্রীয় ভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়, তার সঙ্গে অনেকেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মিল খুঁজে পেতে পারেন৷ প্রতিযোগিতার এই নয়া দিকটিতে ভারত ক্রমশ পদচারণা করতে শুরু করেছে৷ দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মাচরণে সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে নানাভাবে বাধাপ্রদান করা হচ্ছে, তাতে ব্যাপারটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৷ আমাদের গণতান্ত্রিক দেশশাসনে সংবিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে৷ সর্বহারার অধিকার আদায়ে কার্ল মার্ক্সের অনুসারীরা যেমন তৎপর থাকেন, তেমনই এ দেশের কোটি কোটি নাগরিকের শেষ আশা ও আস্থা সংবিধানের উপর৷ সেই ‘শাস্ত্র’ যখন বলেছে দেশটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, তখন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষজন তার উপর আস্থা হারিয়ে পাপ কুড়োতে রাজি নয়৷ কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে অন্য কথা৷ এর গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোতে যেভাবে মুহূর্মুহূ কুঠারাঘাত করা হচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার ও প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী যেভাবে কয়েক মাস যাবত উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তা প্ররোচনামূলক৷ হরিয়ানার গুরগাঁও এলাকার বিভিন্ন স্থানে জুম্মার নামায পড়তে বাধা দেওয়া কিংবা দিল্লির চার্চে বজরং বাহিনীর হামলা, এসবই একটি সংবিধানবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক সিস্টেমের অনুসারীদের কাজ৷

ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, কিন্তু ধর্মহীন কোনও রাষ্ট্র নয়৷ এখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ, পারসিক, নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদীদের শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার অধিকার রয়েছে৷ সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য জনগণের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার কথাও বলা আছে। সংবিধানের ২৫ নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, দেশের নাগরিক তার ইচ্ছামতো প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ করতে পারবে৷ ধর্মপালন থেকে কেউ তাকে বিরত রাখতে পারবে না। এটা একজন মুসলিমের যেমন মৌলিক অধিকার, তেমনই একজন খ্রিস্টানেরও মৌলিক অধিকার৷ সেই অধিকারেই সরাসরি হস্তক্ষেপ হচ্ছে সাম্প্রতিক নানা ঘটনায়৷ যে খোলা জায়গায় দিনের পর দিন নামায পড়া হচ্ছে, সেই স্থানটিতে হঠাৎ গোবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এর পিছনে কলকাঠি নাড়ছে৷ তারা সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়৷ তাই সেপ্টেম্বর মাস থেকেই প্রকাশ্যে নামায পড়া যাবে না বলে তারা দাবি তুলছিল৷ এমনকি নামাযের সময় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য এবং লাউডস্পিকারে ভক্তিগীতি চালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীর উপকণ্ঠে। তারা স্থানীয় মানুষজনকেও ক্ষেপিয়ে তুলছে নামাযের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য৷ নামায পড়লে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগে আঘাত লাগছে, এমন যুক্তিও তারা দিচ্ছে। অথচ পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্প্রীতির আবহে ২০১৮ সাল থেকেই ওই জায়গাগুলিতে জুম্মার নামায হয়ে আসছে। তা হলে হঠাৎ করে কোন গোষ্ঠী কী উদ্দেশ্য নিয়ে এমন উত্তেজনা তৈরি করছে, তা ভেবে দেখবার বিষয়৷ গুরগাঁওয়ের মুসলিমদের কয়েক মাস ধরেই সাপ্তাহিক জুম্মার প্রার্থনা করা থেকে বিরত রাখা হচ্ছে৷ সম্প্রতি শহরের সেক্টর ১২-এ এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে হিন্দু গোষ্ঠীগুলির কিছু লোক জমি দখল করে এবং একটি ভলিবল কোর্ট তৈরি করবে বলে দাবি জানায়৷ আসলে তারা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বাদাম খাচ্ছে। কিন্তু তাদের এক কথা, আমরা নামাযের অনুমতি দেব না, যাই হোক না কেন৷ আমরা এখানে ভলিবল কোর্ট বানাব৷ এভাবেই বারবার নামায বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ শান্তিপ্রিয় মুসলিমরা কোনও প্রতিবাদ না করেই স্থান থেকে সরে এসেছে৷ ৩ বছর আগে গুরগাঁওয়ের এই এলাকায় ১০০টিরও বেশি খোলা জায়গা ছিল, যেখানে মুসলিমরা জুম্মার নামায আদায় করত৷ সেসব জায়গায় প্রার্থনা করার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমতিও ছিল। ধর্ম ও গণতন্ত্র বিদ্বেষী কয়েকটি গোষ্ঠী ৩ নভেম্বর একটি বৈঠক করে৷ তারপরই সেই নামাযের জায়গার সংখ্যা কমে ২০-তে নেমে এসেছে। প্রশাসনিক সহায়তা পাননি মুসলিমরা৷ নামায বন্ধ না করা পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ তাদের দাবি, গুরগাঁওতে কোনও মুসলমান জনসমক্ষে নামায পড়বে না। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি দাবি করেছে যে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে নামাযের জন্য সমস্ত খোলা আকাশের নিচের স্থানগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। এই গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মানুসারী নাগরিকরা প্রার্থনার জন্য একটুকরো জমিন পাবেন না!

খ্রিস্টানদের চার্চে গিয়েও এমন গুন্ডামি করছে সংঘ পরিবারের লোকজন৷ কর্নাটকের একটি চার্চে রবিবারের প্রার্থনা চলাকালীন বজরং বাহিনী ঢুকে পড়ে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে হাঙ্গামা করার চেষ্টা করেছে৷ জোর করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, এই তাদের অভিযোগ৷ মহিলারা রুখে দাঁড়ালে তারা অবশ্য সুড়সুড় করে পালিয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু ফিরে আসতে কতক্ষণ? সংখ্যালঘুদের জীবনের নিরাপত্তা কতটুকু? এমন ঘটনা কখনও কর্নাটকে, কখনও দিল্লিতে, কখনও কেরলে, হামেশাই ঘটছে৷ সম্প্রতি হালাল খাবার নিয়ে একশ্রেণির মানুষ তীব্র বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করছে৷ কে কী খাবে, সেটা কি কোনও উগ্রবাদী গোষ্ঠী ঠিক করবে? কেরল, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশে হালাল মাংসের রেস্তোরাঁ তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সংঘ পরিবারের লোকজন৷ এমন দাবি তো নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও গুজরাতে কেউ তোলার সাহস পায়নি৷ এভাবে আসলে অসহিষ্ণুতার মাত্রা ধীরে ধীরে বিপদসীমা পার করছে৷ সংখ্যালঘুদের ধর্ম, খাদ্য, পোশাক নিয়ে খবরদারি, বিধিনিষেধ ভারতের মতো দেশে মানায় না৷ এবার দিওয়ালি উপলক্ষে জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে যখন ‘জশন-এ-রেওয়াজ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয় তখন সেটিও আক্রমণের মুখে পড়েছিল। উর্দু শব্দ ব্যবহার করলে নাকি হিন্দু উৎসবের অপমান হয়, এমন ঠুনকো যুক্তিও শোনা গিয়েছে। একই অজুহাতে তনিশক-এর বিজ্ঞাপনে দেখানো এক মুসলিম মহিলার তার হিন্দু প্রেগন্যান্ট পুত্রবধূর জন্য সাধের আয়োজন হয়ে যায় ‘লাভ জিহাদ’৷ এই উগ্রতা দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷ নামায পড়তে দেব না, গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা বন্ধ করে হুমকি, এমন প্রবণতাও ভালো লক্ষণ নয়৷ পপুলিস্ট রাজনীতির হাত ধরে দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছে, সেটা স্পষ্ট৷ তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের এমন মানসিকতা যোগ হলে তা সমূহ বিপজ্জনক৷ রাষ্ট্র সংখ্যালঘু বিরোধী প্রবণতাগুলিকে রুখে না দিয়ে সেগুলিকে নীরবে সমর্থন করলে বিশ্বের দরবারে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ভালো আলোচনা নিশ্চয় হবে না৷ এ দেশে সংখ্যালঘুরা কতটুকু ধর্মীয় স্বাধীনতা পাচ্ছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রসংঘ, আমেরিকা প্রশ্ন তুলেছে৷ সর্বোপরি সব আঘাতই শেষ পর্যন্ত দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধানের উপর আঘাত হিসেবে নেমে আসছে৷

বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার এই ছবি শাশ্বত ভারতভূমির ধারণার সঙ্গে মেলে না! ‘বিবিধের মাঝে’ এ এক অনন্য মিলনায়তন৷ সেখানে ধর্মাচরণ, খাবার, ভাষার মুসলমানি-হিন্দুয়ানির বিচার করাটা ভারতীয় সভ্যতাকে আবদ্ধ করে দেওয়ার শামিল৷ এখানে যেমন নামায বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এক দল খড়্গ হাতে দাঁড়ায়, তখন শিখরা তাদের গুরুদোয়ারা খুলে দিয়ে আহ্বান জানায়৷ গুরগাঁওয়ের সেক্টর ১২-এর একজন ৪০ বছর বয়সি দোকানদার, নাম তাঁর অক্ষয় যাদব৷ তিনি তাঁর খালি জায়গায় নামায আদায়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৫ জন লোক সেখানে জুম্মার নামাযও পড়েছেন। এঁদের হাত ধরেই ভারত বহুত্ববাদী জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র হিসেবে এগিয়ে যাবে৷ ওই কট্টরপন্থীদের হাত ধরে নয়৷ নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের বাইরে মানুষের জীবনে যে অনাবিল এক স্রোত আছে, সেটাকে ধারণ করা জরুরি৷ এটা দেশের সংবিধানের একটি বড় শিক্ষাও বটে৷

Leave a Response